দেবিদ্বারের শুভপুরের পানঃ হারিয়ে যাওয়া ঐতহ্য
‘যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম, মহেশখালীর পানের খিলি তারে বানাই খাওয়াইতাম'। মহেশখালীর পান শুধু স্থানীয় চাহিদা নয় পূজা পার্বণেও সবার সেরা। মহেশখালী ছাড়াও চট্টগ্রাম, রংপুর, দিনাজপুর আর রাজশাহীর পান এখন সারা দেশে পানসেবীদের খুবই প্রিয়। এছাড়া বাংলা, ভাটিয়াল, চাল ডােগা, ঘাসপান ও পার্বত্য চট্টগ্রামের সাচি পানের মতাে দেবিদ্বারের এক ধরনের পান একসময় স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দূর দুরান্তে চলে যেতাে।
কিন্তু কালের বিবর্তনে দেবিদ্বারে পান ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। পান চাষীরা জীবন ও জীবিকার তাগিদে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। মূলত: হিন্দুরাই বর্তমানে পান চাষের সাথে জড়িত। মুসলমানদের আগমনের বহু পূর্ব থেকেই এ অঞ্চলের লােকেরা পান চাষের সাথে জড়িত ছিল। বৈজ্ঞানিক দিক দিয়ে পিপুল পরিবার ভুক্ত গুল জাতীয় পণ্য পান শুধুমাত্র এশিয়াতেই লক্ষ্য করা যায়।একসময় দেবিদ্বারে
পানকে তাম্বুল নামে ডাকত। কেউ কেউ নিশ্বাসকে সুরভিত করতে অথবা ঠোট লাল করার জন্য সখের বশে পান চেখে দেখতেন। অবশ্য পানের মধ্যে। কিছুটা মাদকতার আনন্দও রয়েছে। ঘটক মিজানুর রহমান বলেন, পান বিয়ে অনুষ্ঠানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পান ছাড়া বিয়ের কথাই ঠিকভাবে জমে উঠেনা। তাই বিয়ের মধ্যে কোরমা পোলাও খাওয়ালেও যদি পানগুলো ভাল নাও হয় তাহলে কনে পক্ষের বদনাম? হয়। শুধু বিয়ে নয় রাজনৈতিক মজলিশ, ঘরোয়া আলােচনা এবং সামাজিক জলসাতেও পানের উপস্থিতি একান্ত ভাবে আবশ্যক। দেবিদ্বারের একটি অন্যতম পান প্রধান এলাকা শুভপুর। এই এলাকার প্রায় দেড় থেকে দুইশ
লোক এ পেশার সাথে জড়িত ছিল। এখন অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন, পান চাষে লাভ কম হওয়ায় বিশিষ্ট পান চাষী রণদা প্রসাদ সিংহ চাকুরি করে সংসার চালাচ্ছেন। এক পরিবারের সকলেই পান চাষের সাথে জড়িত এমন পরিবার শুভপুরে এখনও পাওয়া যাবে। তবে তাদের সংখ্যা ক্রমশ কমছে।
সুখকর চন্দ্র সিংহ, উত্তম চন্দ্র সিংহ এবং জীবন চন্দ্র সিংহ ৩ ভাই এখনও পৈত্রিক পেশা ধরে রেখেছেন। অধিকাংশ চাষী দুরবস্থার মধ্যে থাকলেও কেউ কেউ পান চাষ
করে সুখের নীড় গড়েছেন। এ ব্যাপারে রাখাল চন্দ্র দে এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে এখনকার চেয়ে আগে পান চাষে বেশি লাভ হতো বলে তিনি মনে করেন। রাখাল চন্দ্র দে এর পাশাপাশি হরিপদ বীর ও খোকন সিংহ ও তুলনামূলকভাবে বেশি পরিমাণ জমিতে পান চাষ করেন। তবে আগের তুলনায় ওরাও পানের বরজ কমিয়ে দিয়েছেন। কয়েকবছর আগে রাখার চন্দ্র দে এর ৫০০ লাইন পান ছিল। এখন তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। অনেক চাষী এ পেশা ছেড়ে দিলেও সেন্টু পালের বিধবা স্ত্রী এখনও পান চাষ করেই কোন রকমে সংসার চালাচ্ছেন। শুভ পুরের সবচেয়ে বেশি বয়স্ক পান। চাষী শতিশ সিং (৮২) বলেন, যুগ যুগ ধরে আমরা পান চাষ করে আসছি। তবে বর্তমানে খরচের তুলনায় বিক্রি কম হওয়ায় অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিয়েছে। দেবিদ্বারের মাটি উর্বর ও অপেক্ষাকৃত উঁচু হওয়ায় এ উপজেলার অধিকাংশ যায়গায় পানি উৎপাদন হতে পারে। দেবিদ্বারের উপসহকী কষি কর্মকর্তা আব্দুল বাতেন বলেন, পান চাষের জন্য নির্বাচিত জমি সাধারণ জমির চেয়ে একটু উঁচু। মাটির ধরণ শক্ত এবং জলাশয়, পুকুর ইত্যাদির ধারে কাছে হওয়া বাঞ্চনীয়। পান চাষীরা জানান, জমি তৈরীর পর মে ও জুন মাসে পানের লতা রােপন করা হয়। মাঝখানে দুই ফুট দুরত্ব রেখে চারাগুলি সমান্তরার লাইনে রােপন করা হয় এবং পরে বাঁশের শলা বা খুঁটি পুঁতে তার সাথে পানের লতাগুলি জড়িয়ে দেওয়া হয়। রােদ এবং গরু ছাগলের হাত থেকে বরজ রক্ষা করার জন্য উপরে এবং চারদিকে বাঁশের শলা দিয়ে বেড়া দেয়া হয়। নিয়মিত পানি সেচ দেয়ার পাশাপাশি অন্যান্য যত্ন নেয়ার মাধ্যমে ১ বছর পর পান পাতাটি খাওয়ার উপযুক্ত হয়।
( মমিনুল
ইসলাম মোল্লা,নিউজ আর্কাইভস থেকে 30/07/09 সাপ্তাহিক আমোদ, কুমিল্লা।)