চাপিতলার যুদ্ধঃ মুরাদনগর, কুমিল্লা


চাপিতলার যুদ্ধঃ মুরাদনগর, কুমিল্লা
মমিনুল ইসলাম মোল্লা
 সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুজিবনগর সরকার ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সারাদেশকে ৪টি ভাগে বিভক্ত  করে ৪টি ফোর্স ও ১১টি সেক্টরে  বিভক্ত করে। কুমিল্লা ছিল মেজর খালেদ মোশারফের নামে পরিচিত  “কে ফোর্সের” নিয়ন্ত্রণে। সেক্টর হিসেবে ২নং সেক্টরের আওতাধীন। কুমিল্লা ছাড়াও ঢাকা ও সিলেটের কিছু অংশ ছিল এ সেক্টরের নিয়ন্ত্রণে। এছাড়া এ সেক্টরে ৬টি সাব সেক্টর ছিল। কুমিল্লার মুরাদনগর , গঙ্গাসাগর, আখাউড়া এবং কসবা নিয়ে ছিল একটি সাব সেক্টর। এ সাব সেক্টরের প্রধান ছিলেন ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিন।  ৪র্থ বেঙ্গল এ সাব সেক্টরে যুদ্ধরত ছিল। কুমিল্লায় যে কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধ হয়েছে সেগুলোর মধ্যে চাপিতলার যুদ্ধ অন্যতম।
কুমিল্লা জেলা শহর থেকে ৩৩ কিলেমিটার পশ্চিমে কুমিল্লা - ঢাকা রোডে ময়নামতি হয়ে দেবিদ্ধার পেরিয়ে মুরাদনগরের কোম্পানীগঞ্জ বাজার। এখান থেকে কোম্পানীগঞ্জ -নবীনগর রোডে ৫ কিলোমিটার  উত্তরে গেলেই রাজাচাপিতলা বাসস্ট্যান্ড। এখানে একটি ব্রিজের উপর নবীনগরগামী বাস থামে। এটি স্থানীয়ভাবে গাঙ্গেঝুড়ি ব্রিজ নামে পরিচিত। এ ব্রিজটি একাত্তরের যুদ্ধের স্মৃতি বহন করছে। ৭ নভেম্বর -রবিবার চাপিতলা গ্রামে এ যুদ্ধ সংঘঠিত হয়। তবে তারিখটি নিয়ে কিছুটা মতপার্থক্য রয়েছে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও জনসাধারণ ৩১ অক্টোবর চাপিতলা গণহত্যা দিবস হিসেবে দিনটি পালন করেন। মুরাদনগর উপজেলার ৮নং চাপিতলা ইউনিয়নের ৫, ৬, ৭, ৮, ও ৯ নং ওয়ার্ডের কিছু স্থান যুদ্ধের সাথে জড়িত।
               যুদ্ধের নেতৃত্বঃ মুক্তিযোদ্ধারা এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সুদক্ষ পাকিস্তানী সৈনিকদের প্রতিহত করার চেষ্টা করে। প্রথমত ২ নং সেক্টরের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর এটি এম হায়দার চাপিতলায় পাকিস্তানী সৈনিকদের রাস্তা পাকাকরণের কাজে বাধা দেয়ার পরিকল্পনা করেন। পরবর্তীতে চুড়ান্ত অনুমোদন আসে সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশারফের নিকট থেকে। চাপিতলা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে নেতৃত্ব দেন  কামরুল হাসান ভুইয়া ( পরবর্তীতে মেজর)। যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন হাবিলদার কুদ্দুস, হাবিলদার গাজী, নায়েক নুরুল হক, হাবিলদার রমিজ উদ্দনি,গিয়াস উদ্দিন। চাপিতলার মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিকভাবে খাদ্য ও বাসস্থানের ব্যাপারে সহযোগীতা করেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সফিকুল ইসলাম ওরফে সাহেব আলী  