নিয়ন্ত্রণহীন কিন্ডারগার্টেন ও শিশুদের ভবিষ্যৎ


শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ তাদের সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ দেয়া আমাদের কর্তব্য শিশুর পরিচর্যা শিক্ষার মাধ্যমেই জাতির ভাগ্য পরিবর্তন সম্ভব তাই শিক্ষার কোন বিকল্প নেই সুশিক্ষার মাধ্যমেই তাদের উন্নত চরিত্র, ব্যক্তিত্ব উন্নত মানসিকতা গঠন সম্ভব শিশুদের চাহিদার প্রতি খেয়াল রেখে উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশেও কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে কিন্তু সঠিক নিয়ন্ত্রণ তত্ত্বাবধান না থাকায় শিশুরা যুগোপযোগী শিক্ষা পাচ্ছে না
জার্মান শব্দ ‘কিন্ডারগার্টেন’-এর বাংলা অর্থ শিশুদের বাগান। জার্মান শিক্ষাবিদ ফেডারিক ফ্লোয়েবল কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা পদ্ধতির জনক। তিনি সুইজারল্যান্ডের শিক্ষাবিদ জোহান হেনরিখ পেস্টালজি কর্তৃক প্রভাবিত হন। ১৮০৫ সালে জোহানের প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিষ্ঠানে তিনি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৮৩০ সালে সুইজারল্যান্ডে একটি শিশুশিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। ১৮৩৬ সালে তিনি জার্মানিতে ফিরে এসে কিন্ডারগার্টেন নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করেন। সেই থেকে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের যাত্রা শুরু।
ফ্লোয়েবলের নীতি অনুসরণ করেই বর্তমানে সারা বিশ্বে কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা ব্যবস্থা আবর্তিত হচ্ছে। কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে, শিশুর দেহ, মন ও ইন্দ্রিয় অনুশীলনের মাধ্যমে শিক্ষাদান। শিশুদের এ শিক্ষা তাদের শিক্ষার পরবর্তী স্তরে পৌঁছতে সাহায্য করে।
কিন্ডারগার্টেন স্কুলের কোমলমতি শিশুদের বয়সের তুলনায় বেশি বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। প্লে-গ্র“পের একটি ছাত্রকে ৮-১০টি বই পড়তে দেয়া হয়। পরবর্তী শ্রেণীগুলোতে বইয়ের চাপ আরও বেশি। শিশুদের ওপর অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয়ায় তাদের মেধা বিকাশের পরিবর্তে তারা এক ধরনের প্রতিবন্ধী শিশুতে পরিণত হচ্ছে।
সহশিক্ষা কার্যক্রম শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ। শুধু পুঁথিগত বিদ্যার মাধ্যমে শিক্ষা পূর্ণাঙ্গ হয় না। কিন্ডারগার্টেনগুলো ইনডোর, আউটডোর গেমস, চিত্রকলা, সঙ্গীতসহ বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমের কথা বললেও, মূলত অধিকাংশ কিন্ডারগার্টেনে এমনকি পাঠাগারও নেই। যদিও এসবের নাম করে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয়।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, অধিকাংশ কিন্ডারগার্টেন ভাড়া করা বাসায় চলছে। নিচতলা আর দোতলা মিলে চলছে ক্লাস কার্যক্রম। এসব স্কুলে খেলার মাঠ তো দূরের কথা, এক টুকরো খোলা জায়গা পর্যন্ত নেই, যেখানে ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে বা টিফিনের অবসরে শিক্ষার্থীরা সেখানে সময় কাটাতে পারে।
শ্রেণীকক্ষ, বারান্দা ও প্রবেশপথÑ এটুকু জায়গাতেই শিক্ষার্থীরা টিফিনের সময় কাটায়। খেলাধুলার বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় এসব স্থানেই তারা ছোটাছুটি করে। ফলে দুর্ঘটনা ঘটে প্রায়ই । এতে তাদের নাক, কান, হাত কেটে যায় অথবা আঁচড় পড়ে। তাই অভিভাবকরা সব সময় শংকায় থাকেন।
