যাকাত ব্যবসায়ীদের সম্পদকে পবিত্র করে

 যাকাত ব্যবসায়ীদের সম্পদকে পবিত্র করে

মমিনুল ইসলাম মোল্লা   

যাকাত শব্দের অর্থ হলো পবিত্র হওয়া, মর্যাদা পাওয়া, বৃদ্ধি পাওয়া, বরকতময় হওয়া ইত্যাদি।  আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে নিদিষ্ট শর্তের ভিত্তিতে নিসাব পরিমান সম্পদ থেকে যে নির্র্দির্ষ্টি পরিমান ফরয সম্পদ নির্ধারিত হকদারদের মধ্যে বিনামূল্যেও বিতরন করা হয় তা ই যাকাত। পন্য নগদ অর্থে ক্রয় বা ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে ক্রয় করা হয় তাহলেও তা যাকাত যোগ্য সম্পদ বলে গন্য হবে। এ ধরণের পন্য বিক্রয়ের মাধ্যমে লাভের নিয়ত থাকতে হবে। স্থানীয় বাজার থেকে সংগ্রহ করে লাভের উদ্দেশ্যে নিজ দায়িত্বে এনে যা বিক্রয় করা হয়, অথবা যেসব সম্পদ বিদেশ থেকে অমদানি বা বিদেশে রপ্তানি বা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা হয় তা-ই ব্যবসায়িক সম্পদ নামে পরিচিত। যেমন বিক্রির উদ্দেশ্যে কেনা জায়গা –জমি , ঘর-বাড়ি খাদ্যদ্রব্য কৃষিপণ্য গৃহপালিত প্রাণী ইত্যাদি। ব্যক্তিগতভাবে যেগুলো ব্যবহার করা হয় যেমন বসবাসের যায়গা , ঘর-বাড়ি, ব্যবসায় ব্যবহৃত মূল জিনিসপত্র, যন্ত্রপাতি, ফ্যক্টরীর ভবন, দোকানপাটের জায়গা, গাড়ি, খাদ্যদ্রব্য শোরুমে ব্যবহৃত চেয়ার, টেবিল, ইত্যাদি তার ব্যক্তিগত সম্পদ। এগুলোর উপর যাকাত  ধরা যাবে না। আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন বলেছেন- হে মুমিনগন তোমরা ব্যয় কর উত্তম বস্তু তোমরা যা অর্জন করেছে এবং আমি যমিন থেকে তোমাদের জন্য যা উৎপন্ন করেছি তা থেকে। (বাকারা ২/২৬৭) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুজাহিদ রহঃ বলেছেন, ( তোমরা ব্যবসা –- বাণিজ্য করে যা অর্জন করেছ। ( তাফসিরে তাবারী )। আবু দাউদ শরিফে বর্ণনা করা হয়েছে- ব্যবসায়ের জন্য প্রস্তুতকৃত সম্পদ থেকে রাসুল্লাহ (সাঃ) আমাদেরকে যাকাত আদায় করতে নির্দেশ দিতেন   ( সনদ যয়ীফ, আলবানী) । ব্যবসায়িক পন্যে যাকাত ফরয হওয়ার ব্যাপারে ফোকাহবিদদের মধ্যে ঐক্য রয়েছে। এ ব্যাপারে কোন ইজতেহাদ নেই। আাল্লাহ পাক রাব্বুল অঅলামিন মুসলমানদের জন্য ব্যবসা হালাল করেছেন। এ ব্যবসাা করতে গিয়ে মুসলমানগণ ইসলামী বিধি বিধান মেনে চলেন। এর  বিপরীত কাজ করলে মৌলিকভাবে হারাম নয় এমন ব্যবসাও হারাম হয়ে যেতে পারে। তাই ব্যবসায়ীদের উচিত আমানতদারী ও সততা রক্ষা করা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, “ আল্লাহ বৈধ করেছেন ব্যবসা- বাণিজ্য অথচ নিষিদ্ধ করেছেন সুদখুরি। ( বাকারা ২৭৫)আল্লাহ হালাল ব্যবসায় যাকাত ফরয করেছেন। এর মাধ্যমে বান্দার মাল পবিত্র হয়। সম্পদের যাকাত দেয়া ধনী মুসলমানের জন্য বাধ্যতামূলক। কোন মুসলমান বিত্তশালী হলে সে ইচ্ছা করলেই যাকাত দেয়া থেকে বিরত থাকতে পারে না। রাসুলে আকরাম (সাঃ) মুয়ায ইবনু জাবাল (রাঃ) কে ইয়েমেনে পাঠালেন এবং বল্লেন, তারা যদি দিন রাত্রে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতকে মেনে নেয় তাহলে তাদের জানিয়ে দাও আল্লাহ তোমাদের সম্পদের উপর নির্দিষ্ট পরিমানে  যাকাত ফরয করেছেন। যা দারিদ্রের মাঝে বন্টন করা হবে ( বোখারি)। সাধারণভাবে সম্পদ বলতে কি বুঝায় ?  শরিয়ত মোতাবেক সম্পদের মধ্যে অনেক কিছুই পড়ে। জমি, গৃহপালিত পশু , ও ব্যবসায়ের মালও সম্পদ।তাই নিসাব পূর্ণ হলে তা যাকাতমুক্ত রাখার কোন ব্যবস্থা নেই। ইবনু ওমার (রাঃ) বলেন, সম্পদের যাকাত নেই। কেবল ব্যবসায়িক সম্পদ ব্যাতীত ( বায়হাকী)। দোকানের স্থায়ী সম্পদ যাকাতমুক্ত,  বিক্রয় হবেনা এমন কোন জিনিস দোকানে থাকলে এগুলোর মূল্য যাকাত হিসেব করার সময় ধরতে হবে না। যেমন বর্তমানে অধিকাংশ খাদ্য ও পানীয় বিক্রির দোকানে ফ্রিজ রয়েছে। এছাড়াও দোকান সাজাতে আলমারি, সেল্ফ ইত্যাদিও প্রয়োজন।এগুলোর যাকাত দিতে হবে না। 

