মায়ের ভালোবাসা চির অম্লান

 এ ক টি  অ প্র কা শি ত  লে খা

আম্মার প্রস্থান

আমার একটা ধারনা ছিল আম্মা আরও অনেক দিন বাঁচবেন। আমার বিশ্বাস ছিল, যে ওষুধগুলি তিনি নিয়মিত খেতেন সেগুলির কল্যানে আল্লাহপাক তাঁকে আরও অনেক দিন বাঁচিয়ে রাখবেন। মার্কিন নাগরিক ও সিনিয়র সিটিজেন হিসাবে যে সব চিকিৎসা সেবা তিনি পাচ্ছিলেন তাতে আমার বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়েছিল। তবে আমার বিশ্বাস বা ধারনা মতো তো আর দুনিয়া চলবে না।

আম্মার মৃত্যুতে আমি দুঃখিত ছিলাম না, তবে ছিলাম প্রচন্ড শোকাহত। ‘আমি দুঃখিত ছিলাম না’ কথাটা শুনতে অনেকেরই একটু খটকা লাগতে পারে, তবে কথাটা সত্য। আমি দুঃখিত হলে স্বয়ং আল্লাহপাক আমার উপর নারাজ হবেন বলে আমি মনে করি। কারণ তিনি আম্মার কোন শখ, আহলাদ, চাওয়া পাওয়া, ইচ্ছা, আগ্রহ কোনটাই অপূর্ণ রাখেন নাই। শেষ জীবনে আম্মা যা চেয়েছেন আল্লাহপাক তাঁকে তাই দিয়েছেন। এমন ভাগ্যবান মা এ ধরনীতে কয়জন আছেন? এ জন্যই বলি আম্মার মৃত্যুতে আমি দুঃখিত না, শোকাহত।

শেষ দিকে ৭৮ বছরের আম্মা, ২/৩ বছরের একটা শিশুর মত হয়ে গিয়েছিলেন। খাবার পছন্দ না হলে গাল ফুলিয়ে বসে থাকতেন, যেটা তাঁর খাওয়া নিষেধ সেটা বেশি বেশি খেতে চাইতেন, আমার সেন্ডেল পায়ে দিয়ে ঘুরতেন, মাঝে মাঝে নিজেই কাঁচি দিয়ে নিজের চুল কেটে ফেলতেন। 

ডাক্তার তাঁকে বলেছেন প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমান হাঁটতে ও নির্দ্ধারিত কিছু ব্যয়াম করতে, কিন্তু কিছুতেই তিনি তা করবেন না। অবশেষে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে লোক বাসায় এসে আম্মাকে সপ্তাহে তিন দিন ব্যয়াম করিয়ে যেতো।

২২ জুন ২০২১ মঙ্গলবার, সকালে নাস্তা খাওয়ার জন্য এসে আম্মা চেয়ারে বসতে গিয়ে অসাবধানতা বশতঃ মাটিতে পরে যান। এ ভাবে তিনি প্রায়ই পরে যেতেন, বিষয়টা আমাদের কাছে এক প্রকার স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। মজার ব্যপার হলো, পরে গিয়ে কখনই তিনি শরীরের কোথাও কোন ব্যথা পেতেন না। আম্মাকে আমি বা শাহানা উঠাতে পারতাম না। ছেলেরা এসে পেছন থেকে দুই বাহুর নীচে হাত দিয়ে উঠাতো, আজ উঠিয়েছে বড় ছেলে জাহিন। নাস্তা খেতে বসে তিনি পুরো নাস্তা খেলেন না। সমান্য একটু খেয়েই উঠে গিয়ে সোফায় বসলেন। 

