সরকারি বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণী চালুর উদ্যোগ
প্রাক - প্রাথমিক শিক্ষার দুটি ভিশন রয়েছে। স্বল্পমেয়াদি ভিশন হচ্ছে ৫ থেকে ৬ বছরের কম বয়সী সব শিশুকে প্রাক - প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় আনা। আর দীর্ঘমেয়াদি ভিশন হচ্ছে ৩ - ৬ বছরের কম বয়সী সব শিশুকে প্রাক - প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় নিয়ে আ সা।মমিনুল ইসলাম মোল্লা শিশু শ্রেণীতে পাঠদানের জন্য আগামী তিন অর্থবছরে ৩৭ হাজার ৬৭২ জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হবে। এ লক্ষ্যে গত ৪ নভেম্বর চিঠি দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে , চলতি অর্থবছরে নিয়োগ দেয়া হবে ১৫ হাজার শিক্ষক। এর মধ্যে চলতি মাসের মধ্যেই ১৫ হাজার শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। আগামী মার্চের মধ্যে এ ১৫ হাজার শিক্ষকের নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হবে। নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের বেতন - ভাতা পরিশোধ করা হবে তৃতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি ( পিইডিপি - ৩ ) নামের প্রকল্প থেকে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে শিক্ষকদের চাকরি রাজস্ব খাতে নেয়া হবে। আগামী বছর থেকেই প্রাথমিক শিক্ষায় আরো একটি শ্রেণী যুক্ত হচ্ছে। এর নাম দেয়া হয়েছে শিশু শ্রেণী। এর মধ্য দিয়ে সরকারি স্কুলে চালু হচ্ছে এক বছর মেয়াদি প্রাক - প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক বিদ্যালয় গিয়ে শিশু শ্রেণীতে নিবন্ধিত হয়ে একটি শিশু এক বছর পড়াশোনা করবে। এরপর সে উঠবে প্রথম শ্রেণীতে। সারাদেশে ৩৭ হাজার ৬৭২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। আগামী বছর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই শিক্ষা চালু করা হবে। সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশার বলেন , এই শ্রেণী চালুর কারণে প্রতিটি বিদ্যালয়ে একটি শ্রেণীকক্ষ বাড়াতে হবে এবং নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এ ধরনের শিক্ষা আরো আগে থেকেই চালু থাকা উচিত ছিল। শহরে কিংবা গ্রামে কোনো বিদ্যালয়েই নাম না লিখতে না পারলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয় না। নাম লিখতে না পারলেও অন্ততপক্ষে বর্ণমালাগুলো বলতে হয়। যে ছেলেটি এর আগে কোনো দিন বিদ্যালয়ে আসেনি সে নাম লিখবে কীভাবে ? একথাটি কি আমরা চিন্তা করেছি ? বিশেষ করে যাদের মা - বাবা নিরক্ষর , তারা বাড়িতে শিশুদের কীভাবে বর্ণমালা শিখাবেন ? এজন্য বেশিরভাগ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য যে প্রস্তুতি নেয়ার দরকার সে পরিবেশ বাড়িতে পায় না। এতে দেখা যায় , অনেক শিশু প্রাথমিক অবস্থাতেই ঝড়ে যায়। আর প্রাক - প্রাথমিক শিক্ষা চালু হলে শিশুদের মধ্যে স্কুলে যাওয়ার বিষয়টি আনন্দময় হয়ে উঠবে। শিশুরা খেলাধুলা পছন্দ করে। প্রাক - প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুদের খেলাধুলাকে পাঠ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ শিশুরা যেন তার বাড়ির পরিবেশের চেয়েও স্কুলকে আনন্দদায়ক মনে করে সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফলে ছাত্রছাত্রী ভর্তির সংখ্যা বাড়বে , ঝরে পড়া রোধ হবে। শতভাগ ভর্তির ব্যাপারে আমরা আরেক ধাপ এগিয়ে যাব। প্রাক - প্রাথমিক শিক্ষায় ৫ - ৬ বছরের শিশুরা ভর্তি হয়। এখন কোনো কোনো স্কুলে প্রাক - প্রাথমিক শ্রেণী চালু করা হলেও ২০১৩ সালে সারাদেশে তা চালু করা হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হয়। এর সাথে আরো একটি শ্রেণী যোগ করা হবে। আর সেটি হবে শিশু শ্রেণী। জাতীয় শিক্ষানীতি - ১০ এ প্রাক - প্রাথমিক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। সেখানে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে ৪ বছরের ঊর্ধ্ব বয়সী শিশুদের জন্য এক বছর মেয়াদি প্রাক - প্রাথমিক শিক্ষার সুপারিশ করেছে। মানবিক বিকাশ ও দৈহিক প্রস্তুতির জন্য এ শিক্ষার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষাক্রমে প্রাক - প্রাথমিক শিক্ষার প্রকৃতি , আওতা