আত্মনিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের আবেগ আমাদের ব্যক্তিত্বের অংশ। আমরা যদি আবেগ লাগামহীনভাবে প্রকাশ করতে থাকি এবং এর ফলে অন্যকে বিব্রত হতে হয় তাহলে সেটা আমাদের ব্যক্তিত্বের উপরেই প্রভাব ফেলে। অন্যের কাছে আমাদের খারাপ ইম্প্রেশন তৈরি করে। তাই রাগ হোক বা দুঃখ অথবা হোক আনন্দ প্রকাশ; হওয়া চাই নিয়ন্ত্রিত।
চলুন জেনে নেয়া যাক আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমরা কি কি সুবিধা লাভ করতে পারি—
এটি আপনাকে আরও কার্যকরভাবে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে দেয়।
যেকোনো পরিস্থিতিতে শান্ত থেকে সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে।
চিন্তার বৃহত্তর স্বচ্ছতা রাখতে সহায়তা করে।
পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটায়।
আপনি যখন অতিরিক্ত চাপের মাঝে থাকেন তখন নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে আপনার কাজ বিঘ্নিত হবে না। আপনি সঠিকভাবে কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারবেন। মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত হবেন না।
আরও ভাল সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে।
এটি মনোনিবেশ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
এটি আপনার আত্মসম্মান বজায় রেখে চলতে সাহায্য করে।
নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে চাইলে ব্যস্ত মানুষে পরিণত হতে হবে। কারণ এই মানসিকতা আত্মমর্যাদা বাড়াবে। আর এই আত্মমর্যাদাই বাড়াবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা।
ফ্রান্সে অবস্থিত ইউরোপিয়ান ইন্সটিটিউট অফ বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অধ্যাপক অমিতাভ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “প্রতিদিন আমরা এমন কিছু সিদ্ধান্ত নেই যেখানে আমাদের এই মুহূর্তে ভালো থাকা এবং ভবিষ্যতে ভালো থাকা এই দুইয়ের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হয়।”
“আমরা যদি নিজেকে ব্যস্ত মনে করি, তাহলে সেটা আমাদের আত্মমর্যাদা বাড়ায়। ফলে আমাদের আদর্শ সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়,” বললেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, “অপরদিকে কিছু মানুষ সময়ানুবর্তীতার চাপে পড়লে অস্বস্তি অনুভব করেন এবং আদর্শ সিদ্ধান্ত থেকে দূরে সরে যান।”
এই বিষয়ের ওপর করা গবেষণাটি প্রকাশিত হয় ‘জার্নাল অফ কনজ্যুমার রিসার্চ’য়ে।
গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের খাবার, শরীরচর্চা এবং অবসর জীবনের জন্য সঞ্চয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়, যেটার উদ্দেশ্য ছিল তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের মাত্রা পরিমাপ করা।
দেখা যায়, যেসব অংশগ্রহণকারীকে প্রতিদিনের ব্যস্ত জীবনধারার কথা মনে করানো হয়েছে তারা অন্যদের তুলনায় ধারাবাহিকভাবে ভবিষ্যতের জন্য ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গবেষকরা বলেন, “এই গবেষণা প্রমাণ করে যে, নিজের কাছে নিজের গুরুত্ব বেশি থাকাটাই আত্মনিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর মূলমন্ত্র।”
চট্টোপাধ্যায় বলেন, “যখনই আমরা অংশগ্রহণকারীদের চোখে তাদের নিজের গুরুত্বকে তুচ্ছ করে তুলেছি তখনই তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ উবে গেছে।”