ভুইয়া। জনযোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণহীন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুস যুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। সেদিন প্রাণপনে লড়াই করে দেশের স্বাধীনতায় সহযোগীতা করেন এডভোকেট সামছুল হক ফিরোজ ( চাপিতলা)। হুমায়ুন কবির ( খোশঘর), আতিকুর রহমান ( যাত্রাপুর) শাহজাহান ( কুরুন্ডি) , হানিফ মিঞা ( মটকির চর) ফিরোজ আহমদ ভুইয়া (চাপিতলা), এসএম আলী আকবর ( অনন্তপুর) লুৎফুর রহমান ( খাপুরা) এবং আবুল কাশেম (বাঙ্গরা) মুজিবুর রহমান ( কাশিমপুর)। 
               যেসব স্থানে যুদ্ধ হয়ঃ যুদ্ধের সাথে জড়িত ৩টি ব্রিজ । এগুলো হচ্ছে চাপিতলা গ্রামের দক্ষিণপ্রান্তের গাঙ্গেজুড়ি ব্রিজ, নিমাইঝুড়ি  খালের উপর নির্মিত ব্রিজ ও খাপুড়ার ব্রিজ। চাপিতলার বড় খালটির প্রস্থ ছিল ৮০/৯০ ফুট। খাল হলেও বর্ষাকালে  এতে প্রচুর স্রোত থাকত। এটি দেবিদ্বারের রসুলপুরের কাছ দিয়ে গোমতী নদী থেকে বের হয়ে সিএন্ডবি ব্রিজের নিচ দিয়ে মহেশপুর হয়ে চাপিতলার মধ্য দিয়ে প্রবল বেগে প্রবাহিত হয়ে রামচন্দ্রপুর হয়ে তিতাস নদীতে গিয়ে মিশেছে। এ ব্রিজ পার হয়ে শত্রুরা যাতে চাপিতলা গ্রামে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য ব্রিজের দু পাশের মাটি ২০ ফুট গর্ত করে পানিতে ফেলে দেয়া হয়। এছাড়া সেতু এলাকা ক্ষুদ্রাস্ত্রের কার্যকরী ফায়ারের আওতায় রাখা হয়েছিল। ফলে শত্রুপক্ষ সুবিধে করতে পারে নি। এখানে স্বল্প পাওয়ারের ৩টি মাইন লাগানা হয়। যথাসময়ে এগুলো বিস্ফোরিত হলে সেতুটিতে ৩টি বড় ধরণের ফুটো হয়ে যায়। মাইনগুলোর পাওয়ার কম থাকায় পুরো ব্রিজ ধ্বসে পড়েনি।
               খামারগ্রাম মাদ্রাসার নিকটে চুড়ান্ত যুদ্ধ হয়। চাপিতলা গ্রামে সুবিধা করতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা উত্তরদিকে সরে গিয়ে কোম্পানীগঞ্জ - নবীনগর রোডের বাঙ্গরা খাপুরা ও খামারগ্রাম অংশে বিকল্প প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। পাকিস্তানের সৈনিকগণ খামারগ্রামের প্রতিরক্ষা ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করলে তাৎক্ষণিকবাবে দৌলতপুরে ৭ জন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল পাঠিয়ে সেখানে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়।
               পাক বাহিনী ও রাজাকারদের সাথে সংঘর্ষঃ পাকিস্তানি সৈনিকদের অনুগত  রাজাকাররা পাকিস্তানি সৈনিকদের ধারণা দেয় কোম্পানীগঞ্জ  -নবীনগর রোডে নবীনগর যেতে পারলে বৃহত্তর কুমিল্লার উত্তরাঞ্চলে দখল করা সম্ভব। সুত্রে জানা যায়, মার্চ মাসে যুদ্ধ শুরু হলেও বর্তমান বিবারিয়া এলাকার নবীনগর, বাঞ্ছারামপুরসহ এদিকের বিশাল এলাকা তখনও মুক্ত ছিল। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পাকিস্তানীরা যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন করে সমস্ত বাংলাদেশ এলাকায় প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেয়। চাপিতলাসহসহ নবীনগর এলাকায় অপেক্ষাকৃত নীচু হওয়ায় নভেম্বর পর্যন্ত জলমগ্ন থাকে। আর স্থলপথে ওদিকে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা ছিল কোম্পানীগঞ্জ -নবীনগর রোড। এটি টনকি থেকে নবীনগর পর্যন্ত কাঁচা ছিল। তখন রাজাকারদের সহযোগীতায় রাস্তাটি পাকা করার উদ্যোগ নেয়া হয়।