ও মানের যৌক্তিকতা এবং প্রয়োজনীয়তা , উদ্দেশ্য , শিখন ফল , বিষয়বস্তু , প্রাক - প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিভিন্ন কর্মকা -, প্রয়োজনীয়তা শিখন শেখানো সামগ্রী ও শিক্ষা উপকরণের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। প্রাক - প্রাথমিক শিক্ষার দুটি ভিশন রয়েছে। স্বল্পমেয়াদি ভিশন হচ্ছে ৫ থেকে ৬ বছরের কম বয়সী সব শিশুকে প্রাক - প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় আনা। আর দীর্ঘমেয়াদি ভিশন হচ্ছে ৩ - ৬ বছরের কম বয়সী সব শিশুকে প্রাক - প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা। বাংলাদেশে অবস্থিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ১৯৭৫ সালে জাতীয়করণ করা হয়। এ সময় ৩৬৮৪৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের আওতায় আসে। এরপর মাত্র একবার প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারের আওতায় নেয়া হয়। আর সেটি হচ্ছে ১৯৮০ সালে। তখন ৮২৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়। বর্তমান সরকার নতুন করে দেড় হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। এতে সরকারের ব্যয় হবে ৬৩৪ কোটি টাকা। প্রাক - প্রাথমিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে প্রথম এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। সবার জন্য শিক্ষা ঘোষণা , সবার জন্য শিক্ষা কাঠামো ও জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা প্রাক - প্রাথমিক শিক্ষা সমর্থন করে। বিশ্বব্যাংকের ভাষ্যমতে একযোগে চার বছরের শিক্ষার সুযোগ যারা পেয়েছে তাদের দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানের সম্ভাবনা অনেকাংশে কম। চীনের অন্তর্ভুক্ত তিব্বতের প্রাক - প্রাথমিক শিক্ষা স্বীকৃত। সেদেশে আগামী ৫ বছরে প্রাক - স্কুল শিক্ষার জন্য ৬০৮টি নতুন স্কুলঘর স্থাপন ও ৬৮টি ঘর সম্প্রসারণের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। নিরক্ষরমুক্ত দেশ গড়ার জন্য দেশের প্রতিটি গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা প্রয়োজন। দেশে বর্তমানে গ্রাম রয়েছে ৮৫ হাজারের মতো। প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৮০ হাজার ৩৯৭টি। কোনো কোনো গ্রামে ৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও কুমিল্লায় ১১৭৩টি মানিকগঞ্জে ৫৪৮টি টাঙ্গাইলে ৫২৮টি দিনাজপুরে ৩৩৬টি রংপুরে ২৩৭টি জয়পুরহাটে ৩২৬টি সিরাজগঞ্জে ৩৫৬টি , পাবনায় ৩৬৮টি সাতক্ষীরায় ৩৩৫টি এবং নেত্রকোনায় ৮৭৯টি গ্রামে কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। যেখানে স্কুল প্রয়োজন সেখানে স্কুল না থাকলেও কোনো কোনো যায়গায় অতিরিক্ত বিদ্যালয়ও পরিলিক্ষিত হয়। চাঁদপুর শহরে একই যায়গায় পাশাপাশি ২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার কমলাপুর ও বেহাইল ইউনিয়নের মধ্যবর্তী আড়াই কিলোমিটার এলাকায় ১৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। ২ কিলোমিটারের মধ্যে বিদ্যালয় নেই এমন দেড় হাজার গ্রামে সরকার একটি করে বিদ্যালয় স্থাপন করবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এর জরিপ অনুযায়ী দেশের ১৬ হাজার ১৪২টি গ্রামে সরকারি বা বেসরকারি কোনো বিদ্যালয় নেই। তবে লোকসংখ্যার বিচারে ১২ হাজার ৯৪৩টি গ্রামে বিদ্যালয় থাকা উচিত। তাই সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে বা এনজিওগুলোর আরো নতুন নতুন জায়গায় স্কুল স্থাপন করা উচিত। ভূমিষ্ট হওয়ার পর থেকেই শিশুরা শিখতে শুরু করে। দেখা , ছোঁয়া , গন্ধ ও স্বাদ এইসব ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সে সবকিছু শেখে। ঈন্দ্রিয়গুলোর সঠিক ব্যবহারে পরিবার ও শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম। আগে পরিবারে যেসব কাজ করা হতো এখন প্রাক - প্রাথমিক শিক্ষা চালু হওয়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই সে কাজটি করবেন। তাই দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যথাসময়ে প্রাক - প্রাথমিক শিক্ষা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। মমিনুল ইসলাম মোল্লা : শিক্ষক ও কলাম লেখক
শেয়ার করুন