কত টাকা ব্যবসায় খাটালে যাকাত দিতে হবে তাও শরিয়তে বলা হয়েছে। ্ওমর ইবনু আব্দুল আযিয (রহঃ) তার কর্মচারীরুযাইক ইবনু হুকাইমকে  লিখে পাঠিয়েছিলেন যে, তোমার সামনে যে মুসলমানই আসবে তার ব্যবসায় ব্যবহৃত সব প্রকাশমান সম্পদ থেকে প্রতি চল্লিশ দীনারে এক দিনার যাকাত গ্রহণ কর ( মুয়াত্তা মালেক)। ৮৫ গ্রাম স্বর্ণ অথবা ৫৯৫ গ্রাম রৌপ্যের বাজার মূল্যের সমান অর্থের ব্যবসায়িক পুজি এক বছর খাটতে হবে। এর চেয়ে কম খাটলে যাকাত দিতে হবে না। নিসাব পূর্ণ হলেই শতকরা ২.৫০ টাকা হারে যাকাত আদায় করতে হবে। ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে এমন সকল সম্পদে যাকাত ফরয। এসব পন্য ফ্যাক্টরীর মালিক অথবা ব্যবসায়ী পন্যটি ক্রয় করার সময়ই ব্যবসার উদ্দেশ্যে ক্রয় করেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে পন্যসামগ্রী, আসভাবপত্র ,যন্ত্রপাতি, গাড়ি, জায়গাজমি, ইত্যাদি। এগুলো এক বছর পূর্ণ হলেই তার উপর যাকাত ফরয হবে। ইসলামিক চিন্তাবিদদের মতে ব্যবসায়িক পন্যগুলোর মূল্য নির্ধারণ করবে। এ অর্থ নগদ অর্থের সাথে একত্রিত করবে। উক্ত নগদ অর্থ ব্যবসায়ে বিনিয়োগ না করলেও হিসেবে আনতে হবে। এ অর্থের সাথে কাাউকে দেয়া অর্থযা সহজে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তা যোগ করা হবে। ব্যবসায়ী কারো কাছে ঋণী থাকলে তা বাদ দিবে।  অতঃপর অবশিষ্ট অর্থ নিসাব পরিমান ও এক বছর অতিবাহিত হলে ২.৫% হারে যাকাত আদায় করতে হবে। উদাহরণস্বরুপ বলা যায় কুমিল্লার কোন এক কাপড় ব্যাবসায়ীর ব্যবসায়িক পণ্য হিসাবে থান কাপড় রয়েছে। যার বাজারদর ৫ লাখ টাকা, নগদ অর্থ ৫ লাখ টাকা সর্বমোট ১২ লাখ টাকা, আদায়যোগ্য বাকী রয়েছে ২ লাখ টাকা সর্বমোট ১২ লাখ টাকা, ঢাকার ব্যবসায়ীর কাছে তার ঋণ রয়েছে ৪ লক্ষ টাকা। এ টাকা বাদ দিলে থাকে ৮ লাখ টাকা। সুতরাং বছর শেষে তার যাকাত আসবে শতকরা আড়াই ভাগ হিসাবে ২০ হাজার টাকা । এ টাকা যথাযথভাবে প্রদান করলে তার মাল পবিত্ররুপে গন্য হবে। ইসলামি নিয়ম অনুযায়ি মাল দু প্রকার। যে সম্পদ অর্জন করা অথবা যে সম্পদ থেকে উপকার লাভ শরীয়তে নিষিদ্ধ তাই হারাম মাল। যেমন- মদের ব্যবসা থেকে প্রাপ্ত অর্থ , চুরিকৃত সম্পদ, শুকরের ব্যবসা, অথবা অন্য কোন কারণে হারাম হয়ে যাওয়া সমম্পদ আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। যাকাত দিলেও তা পবিত্র হয় না। হারাম মাল সব সময়ই হারাম। এ থেকে যাকাত দিলেও তা গ্রহণযোগ্য হবে না। সাদকা কবুল হওয়ার জন্য জরুরী হল যে, তা অনুগ্রহ প্রকাশ , কষ্ট দেওয়া এবং কপটতা থেকে পাক হতে হবে। হালাল ও পবিত্র উপার্জন থেকে সাদকা দিতে হবে। তাই অবেধ ব্যবসা থেকে আল্লাহর রাস্তায় দিতে হবে। আল্লাহ মন্দ জিনিস দান করতে নিষেধ করেছেন। 