               তাই ময়নামতি সেনানিবাস থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যেভাবেই হোক নবীনগরসহ  বাঞ্ছারামপুর, সরাইল এলাকা দখল করতে হবে। সে অনুযায়ী কমান্ডিং অফিসার ২ জন সহযোগী  অফিসারের তত্বাবধানে ১ ব্যাটালিয়ন আর্মি সেখানে পাঠানো হয়। সিদ্ধা›ত অনুযায়ী রাজাকার প্রধান মাজেদুল ইসলাম ভূইয়ার সহযোগীতায় একটি দল ময়নামতি সেনানিবাস থেকে কোম্পানীগঞ্জ হয়ে গাড়ি বহর নিয়ে টনকী গ্রামে অবস্থান নেয়। আরেকটি ক্ষুদ্র দল কোম্পানীগঞ্জ থেকে পশ্চিমদিকে গিয়ে নবীপুর হয়ে রঘুরামপুরস্থ মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে হামলা চালানোর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। তৃতীয় দলটি কোম্পানীগঞ্জ পর্যন্ত এক সাথে এসে কুমিল্লা- সিলেট রোডে সিএন্ডবি ব্রিজ এর কাছে নেমে হেঁটে হেঁটে  চাপিতলা  গ্রামের পূর্বদিক দিয়ে প্রবেশ করে। রাজাকার তমিজ উদ্দিন এদলটিকে পরবর্তীতে পথ দেখিয়ে খামারগ্রামে তৎকালীন এমএনএ আবুল হাশেম ( পরবর্তীতে একুশে পদকপ্রাপ্ত) এর বোনের বাড়ি নিয়ে যায় । সেখানে তারা অগ্নি সংযোগ করে।
               চাপিতলায় এমএনএ আবুল হাশেম এর বাড়ি হওয়ার কারণে এ গ্রামটি তাদের লক্ষবস্তুতে পরিণত হয়। চাপিতলা যুদ্ধের আগেও কোম্পানীগঞ্জ ও সিএন্ডবি নামক স্থানে পাকিস্তানী সৈনিক ও মিলিশিয়াদের ক্যাম্প থেকে এ গ্রামের দিকে তীক্ষè নজর রাখা হয় এবং মাঝে মাঝে শেল নিক্ষেপ করা হয়। ২০ অক্টোবর রাজাকারদের সহযোগীতায় এক প্লাটুন সৈনিক চাপিতলায় প্রবেশ করে। এসময় রাজাকার মরহুম মর্তুজ আলী ভুইয়া ও মরহুম আঃ হালিম ভূইয়ার সহযোগীতায় এ্মএনএ আবুল হাশেমের বাড়ি, বাঙ্গরা রূপ বাবুর বাড়িতে লুটপাট করে। এসময় তারা ৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে নিয়ে যায়।  এরা হলেন ১. শাহজাহান পিতা মৃত ছায়েদ আলী ( চাপিতলা ) ২. বিল্লাল হোসন পিতা মৃত রওশন আলী ( মুরাদনগর)  এবং ৩. রাজা মিয়া  পিতা- অজ্ঞাত (মুরাদনগর )। এ তিনজনকে কুমিল্লা সেনানিবাসে নিয়ে র্নিমমভাবে হত্যা করা হয়। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর সেখানে সুরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।