কোমলমতি শিশুরা আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা লাভ করবে, এটাই স্বাভাবিক। অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই উৎসাহমূলক শিক্ষা উপকরণ নেই। এমনকি প্লে-গ্র“পের শিশুদের পর্যাপ্ত পরিমাণে খেলনা সামগ্রী নেই। ফলে বিদ্যালয়কে তারা জেলখানার মতো মনে করে।
কিন্ডারগার্টেনগুলোতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ লক্ষ্য করা যায়। এসব প্রতিষ্ঠানে আলো-বাতাস যথাযথভাবে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে স্যাঁতসেঁতে ভাব বিরাজ করে। জেলা ও উপজেলা সদরের বিদ্যালয়গুলোতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব লক্ষ্য করা যায়। অধ্যক্ষ মহোদয়ের কক্ষটি গালিচাসমৃদ্ধ হলেও ক্লাসরুমগুলো প্রতিদিন মোছা তো দূরের কথা, ঝাড়-ও দেয়া হয় না। ছাত্রছাত্রীদের পায়ে পায়ে আসা ধুলাবালি জমে সৃষ্টি করে অস্বস্তিকর পরিবেশ। ফলে শিশুরা হাঁচি-কাশিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়।
কোমলমতি শিশুদের ভোরবেলা টেনেহিঁচড়ে ঘুম থেকে উঠিয়ে কোলে-কাঁধে অথবা রিকশায় করে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। ছেলেমেয়েদের নিরাপত্তার কথা ভেবে অভিভাবকরাও সঙ্গে আসেন। নির্দিষ্ট ওয়েটিং রুম না থাকায় তাদের খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
এসব প্রতিষ্ঠানের সিলেবাস হরেক রকম। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন রকম বই পাঠ্য করতে দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে দুর্বোধ্য বই পাঠ্য করায় শিশুরা সমস্যায় পড়ে। এছাড়া অপ্রয়োজনীয় বইও পাঠ্য করা হয়। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস থেকেই বই প্রকাশকদের এজেন্টরা প্রতিটি কিন্ডারগার্টেনে স্যাম্পল বই নিয়ে যায়। তারা বিদ্যালয় পরিচালক/প্রিন্সিপালদের ডোনেশনের মাধ্যমে ম্যানেজ করে অপ্রয়োজনীয় বই পাঠ্য করে। বইয়ের গুণগতমান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। অভিভাবকরা এসব বই উচ্চমূল্যে কিনতে বাধ্য হন।
তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী রুবেল জানায়, টিফিনের সময় ওদের খেলতে ও ছোটাছুটি করতে ভালো লাগে। স্কুলে জায়গা বেশি না থাকায় তারা খেলাধুলার সুযোগ পায় না। সুজন বলে, তাদের বইয়ে শিশু অধিকারের কথা লেখা আছে। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের ২৯ ও ৩০ অনুচ্ছেদে শিশুর ব্যক্তিত্ব, মেধা বিকাশ ও বয়সের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিশ্রাম, অবসর যাপন, বয়স অনুযায়ী খেলাধুলা ও বিনোদনমূলক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, অধিকাংশ শিশুই এ অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা কত? এর কোন সুনির্দিষ্ট হিসাব কারও কাছে নেই। কিন্ডারগার্টেনের নেতারাও নানা মত প্রকাশ করছেন। বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের (ডেভ) মহাসচিব মোঃ হাবিবুর একটি জাতীয় দৈনিককে জানান, বর্তমানে সারা দেশে ২৪ হাজারের মতো কিন্ডারগার্টেনে প্রায় ৫০ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। এখানে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার শিক্ষক এবং ৪৮ হাজারের মতো কর্মচারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশ প্রি-ক্যাডেট অ্যান্ড কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রেজাউল হক বলেন, দেশে ২০ হাজারেরও বেশি কিন্ডারগার্টেনে ৩০ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।বাংলাদেশে কিন্ডারগার্টেনগুলোর ওপর কারও কোন নিয়ন্ত্রণ না থাকায় প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক কিন্ডারগার্টেন লক্ষ্য করা যায়। আমরা জানি ‘অতিরিক্ত সবকিছুই খারাপ’। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, একই বিল্ডিংয়ে দুটি কিন্ডারগার্টেন রয়েছে। রাজধানীর মিরপুরের ১৪৯ পশ্চিম মনিপুরে একটি এবং ১৪৯/ই পশ্চিম মনিপুরে আরেকটি কিন্ডারগার্টেন রয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে একটি কোচিং সেন্টারও।