অর্থাৎ আত্মনিয়ন্ত্রণ মানবজীবনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই সফল হতে চাইলে আমাদের উচিত নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে শেখা৷ আজকে আমরা জানবো, আত্মনিয়ন্ত্রণ কিভাবে অর্জন করা যায়। চলুন কিছু কৌশল সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক:
১. সঠিক লক্ষ্য স্থির করা
প্রত্যেকটি মানুষের জীবনেই কিছু না কিছু লক্ষ্য থাকে। তবে সঠিক লক্ষ্য স্থির করা খুব একটা সহজও নয়। এ ধাপেই বেশিরভাগ মানুষ ভুল করে বসে। অনেক ভেবেচিন্তে এই লক্ষ্য স্থির করা উচিত। অন্য মানুষের চোখে ভালো হওয়ার জন্য যদি তাদের পছন্দমত লক্ষ্য ঠিক করেন – তবে একটা সময়ে গিয়ে হয়তো আফসোস করবেন। অন্যের ঠিক করে দেয়া লক্ষ্য কখনওই একজন মানুষের সত্যিকার লক্ষ্য হতে পারে না।
অনেক মানুষ আছেন যাঁরা বেশিরভাগ মানুষ যা করছে – সেটাকেই নিজের লক্ষ্য বানিয়ে ফেলে। এরা যদি দেখেন আশপাশের সবাই বিসিএস দিচ্ছে, তাহলে তাঁরাও তাই করবেন। যদি দেখেন বন্ধুবান্ধবের বেশিরভাগ ডাক্তারী পড়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে – তবে তাঁরাও তাই করেন। এঁরা কখনওই নিজের ট্যালেন্ট ও সত্যিকার ইচ্ছা খুঁজে দেখতে যান না। অনেকটা হুজুগে মাতাল! এতে করে মানুষ তার ভেতরের সত্যিকারের সুপ্ত প্রতিভার দেখা পায় না।
জীবনের লক্ষ্য ঠিক করার সময়ে নিজেকে প্রশ্ন করুন, “কোন জিনিসটা আমি সবচেয়ে ভালো পারি?”, “কোন কাজটা না করতে পারলে আমার জীবন অপূর্ণ থেকে যাবে?”, “আমার মৃত্যুর পর কি হিসেবে মানুষ আমাকে মনে রাখলে আমি সবচেয়ে খুশী হব?”, “আমি আমার আশপাশের মানুষের জন্য কি করতে চাই?”, “আমার অর্জিত অর্থ বিত্ত দিয়ে আমি কি করতে চাই?”
গভীর ভাবে এবং গুরুত্বের সাথে এইসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করুন। এই ধরনের চিন্তা মানুষকে অন্যদের দিকে তাকিয়ে নিজের লক্ষ্য ঠিক করা থেকে বিরত রাখে, এবং তার সত্যিকার লক্ষ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করে।
২.লক্ষ্যকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করুন:
লক্ষ্য যখন স্থির তখন আপনার কাজ হলো সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে যাওয়া। সময় নিয়ে একটি লক্ষ্যকে ছোট ছোট কাজে ও রুটিনে ভাগ করা বেশ সময় সাপেক্ষ ও কষ্টকর বিষয়। কিন্তু এটা একবার করে ফেললে পুরো প্রক্রিয়াটি স্পষ্ট হয়ে আপনার সামনে ধরা দেবে। আর যখন একবার সময় ও শ্রম দিয়ে পরিকল্পনা বানিয়ে ফেলবেন, তখন কাজ করার জন্য এমনিতেই ভেতর থেকে তাগিদ আসবে। প্রতিদিনই কিছু না কিছু করার থাকবে, এবং আপনি তা করতে চাইবেন। লক্ষ্য পূরণের পথে যদি অন্য কোনও প্রলোভনও আসে – নিজেকে অনেক সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।
৩. গুরুত্ব অনুযায়ী কাজের বিন্যাস করুন
আপনার কাজগুলোকে ভাগ করার পর সেগুলো সম্পাদন করার ক্ষেত্রে কৌশলী হোন। যেসকল কাজ বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেগুলোকে আগে রাখুন অর্থাৎ অগ্রাধিকার দিয়ে আপনার রুটিন সাজান। দিনের শুরুতে যখন আপনি কাজ করতে শুরু করেন তখন আপনার মনোযোগ ও দৃঢ়তা থাকে সবচেয়ে বেশি। তাই গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো তখন সমাধা করে ফেললে আপনি চিন্তামুক্ত থাকবেন।