               যুদ্ধের ঘটনাঃ যুদ্ধ শুরু হয় ৭ নভে¤বর রবিবার। যুদ্ধের বা আক্রমণের আশংকা  থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা হাতিয়ার নিয়ে তৈরি থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতিয়ারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ, জেলেটিন, এক্সপ্লোসিভ, গোলা বারুদ, এনারগা-৯৪ রাইফেল,  ৩৬ হ্যান্ড গ্রেনেড, এসএমজি, এসএমসি, এ্লএমজি এন্টিপারসোনাল মাইন, এন্টি ট্যাংক মাইন, ২ ইঞ্চি মর্টার ইত্যাদি।
প্রথম প্রতিরোধঃ একটি ছেলে দৌড়ে এসে কমান্ডার কামরুল হাসান ভুইয়াকে খবর দিলে শত্রুরা রঘুরামপুরের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে হানা দিয়েছে। সেখান থেকে দ্রুত পূর্বদিকে এগিয়ে আসছে। শীতকাল হওয়ায় তখন জমিতে সামান্য পানি ছিল। পাকিস্তানি সৈনিকেরা ধানী জমির মধ্য দিয়ে দ্রুত বেগে হেঁটে রওয়ানা দেয়। শত্রুকে বাধা দেয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রবর্তী দল চাপিতলা নিমাইঝুড়ি খালের উপর অবস্থিত বর্তমান চাপিতলা বাস স্টেশন ব্রিজের পাশে প্রতিরক্ষা বুহ্য গড়ে তোলে। মুক্তিযোদ্ধারা আগে থেকেই ব্রিজের দুই পাশের মাটি কেটে খালের মধ্যে ফেলে দেয়। এছাড়া চাপিতলা গ্রামের দক্ষিণাংশে রুক্কু শাহ এর মাজারের পাশে অবস্তিত গাঙ্গেঝুড়ি ব্রিজ , বাস স্টেশন ব্রিজ ও খাপুড়া ব্রিজসহ টনকী থেকে খামারগাঁও মাদ্রাসা পর্যন্ত যতগুলো  ব্রিজ রয়েছে সবগুলোতে মাইন পোতা হয়েছিল। আর এ কাজটি স্বল্পপ্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সহজ কাজ ছিল না। এ কাজে কেউ সহজে যেতে চাইত না। এগুলো ছিল বুবি টেপ লাগানো মাইন। এগুলো সাধারণভাবে মাইন বা বিস্ফোরক হিসেবে প্রতীয়মান হয় না। কিন্তু যখনই এতে চাপ পড়ে বা টান পড়ে বা ঢিল দেয়া হয় তখনই তা বিস্ফোরিত হয়। মাইন লাগানোর গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে গনি নামের এক সাহসী মুক্তিযোদ্ধা , এম-১৪ এন্টি পারসোনাল মাইন গণি একাই ১৮টি নির্ধারিত স্থানে ফিট করে খুঁটি পুঁতে তাতে তা আটকে রাখে। বিষ্ঞুপুর গ্রামের ভেতর দিয়ে আসা পাকিস্তানি সৈনিকদের দলটিকে আটকানোর জন্য মুক্তিযোদ্ধারা কমান্ডার কামরুল হাসান ভূইয়ার নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হয়। কমান্ডোরের পাশে ছিল হাবিলদার রমিজের প্লাটুন। শত্রুরা এফইউপি ছেড়ে এসাল্ট ফরমেশনে প্রচন্ড ফায়ার করতে করতে এগিয়ে আসে। কমান্ডার চিৎকার করে প্লাটুন কমান্ডার ইপিআরের হাবিলদারকে বার বার ফায়ার করতে বলেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তিনি তা করলেন না। পরিস্থিতি খারাপ দেখে কমান্ডার তখন সবইকে দ্রুত পেছনে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এসময় পাকিস্তানী সৈনিকেরা চাপিতলা গ্রামের ৩৪ জন নারী- পুরুষকে  নির্বিচারে হত্যা করে , ২১ জন নারীর শ্লীলতাহানী করে এবং ৩০টি বাড়ির দেড় শতাধিক ঘর জ্বালিয়ে দেয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা বাংঙ্গরা, খাপুড়া ও খামারগাঁও এলাকায় অবস্থান নেন। সেদিন জোৎস্না রাত থাকলেও এলাকা সম্পর্কে ধারণা না থাকায় এবং গ্রামের রাস্তাঘাট না চেনার কারণে সৈনিকরা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে আঁচ করতে পারে নি। এছাড়া শত্রুর সম্ভাব্য আগমন পথে মাইন দ্বারা বুবি ট্যাপ লাগানোর কারণে শত্রুরা সুবিধে করতে পারে নি।
               মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অবস্থান থেকে ৮০ স্মোক গ্রেনেড ফাটিয়ে ধুম্রজালের সৃষ্টি করে। এসময় তারা নিরাপদ অবস্থানে চলে যায়। রাত ৩ টার দিকে সৈনিকদের অগ্রবর্তী দলটি মুক্তিযোদ্ধাদের  খুজতে খুঁজতে ব্যাংকারের নিকট চলে আসে। প্রতিরক্ষার সুবিধার্থে কোম্পানীগঞ্জ-নবীনগর রোডের পূর্ব পার্শ্বে  খামারগাঁও মাদ্রাসা ও পশ্চিম পাশে কবস্থানের নিকট ট্রান্স ( গর্ত) করেছিল। শত্রু এফইউপি ছেড়ে ২০০ গজের মত দূরে এসছিল। কিন্তু বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড গুলির আঘাতে টিকতে না পেরে ধান ক্ষেতের দিকে পালিয়ে যায়। নিহত ও আহতদের ফেলে তারা চাপিতলা অজিফা খাতুন উচ্চ বিদ্যালয়ে অবস্থিত তাদের অস্থায়ী ক্যাম্পে ফিরে আসে। এসময় নৌকাযোগে আহত ও নিহতদের লাশগুলো সিএন্ডবি ব্রিজের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখান থেকে গাড়ি দিয়ে ময়নামতি সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়।
               চুড়ান্ত আক্রমণঃ তৃতীয় বা চুড়ান্ত আক্রমণ করা হয়  পরদিন  সোমবার সকাল ৯টায়। খামারগাঁও গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা যেখানে আশ্রয় নিয়েছিল তার পশ্চিম দিক থেকে শত্রু আক্রমন করে। মুক্তিযোদ্ধারা পূর্ণভাবে প্রস্তুত ও সতর্ক অবস্থানে থাকায় শত্রুরা সুবিধা করতে পারেনি। এখানে দুপক্ষের মধ্যে প্রচন্ড গুলি বিনিময় হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশ ছিলস্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত , তারা গুলির নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেনি। ফলে প্রচুর পরিমান অস্ত্র ও গোলাবারুদ ক্ষয় হয়। তা না হলে দিনের বেলা পরিচালিত এ যুদ্ধে রাতের যুদ্ধের মতই সাফল্য আসতো। গোলা বারুদ নতুন করে সংগ্রহ করতে হলে ভারতের মেলাঘরে যেতে হবে। স্বল্প সময়ে তা সম্ভব ছিল না। ফলে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধাদের পিছু হটার নির্দেশ দেন।
               গোলা-বারুদের ঘাটতি বাদেও পিছু হটার আরেকটি কারণ ছিল। সেটি হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্লান্তি। দীর্ঘ সময় ধরে  যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা যুবক ছেলেদের ছিলনা রোববার দিনে ও রাতে যুদ্ধ করে অনেকেই আহত ও ক্লান্ত ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বেশিরভাগ ছিল ভারতীয় ৭-৬২ মি.মি বোল্ট একশন রাইফেল। এ রাইফেল দিয়ে ফায়ার করে দুদিনেই ছেলেদের হাতে ফোস্কা পড়ে গিয়েছিল। খামারগাাঁও থেকে পিছিযে আসার আগেই বিকল্প প্রতিরক্ষা তৈরি করা হয়েছিল দৌলতপুরে। এটি মোটামুটিভাবে মজবুত প্রতিরক্ষা ছিল। এখানে একটি এলএমজি সহ ৭জনের একটি সশস্ত্র দল প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। কিন্তু অবস্থা বেগতিক দেখে সমস্ত প্রতিরক্ষা গুটিয়ে বাঙ্গরার ( নবীনগর থানা) দিকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।
