নগর কৃষি নিয়ে ভাবতে হবে


নগর কৃষি নিয়ে ভাবতে হবে
বাংলাদেশে নগরায়ন দ্রুতগতিতে হচ্ছে।
কমে যাচ্ছে গ্রাম। সুজল-সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশ পরিণত হচ্ছে ইট-পাথরের নগরীতে। আমাদের চোখের সামনেই ভরাট হয়ে যাচ্ছে ধানের ক্ষেত, খেলার মাঠ। মানুষ নির্দ্বিধায় কেটে ফেলছে গাছ-বৃক্ষ-তরুলতা, ভরাট করছে মাছের পুকুর-ফসলি জমি, তার পরিবর্তে গড়ে উঠছে বিল্ডিং, মার্কেট, শিল্প-কারখানা। ফলে আবাদি জমি কমছে, কমছে কৃষিনির্ভর জনসংখ্য। ফলে গ্রামীন চাষাবাদের পাশাপাশি নগরীয় চাষাবাদ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। নগরীয় কৃষি ছাড়া ভবিষ্যতের নগরীয় বাংলাদেশকে চিন্তা করা যায় না। বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে নগরীয় কৃষি ও গ্রামীণ কৃষি উভয়ের সহযোগিতা প্রয়োজন। ১০ হাজার বছর আগে মিসর, মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতবর্ষের উর্বর ভূমিতে সর্বপ্রথম কৃষিকাজ শুরু হয়। প্রথম দিকে ধানের আবাদ ছিল না। মানুষ খাদ্যশস্য হিসেবে গম, বার্লি, কর্ন, মটর, মসুর ও ছোলার চাষ করত। বাংলাদেশের প্রায় শতভাগ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল। এখন সে হার অনেক কমে গেছে। কৃষি শুমারি ২০০৮ অনুযায়ী গ্রামাঞ্চলে কৃষি পরিবারের সংখ্যা ছিল ৭২.৭০ শতাংশ। বছরে প্রায় ৫ শতাংশ লোক অকৃষি পেশায় চলে যাচ্ছে। ১৯৯৫-৯৬ থেকে ২০০৫-০৬ সালে অকৃষি পেশার সংখ্যা ৮ লাখ থেকে ১২ লাখে হয়েছে। আন্তর্জাতিক হিসেব অনুযায়ী খাদ্য নিরাপত্তায় অনেক পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট প্রকাশিত বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তার ব্যাপারে যে চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে ১০০-এর মধ্যে ৩৪ দশমিক ৬ পয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশ ৮১তম অবস্থানে রয়েছে। বর্তমানে আমাদের দেশের নগরীয় কর্তৃপক্ষ সাধারণত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, মশা নিধন, সড়ক, ফুটপাত, ড্রেন নির্মাণ, ড্রেন সংস্কার, সড়ক বাতি, কবরস্থান, শ্মশানঘাট, সংরক্ষণ, বিপণি বিতান, পরিচালনা, আন্তঃবাস টার্মিনাল, স্বাস্থ্যসেবা, শরীরচর্চা কেন্দ্র, জাদুঘর, কমিউনিটি সেন্টার, লাইব্রেরি, খেলার মাঠ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে ব্যস্ত। এসব কাজের পাশাপাশি নগরীয় কৃষি নিয়েও নগর সরকারকে ভাবতে হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৩০৮টি পৌরসভা ও ১০টি সিটি করপোরেশন রয়েছে। দুই রকম নগর ব্যবস্থাপনা বাদ দিয়ে এক রূপনগর ও নগর সরকারব্যবস্থা চালু করতে হবে। এগুলো নগর কৃষি সম্প্রসারণে সহযোগিতা করতে পারে। নগরবাসীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কৃষি ক্ষেত্রে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ, বাস্তবায়ন, কৃষিবিষয়ক জরিপ চালনা, বাঁধ ও পানি নিষ্কাশন, উন্নত সার-বীজ ও কীটনাশক ওষুধ সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিতকরণ ও নগরীয় কৃষি সম্পর্কিত প্রদর্শনী প্লট তৈরি সহযোগিতা করার জন্য নগরীয় কৃষিবিদ তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে জনসংখ্যা ১৬ কোটি। প্রতিবছর ২৫ লাখ নতুন মুখ আমাদের মিছিলে শরিক হয়। আর তাদের জন্য প্রতিবছর সাড়ে ৩ লাখ টন বাড়তি চালের দরকার হয়। ২০৩০ সালে দেশের জনসংখ্যা হবে ১৯ কোটি। তখন ৪ কোটি টন খাদ্যের প্রয়োজন হবে। তাই বর্তমানে হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন ২.৮ টন থেকে ৪ টনে নিয়ে যেতে হবে। ২০৫০ সালে জনসংখ্যা কত হবে তা পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণের ওপর নির্ভরশীল। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের তথ্যানুসারে পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণকারীর সংখ্যা যদি ৭২ শতাংশে উনি্নত করা যায় তাহলে জনসংখ্যা হবে ২২ কোটি। এএফপি ২০০৮ সালে খাদ্য ঘাটতির ব্যাপারে একটি রিপোর্ট পেশ করে। এতে বলা হয় বিশ্বে ৩৩টির ও বেশি দেশে তীব্র খাদ্য সঙ্কট চলছে। যার ফলে বিরাজ করছে গণঅসন্তোষ। ৩৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা ইন্সটিটিউটের মতে দেশের ৫০ ভাগ লোক বছরে কোনো না কোনো সময় খাদ্য ঘাটতিতে পড়ে। ২৫ ভাগ লোক নিয়মিত খাদ্য ঘাটতিতে পড়ে এবং ৭ ভাগ লোক ৩ বেলা খেতে পায় না। মাত্র ২৫ ভাগ লোক প্রয়োজনীয় খাদ্যশক্তি পায় মাত্র ১ ভাগ লোক ভিটামিন বি এবং ২৩ ভাগ লোক ভিটামিন সি-এর চাহিদা পূরণ করতে পারে। ভূমি জরিপ বিভাগের তথ্যানুযায়ী ১৯৭১ সালে আমাদের আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ১৭ লাখ হেক্টর। ১৯৮৬ সালে তা কমে হয় ৮১ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর ২০০৩ সালে ৭০ লাখ ৮৭ হাজার হেক্টর। বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় ৩২০ হেক্টর জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। ফলে ১৫ লাখ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তা হারাচ্ছে। কৃষি শুমারি ১৯৮৪ ও ২০০৮ এর মধ্যে তুলনা করলে দেখা যায় এ সময়ে আবাদি জমি কমেছে ৩৩ হাজার একর। অতিরিক্ত জনসংখ্যার জন্য স্বাভাবিকভাবেই ঘর-বাড়ি তৈরি করতে হচ্ছে। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী তখন দেশে ঘর-বাড়ি ছিল ২ কোটি সাড়ে ৪৮ লাখ। ২০০৮ সালে তা দাঁড়ায় ২ কোটি ৮৬ লাখ ৭০ হাজার। আর বর্তমানে ঘর-বাড়ির সংখ্যা ৩ কোটি ২১ লাখ ৭৩ হাজার ৬৩০টি। এছাড়া রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্টের মাধ্যমেও আবাদি জমি নষ্ট হচ্ছে। অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১২ অনুযায়ী ২০০১ সালে দেশে জাতীয় মহাসড়কের পরিমাণ ছিল ৩০৮৬ কিলোমিটার। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৩৫৩৮ কিলোমিটার। আঞ্চলিক মহাসড়ক ছিল ১৭৫১ যা বেড়ে হয়েছে ৪০৭৬ কিলোমিটার। ২০২০ সালে উন্নয়নশীল দেশের বিশেষ করে আফ্রিকা, এশিয়া, ও ল্যাটিন আমেরিকার জনসংখ্যার শতকরা ৭৫ ভাগ লোক নগরে বসবাস করবে। বর্তমানে বাংলাদেশের ৫ কোটি লোক নগরে বসবাস করছে। ২০২০ সালে তা হবে ৮ কোটি, আর ২০৫০ সালে গোটা বাংলাদেশের লোক নগরীয় সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বসবাস করবে। তাই নগরীয় কৃষিকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। (সূত্র-নগরীয় কৃষি ও সবুজায়ন-নিতাই চন্দ্র রায়)। যেসব দেশে ইতোমধ্যে নগরায়ন সম্পন্ন হয়েছে, সেসব দেশের লোকরা ইতোমধ্যে নগরীয় কৃষিতেও বেশ এগিয়ে গেছে। হারারে নগরের স্বল্প আয়ের লোকজন যে পরিমাণ খাদ্যগ্রহণ করে তার শতকরা ৬০ ভাগ আসে নগরীয় কৃষি থেকে। ক্যাম্পালা শহরের লোকজন তাদের বাগানে উৎপাদিত পণ্যের মাধ্যমে ৫০ ভাগ চাহিদা পূরণ করে। ডাকারের জনসাধারণ তাদের প্রয়োজনীয় ৬০ ভাগ শাক-সবজি নগরীয় কৃষির মাধ্যমে লাভ করে। এছাড়া হ্যানয়ে বসবাসকারী লোকজন তাদের চাহিদা মোতাবেক মাছ, মাংস ও শাক-সবজি নগরীয় খামারগুলোয় উৎপাদন করতে সক্ষম হচ্ছে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় প্রাথমিক পর্যায়ে ছাদে শাক-সবজির চাষ শুরু হয়েছে। বিশেষ করে সাভার ব্যাংক টাউন, সবুজ বাছা, ছায়াবীথি ও শাহবাগ এলাকার ছাদে ছাদে এখন শীতকালীন সবজি শোভা পাচ্ছে। আমরা হয়তো ছাদে ধান, আলু চাষ করতে পারব না তবে প্রয়োজনীয় সবজি চাষ করতে বাধা নেই। এছাড়া নগরে পরিকল্পিতভাবে মাছ ও মুরগির খামার, গরু মোটাতাজাকরণ ও গরুর দুধের খামার সহজেই করতে পারি। সে জন্য নগর কৃষির সংজ্ঞা পাল্টাতে হবে। নিতে হবে নতুন উদ্যোগ। মমিনুল ইসলাম মোল্লা: কলাম লেখক




শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.