পাশাপাশি সামনে যখন দিনের কাজের একটি নির্দিষ্ট ছক থাকবে – তখন আপনি অন্য কোনও বিষয় সামনে আসলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবেন। অন্য দিকে মনোযোগ গেলেও আপনার মনে হবে যে একটা দিন পিছিয়ে যাচ্ছেন। এটা আপনাকে অন্য বিষয় থেকে মনোযোগ সরিয়ে সত্যিকার কাজে মনোযোগী হতে সাহায্য করবে।
৪.সংবেদনশীল হোন
ডেনিয়েল গোলম্যান দ্বারা জনপ্রিয় একটি ধারণা ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স (EI) হ’ল নিজের এবং অন্যের অনুভূতিগুলির চিহ্নিতকরণ, বুঝা এবং নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা। সংবেদনশীল বুদ্ধিমান লোকেরা যে দক্ষতা অর্জন করে তার মধ্যে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অন্যতম। তবে এই জাতীয় বুদ্ধি তৈরির অন্যান্য উপাদানগুলিকে আয়ত্ত করা ছাড়া এটি বোঝা যায় না, উদাহরণস্বরূপ, স্ব-জ্ঞান বা সহানুভূতি। সংবেদনশীল বুদ্ধি দক্ষতা শেখা এবং অর্জন আপনাকে বৃহত্তর স্ব-নিয়ন্ত্রণের ব্যক্তি হিসাবে গড়ে তোলে।
৫. পরিবেশ পরিবর্তন করুন
যেসকল পরিবেশে আপনি আপনার আবেগ দমন করতে পারবেন না, যা আপনার এগিয়ে চলার পথে অন্তরায়, আপনার লক্ষ্য অর্জনে বাঁধার সৃষ্টি করে সেসকল পরিবেশ থেকে দূরত্ব বজায় রাখাই বুদ্ধিমানের লক্ষ্মণ। আপনার নাগালের মাঝে নেতিবাচক উদ্দীপনা থাকা আপনার আত্ম-নিয়ন্ত্রণের জন্য ভালো নয়। তাই আপনি যে পরিবেশকে আপনার এগিয়ে চলার পথে সহায়ক মনে করেন আপনার আশেপাশে সেই পরিবেশ সৃষ্টি করার বা সেইরকম পরিবেশে নিজেকে রাখার চেষ্টা করুন।
৬. বড় আকৃতির ছবি দেখুন
গবেষণায় দেখা গেছে বিমূর্ত বা বৈশ্বিক বা উচ্চ চিন্তার ছবি মানুষের মাঝে আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বাড়ায়। তাই বড় আকৃতির ছবি দেখুন, খুটিয়ে খুটিয়ে দেখুন। অবশ্য এটি আমরা অবচেতনমনে প্রায়ই করি। নিজের মনোযোগ সরাতে আমরা দেয়ালের ছবি বিশ্লেষন করতে শুরু করি।
৭.পর্যাপ্ত ঘুম
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ঘুমের অভাব মানুষকে অস্থির করে তোলে। মেজাজ খিটখিটে থাকে। তখন পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনা করতে ইচ্ছা করে না। রেগে গেলে আমরা চট করে রাগ প্রকাশ করে ফেলি। তাই পর্যাপ্ত ঘুমান। প্রতিদিন ৬-৮ ঘণ্টা ঘুমান। আপনার শরীরও ভাল থাকবে একই সাথে ভাল থাকবে মন-মেজাজ। নিয়ন্ত্রণ থাকবে আপনার হাতে। কাজকর্মেও স্বতঃস্ফূর্ততা আসবে।
৮.মেডিটেশন
বিভিন্ন ধরনের মেডিটেশন রয়েছে। তার আবার আছে বিভিন্ন মাত্রা। আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ মেডিটেশন সেশনটি শুরু করতে পারেন। এতে আপনার মন একাগ্র হবে। নিজের আনন্দ, দুঃখ, রাগসহ সকল আবেগ নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ধ্যানের নিয়মিত চর্চা এক সময় আপনাকে এমন একজন মানুষে পরিণত করবে যার ভেতরে থাকবে শান্তি। বাইরের পরিবেশ তাকে চাইলেও প্রভাবিত করতে পারবে না। এছাড়াও নিয়মিত মেডিটেশন আপনার মেন্টাল হেলথকে সুস্থ ও সুন্দর রাখবে।
নিয়ন্ত্রিত হওয়ার অর্থ আপনি সামাজিক পরিস্থিতিতে ভারসাম্যপূর্ণ এবং মার্জিত। আপনি যদি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান তবে আপনার আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে হবে, একজন ভাল যোগাযোগকারী হতে হবে এবং কীভাবে কঠিন পরিস্থিতিতে শান্ত থাকতে হয় তা শিখতে হবে। আশা করি উপরোক্ত কৌশলগুলো আপনাদের আত্ম – নিয়ন্ত্রণ দক্ষতা বৃদ্ধি করতে সহায়ক হবে।