               কিন্তু এ অবস্থায়ও যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন সাহসী যোদ্ধা হাবিলদার রমিজ উদ্দিন। কিন্তু এক সময় রমিজ উদ্দিনের গুলি ফুরিয়ে যায়। রমিজ উদ্দিনের পাশে ছিল আবুল বাশার ( বলিঘর) , বাচ্চু মিয়া ( দেলবাড়ি) । রমিজ উদ্দিন তার এক সহযোদ্ধার মাধ্যমে কমান্ডারের কাছে আরো গোলা-বারুদ চায়। এমুনিশন থেকে প্রায় ৪০০ রাউন্ড এমুনিশন পাঠানো হয়। আবারো খবর পাঠানো হয় রমিজ উদ্দিনের প্লাটুন অপসারন করতে। কিন্তু রমিজ তাতে কান না দিয়ে প্রাণপনে যুদ্ধ করতে থাকে। গুলি করতে করতে তারা ট্র্যান্সের উপর উঠে গিয়ে কবরস্থানের এক পাশে অবস্থান নেন। কিন্তু শত্রুুর সংঘবদ্ধ আক্রমনের মুখে একসময় তিন জনকেই শাহাদাত বরণ করতে হয়। দেশের জন্য শহীদ হলেন রমিজ বাহিনী। দেশপ্রেমিকতার  পরিচয় দিতে গিয়ে রমিজের গায়ে ৩৬টি গুলি লাগে। পাকিস্তানী সৈনিকগণ খামারগাঁও  গ্রামে প্রবশ করে কয়েকজনকে হত্যা করে এবং ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়।  তারপর পাকিস্তানি সৈনিকগণ তান্ডব সৃষ্টি করতে করতে কাশিমপুরের পীর সাহেব ( গফুর চিশতি) বাড়ি পর্যন্ত  যাওয়ার সময় দৌলতপুরের ৩জনকে হত্যা করে।  তারপর আর সামনের দিকে এগুইনি। তারা পেছন ফিরে চলে আসে কোম্পানীগঞ্জ। তারপর ময়নামতি সেনানিবাসে ফিরে যায়।
               যে সব এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা অংশ নেয় ঃ চাপিতলা -খামারগাঁও যুদ্ধে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের পাশাপাশি এলাকাবাসী স্বতস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোদ্ধারা আসেন ভারতের মেলাঘর ক্যাম্প থেকে। সেখান থেকে কমান্ডার কামরুল হাসান ভূইয়া ( পরবর্তীতে মেজর) ২১ বছরের অভিজ্ঞ হাবিলদার রমিজ উদ্দিন, হাবিলদার কুদ্দুস, নায়েক নুরুল হকসহ একটি সুসজ্জিত বাহিনী যুদ্ধের ২দিন আগে চাপিতলার অদূরবর্তী কাশিমপুর গ্রামে পৌঁছলে এলাকাবাসী তাদের সহযোগীতায় এগিয়ে আসে। এলাকাবাসীর মধ্যে অহিদ কেরানী এককভাবে পাকিস্তানী সৈনিকদের পর্যুদস্ত করার চেষ্টা করে। পাকিস্তানী সৈনিকেরা সম্মুখ যুদ্ধ বাদেও বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধান করে এবং নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। এসময় অহিদ কেরানী রাইফেল দিয়ে গুলি করে ৬ জন সেনিককে হত্যা করে এবং পরবর্তীতে স্ত্রীপুত্র সহ সৈনিকদের হাতে শহীদ হয়। এসময় পাকিস্তানী সৈনিকগণ চাপিতলার ৩৪ জন , খামারগ্রামের ৬জন এবং  