মমিনুল ইসলাম মোল্লা | প্রকাশ : ২৯ নভেম্বর ২০১৩
ফোরাতের উপকূলে ইয়াজিদ বাহিনীর
হত্যাকাণ্ডের ঘটনাই ইসলামের ইতিহাসে ইমাম হুসাইনকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে।
কারবালার ঘটনাকে কেউ কেউ নিছক ক্ষমতার লড়াই বলে মনে করেন। প্রকৃতপক্ষে ইমাম হুসাইন
ক্ষমতা চাননি। তিনি তাওহিদ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তাই কারবালার ঘটনা ছিল
অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের জয়, তিনি রক্ত দিয়ে ইসলামী উম্মাহর মধ্যে শাহাদাতের
প্রেরণা জুগিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে সূরা আযহাবে ২৩ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন,
“মুমিনদের এমন কিছু (বাহাদুর) পুরুষ, যারা তাদের ইমানের সত্যতা প্রমাণিত করে
আল্লাহর রাহে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন এবং পরবর্তীরাও (পূর্বসূরিদের অনুসরণ করে)
পূর্ববর্তীদের জীবন বিলিয়ে দিয়ে (শাহাদাতের গৌরব লাভের জন্য) প্রতীক্ষায় রয়েছেন।
(পূর্ববর্তীদের শাহাদাত) তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন সাধন করতে পারেনি।”
মূলত আহলে বাইতের ইমানী শক্তির বলেই ইয়াজিদের ৩০ হাজার সশস্ত্র সৈন্যের বিরুদ্ধে
মাত্র ৭২ জন প্রেমিক সৈনিক রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। কেউ কেউ ধর্ম থেকে রাজনীতিকে পৃথক
করার কথা ভাবেন। শুধু ভাবনাই নয়, এ ব্যাপারে বলাবলি করেন- দেশের রাজনীতি নিয়ে আমরা
মাথা ঘামাই না। আমরা শান্তিমত আল্লাহর ইবাদত করতে পারলেই যথেষ্ট। এ কথা আমরা জেনেই
বলি আর না জেনেই বলি, এটি কিন্তু ইয়াজিদের কথার সঙ্গেই মিলে যায়। মূলত ইয়াজিদ কী
চেয়েছিল? সে কি ধর্ম পালনে কাউকে বাধা দিয়েছিল? হিজরি ৫০ সালে মুয়াবিয়া কারও সঙ্গে
কোনো ধরনের পরামর্শ না করেই তার ছেলে ইয়াজিদকে ক্ষমতায় বসান। ইয়াজিদ খলিফা হয়ে
ইমাম হুসাইনকে তার হাতে বায়াত হতে বলেন। সে এমনও প্রস্তাব দিয়েছিল- আপনি ধর্মীয়
দিকটি দেখবেন আর আমি রাজ্য চালাব। ইয়াজিদের মতো একজন লোককে যদি ইমাম হুসেন মেনে
নিতেন তাহলে কী হতো? সহজেই অনুমান করা যায়।
খোলাফায়ে রাশেদীনের পর উমাইয়া
শাসনামলে ইসলামী মূল্যবোধের রদবদল চলছিল। শাসনকর্তার নির্দেশে পরিচালিত নতুন
বিষয়গুলো ছিল কোরআন ও সুন্নাহ পরিপন্থী। তাই এগুলোর প্রতিবাদ করা ইমানী দায়িত্ব
হয়ে পড়ে। বিশেষ করে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের
মাত্রা বেড়ে যায়। অথচ উহুদের যুদ্ধে নবীজীর ইচ্ছা ছিল মদিনায় অবস্থান করে প্রতিরোধ
গড়ে তোলা; সাহাবাদের পরামর্শে তিনি তার মতামত ত্যাগ করে উহুদের ময়দানে অবস্থান
গ্রহণ করেন। ইয়াজিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইমাম হুসাইন (রহ.)
বলেন, “আমি সৎ কাজের আদেশ দান ও অসৎ কাজের বাধা প্রদানের উদ্দেশ্যে সংগ্রামে
নেমেছি। আশুরার আগের রাতে তিনি সঙ্গীদের বলেন- যার ইচ্ছা সে চলে যেতে পারে, কারণ
আমার সঙ্গে থাকা মানেই হচ্ছে নির্ঘাত মৃত্যু।” এ ব্যাপারে মুসলিম ইবনে উজ্জাহ নামক
এক সাহাবি সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে বলেন, আমাকে যদি একবার হত্যা করে আবার ৭০ বার জীবিত
করা হয়, আবারও হত্যা করা হয়, তবুও আমি ছেড়ে যাব না। কারবালার ঘটনায় ইমাম যাইনুল
আবেদিন ছাড়া বাকি ৭২ জন নির্মমভাবে নিহত হন। নিহতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন-
হজরত আলী (রা.)-এর সন্তান আবু বকর, ওসমান, হুসাইনের সন্তান আলী আকবর, আবদুল্লাহ,
হাসানের পুত্র উমর, কাশেম, আকিলের সন্তান জাফর, আবদুর রহমান, আবদুল্লাহ বিন জাফরের
পুত্র আউন, আবদুল্লাহ প্রমুখ।
হজরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর
পরিবারের প্রতি আমাদের মহব্বত থাকতে হবে। বুখারি শরিফে বর্ণিত হয়েছে (হাদিস নং
৫৯৯৪ )- “আর আমি নবী (সা.)কে বলতে শুনেছি এরা দু’জন (হাসান ও হুসাইন) আমার দুনিয়ার
দুটি ফুল। বারা বিন আযিব (রা.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি রাসূলকে (সা.) বলতে
শুনেছি- তিনি বলেন, রাসূল (সা.) হাসান বিন আলীকে কাঁধে নিয়ে বলেছেন, “হে আল্লাহ
আমি একে ভালোবাসি। সুতরাং তুমিও একে ভালোবাস এবং যে তাকে ভালোবাসে তুমি তাকেও
ভালোবাস (বুখারি)।” কারবালার ঘটনায় আমরা শিক্ষা পাই- মিথ্যার সঙ্গে আপস করা যাবে
না। সুতরাং মুসলমান হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে সব অবস্থায় সত্য কথা বলা, সত্য
প্রকাশে নির্যাতনকে ভয় না করা। এক্ষেত্রে ইমাম হুসাইন কাল কিয়ামত (রহ.) মুমিন
বান্দার আদর্শ।
লেখক : প্রভাষক ও প্রবন্ধকার
Maminmollah@yahoo.com