আমাদের সম্পদে গরীব মিসকিনদের হক রয়েছে। এ হক দুভাবে আদায় করা হয়। একটি হচ্ছে নফল দানের মাধ্যমে। অন্যটি যাকাতের মাধ্যমে। আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন বলেন- -আর তাদের ধন-সম্পদে রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের হক ( যারিয়াত৫১/১৯) । যাকাতকে কোন আয়াতে ছাদাকা হিসাবে ও উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও অর্থ প্রদান না করেও কিছু কিছু ছাদকা প্রদান করা যায়। যাকাত আদায় কারীরা মুসলমানদের নিকট থেকে ছাদকা গ্রহণ করবেন। এর দ্বারা তুমি তাদেরকে পবিত্র করবে এবং কিছু কিছু পণ্য আছে যেগুলো থেকে সরাসরি যাকাত দেয়া যায়। ব্যবসায়িক পণ্যের মূল্য নির্ধারন করে যাকাত দেয়া উত্তম। কেননা উমার ইবন খাত্তাব (রাঃ)  থেকে বর্ণিত। তিনি হিমাস (রাঃ) কে বলেছেন, - হে হিমাস, তুমি তোমার সম্পদের যাকাত আদায় করো। তখন হিমাস (রহঃ) বল্লেন- আমার তো তেমন কোন সম্পদ নেই। আমি তূন  ( তীর রাখার থলে) ও চামড়া বিক্রি করি। উমার (রাঃ)  বল্লেন, তুমি এর মূল্য নির্ধারণ করে যাকাত দাও। ( মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক) এছাড়া পন্যের মূল্য দ্বারা যাকাত আদায় করলে সাহায্যপ্রাপ্ত ব্যক্তি তার বিভিন্ন প্রয়োজন মেটোতে পারবে।বর্তমানে দোকান ভাড়া নেয়ার সময় সিকিউরিটি মানি দিতে হয়। ধরা গেল,  রফিক সাহেব দোকান ভাড়া নেয়ার সময় কাদের সাহেবকে সিকিউরিটি মানি ৫ লাখ টাকা দিল। এ ক্ষেত্রে যাকাতের বিধান হলো ভাড়াটিয়াকে এ অর্থের যাকাত দিতে হবে না। কেননা এতে পূর্ণ মালিকানা প্রতিষ্ঠিত নয়। তবে নির্দিষ্ট সময়ের পর তা ফেরৎ পেলে যাকাত দিতে হবে। যাকাত দিলে সম্পদ বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন বলেন, আর তোমরা যে সুদ দিয়ে থাক, মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য তা মূলত আল্লাহর কাছে বৃদ্ধি পায় না। আর তোমরা যে যাকাত দিয়ে থাক আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে ( তাই বৃদ্ধি পায়) এবং তারাই বহুগুন সম্পদপ্রাপ্ত। ( সুরা রুম – -৩৯) আমাদের দেশে কাপড় বা পোশাক দিয়ে যাকাত আদায়ের সিস্টেম চালু রয়েছে । অধিকাংশ ক্ষেত্রে নি¤œ মানের পোশাক তাদেরকে দেয়া হয়। খারাপ জিনিস আল্লাহর রাস্তায় দেয়া নিষেধ। মদীনার কোন কোন আনসারী সাহাবী খারাপ হয়ে যাওয়া নি¤œমানের খেজুর সাদকা হিসাবে দিলে এ ব্যাপারে কোরানের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। যাকাত দিলে ধন-সম্পদ এ বরকত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য উন্নত হয়। তবে এটিা অনক সময় আমরা বুঝতে পারি না। প্রথমত দাতার ধনে এক প্রকার আধ্মাতিক বৃদ্ধি লাভ হয়। এ কথার অর্থ হলো অবশিষ্ট ধন-সম্পদে আল্লাহর পক্ষ থেকে বরকত দেয়া হয়। অন্যদিকে কেয়ামতের দিন তা উহুদ পাহাড়ের মত বৃদ্ধি করে বান্দাকে দেয়া হবে ( মুসলিম)। যাকাত ৮ শ্রেণির ব্যক্তিকে দেয়া যায়। তবে যারা মুখ খুলে অভাবের কথা বলতে পারে না তাদেরকে দিলে পুন্য বেশি পাওয়া যাবে। লেখকঃ মমিনুল ইসলাম মোল্লা,   প্রভাষক , সাংবাদিক ও  গবেষক, কুমিল্লা। ০১৭১১৭১৩২৫৭   সধসরহসড়ষষধয@ুধযড়ড়.পড়স



শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.