বাংলাদেশ প্রি-ক্যাডেট অ্যান্ড কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রেজাউল হক জানান, কেবল খিলগাঁওয়েই এক বর্গকিলোমিটার এলাকায়ই ৪৫টির মতো কিন্ডারগার্টেন গড়ে উঠেছে। এভাবে রাজধানীসহ সারাদেশে অগণিত কিন্ডারগার্টেন ব্যক্তি উদ্যোগে দোকান খোলার মতো গড়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব বলেন, কিন্ডারগার্টেনগুলো দেশের শিক্ষায় বড় অবদান রাখলেও, এগুলো যেন বেওয়ারিশ। দেখাশোনার কেউ নেই। অথচ একটি নীতিমালার আওতায় নিবন্ধনের ব্যবস্থা করলে ব্যাঙের ছাতার মতো কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠার পথ বন্ধ হতো। আমরা তো সরকারের কাছে আর্থিক সহযোগিতা চাই না। ন্যূনতম নীতিমালার আলোকে কিন্ডারগার্টেনগুলোর নিবন্ধন চাই। বাংলাদেশ প্রি-ক্যাডেট ও কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জানান, দেশে মাত্র ৫ শতাধিক স্কুলের নিবন্ধন আছে। আমরা সরকারকে একটি নীতিমালা করার জন্য বলেছি। কিন্তু সরকার কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০৩ সালে সরকার নার্সারি ও কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোকে নিবন্ধনের উদ্যোগ নিলেও, তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। ওই বছরের ৩১ জুলাই নিবন্ধনের ব্যাপারে সুপারিশ করা হয়।
সুপারিশের মধ্যে ছিল, বাংলা মাধ্যমের সব কিন্ডারগার্টেনের নিবন্ধন ফি ১ হাজার ৫০০ টাকা, প্রতি বছর পুনঃনিবন্ধন ফি ১০০০ টাকা। ঢাকা মহানগর ও অন্যান্য বিভাগীয় শহরে তিন থেকে পাঁচ কাঠার নিজস্ব জমির ওপর ন্যূনতম দুই হাজার বর্গফুট আয়তনের ভবন, আর জেলা ও উপজেলায় ন্যূনতম ১০ শতাংশ জমি থাকার সুপারিশ ছিল। শর্তসাপেক্ষে ভাড়া করা ভবনেও প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অনুমতি ছিল। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে এটি বাস্তবায়ন করা যায়নি। বাংলাদেশ শিক্ষা, তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো মনে করে, কিন্ডারগার্টেন সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তারা নিজেদের মতো করে চলে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষাবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মোতাহের হোসেন একটি দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেন, কিন্ডারগার্টেনগুলোকে নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে।
আধুনিক মানসম্মত শিক্ষার নামে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ চলতে দেয়া যায় না। এসব স্কুলে মুখস্থবিদ্যার মাধ্যমে নম্বরের প্রতিযোগিতা চলে। ফলে যে উদ্দেশ্যে জার্মান শিক্ষাবিদ ফ্লোয়েবল কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা পদ্ধতি চালু করেছিলেন, তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও আনন্দদায়ক উপায়ে শিশুশিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। কিন্ডারগার্টেনগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হলে আমাদের ভবিষ্যৎ খুবই অন্ধকার। সেক্ষেত্রে বিকলাঙ্গ প্রজšে§র দায়ভার বহন করতে হবে আমাদেরই। তাই কিন্ডারগার্টেন নিয়ে এখনই ভাবা উচিত জরুরিভাবে।
মমিনুল ইসলাম মোল্লা : কলেজ শিক্ষক













 



  

   

 



 
  


 



 
  

 



 
  


শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.