দৌলতপুরের ৩ জনকে হত্যা করে । চাপিতলার যুদ্ধ ছিল একটি পরিকল্পিত যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধারা গোপনসূত্রে খবর পেয়ে মুরাদনগরের বিভিন্ন এলাকা থেকে চাপিতলায় এর জমায়েত হয়। বিশেষ করে চাপিতলা , পু®কুনীরপাড় , খাপুরা , খামারগাাঁও , বাঙ্গরা ,দৌলতপুর , শ্রীরামপুর ও টনকী গ্রামের সাধারণ লোকজন ও মুক্তিযোদ্ধারা  এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
               যুদ্ধের ফলাফলঃ মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী সৈনিকদের সফলভাবে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হলেও একসময় তারা পশ্চাদপসারন করতে বাধ্য হন। ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধরত অবস্থায় মারা যান। উত্তেজিত সৈনিকেরা চাপিতলা গ্রামের ৩৪জন নারী পুরষকে নির্বচারে হত্যা করে। এছাড়া ৩০টি বাড়ির প্রায় দেড় শতাধিক ঘর-বাড়ি পাকিস্তানী সৈনিকগণ আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরক্ষা বেস্টনি উঠিয়ে মালাই বাঙ্গরা চলে যায়। পকিস্তানী সৈনিকদের ২ জন অফিসারসহ ৫৫ জন সৈনিক মারা যায়। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের দেয়া তথ্যানুযায়ী সেদিনের যুদ্ধে ৯৭ জন আর্মি এবং ৯জন রাজাকার মিলে মোট ১০৬ জন মারা যায়। পাকিস্তানী সৈনিকেরা পীরকাশিমপুরের পীর সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করে ময়নামতি সেনানিবাসে ফিরে গেলে চাপিতলা যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
সরাসরি যুদ্ধে শহীদদের তালিকাঃ
সরাসরি যুদ্ধে যারা  শহীদ হনঃ ১.  রমিজ উদ্দিন পিতা-মোছলেহ উদ্দিন (ইপিআর এ কর্মরত ছিল) পুষ্কুনীরপাড় , মুরাদনগর,কুমিল্লা ২. আবুল বাশার পিতা-মৃত পরচান মিয়া, ( ছাত্র) বলিঘর,মুরাদনগর, কুমিল্লা। এ দুজনের কবর সংরক্ষিত অবস্থায় খামারগাঁও  (কোম্পানীগঞ্জ-নবীনগর রোডের পাশে)রাস্তার পাশে অবস্থিত। ৩. বাচ্চু মিঞা পিতা- মৃত চেরাগ আলী , দেলবাড়ি,মুরাদনগর, কুমিল্লা।

রেফারেন্সঃ ১. বংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ( দ্বিতীয় খন্ড)প্রকাশক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এরিয়া সদর দপ্তর কুমিল্লা , ২০০৮সাল ২. একাত্তরের কন্যা জায়া-জননীরা মেজর কামরুল হাসান ভূইয়া সেন্টার ফর বাংলাদেশ লিবারেশন স্টাডিজ, ফেব্রুয়ারি ২০১০, ঢাকা ৩. ৩৬ বছরেও মুরাদনগরে স্মৃতি সৌধ নির্মিত হয়নি- সাপ্তাহিক আমোদ কুমিল্লা, ১৩ ডিসেম্বর ২০০৭, ৪. টোকা ডায়েরীর পাতা থেকে , ড. জয়নাল আবেদিন ২০১৪,অ্যাডন পাবলিকেশন ৫. দি ভিশন অব ডিজিটাল বাংলাদেশ ২০০৮,ঢাকা ৬. আমার দেশ ২০০৭, চাপিতলা যুদ্ধ নিয়ে রাষ্ট্র বনাম হাজী মাজেদুল ইসলাম ভূইয়া ও অন্যান্য  জিআর নং ২৮৮/৭২
 মমিনুল ইসলাম মোল্লা:
তথ্য সংগ্রাহক  মুরাদনগর, কুমিল্লা



শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.