ঐ দিন ছিল আম্মার ব্যায়াম করার দিন। কিছুক্ষনের মধ্যে ফিজিও থেরাপিস্ট এন্থোনি এলেন, মেঝো ছেলে রাশিক ও এন্থোনি মিলে আম্মাকে সোফা থেকে উঠিয়ে ব্যায়ামের চেয়ারে বসায়। চেয়ারে বসেই তিনি তাঁর মাথাটি রাশিকের শরীরে হেলিয়ে দেন। এন্থোনি বুঝতে পারেন আজ আম্মার শারিরিক অবস্থা ভাল না। তিনি প্রেসার মেপে দেখেন, অনেক বেশি। এরই মধ্যে আম্মা একবার বমিও করে ফেলেন। এন্থোনি সাথে সাথে ফোন করে বিষয়টি তার অফিসকে জানায়। সেখান থেকে বলা হয় দ্রুত রোগিকে হাসপাতালে স্থানান্তর করতে। এন্থোনিই ফোন করে এম্বুলেন্স আনিয়ে অচেতন অবস্থায় আম্মাকে স্থানীয় হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। রাশিক আম্মার সাথে এম্বুলেন্সে উঠে যায়, আমি এন্থোনিকে বিদায় জানিয়ে এম্বুলেন্সের পেছনে ছুটলাম। হাসপাতালে যেতে যেতেই আপা ও টুক্কুকে বিষয়টি জানালাম। তারা উভয়েই যার যার কাজে। আমি পৌছার দশ মিনিটের মধ্যে আপাও হাসপাতালে পৌছে। সেখানে আম্মার সিটি স্ক্যান করে দেখা যায় রোগির মস্তিস্কে রক্তক্ষরন হয়েছে। 

এ হাসপাতাল থেকে আমাদের বলা হয় রোগির অপারেশন করাতে হবে। জার্জি শোর মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে তা করা হবে। আমাদের বলা হলো আমরা যেন সেখানে চলে যাই। তখনই অপারেশনের জন্য আম্মাকে এখান থেকে জার্জি শোর মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়।যেটা এখান থেকে ৩০ মিনিটের দুরত্বে। টুক্কুকে বলে দিলাম এখানে না এসে সরাসরি জার্জি শোর চলে যেতে। আপা তার গাড়ি নিয়ে আর রাশিক আমার সাথে রওয়ানা দিলো জার্জি শোর হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। পথেই মনিকে বিস্তারিত জানালাম। কিছুক্ষন পর মনি জানালো আজকের কোন ফ্লাইটেরই টিকেট সে পাচ্ছে না। কাল সকালে আসবে। 

২২ জুন বিকালে জার্জি শোর হাসপাতালের নিউরো সার্জন আম্মার সিটি স্ক্যানের ছবিগুলি আমাদের দেখিয়ে এ ভাবে বিস্তারিত বুঝিয়ে বলেন- আপনারা বললে আমি অস্ত্রোপচার করে মরা রক্তগুলি সরিয়ে দিতে পারি। এতে রোগী বেঁচে যাবেন, তবে সে বাঁচা হবে সম্পূর্ণ বিছানায় শুয়ে। অপারেশন না করলে তিনি শান্তিতে চীর নিদ্রায় চলে যাবেন। এখন আপনাদের সিদ্ধান্তমত আমি কাজ করবো। এ কথা শুনে সবাই কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলাম। ডাক্তারকে বললাম- আমাদের এক বোন আসবে কাল সকালে, সে এলে আমরা সিদ্ধান্ত জানাবো।

সকালে মনি এলো, কারো মুখেই কোন কথা নাই। কেউ সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না ডাক্তারকে কি বলবো। এদিকে আম্মা আইসিইউতে অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছেন। নাকে মুখে বিভিন্ন নল, হাতে সেলাইন লাগানো। আমরা প্রায় ১৫ জন লোক আম্মার আশেপাশে এবং হাসপাতালে ঘোরাঘুরি করছি। আম্মা আইসিইউতে নিথর শুয়ে আছেন আমরা এক এক করে গিয়ে তাকে দেখে, ছুঁয়ে আসছি। আমরা লোক বেশি বলে হাসপাতাল থেকে একান্ত আমাদের বসা ও অপেক্ষা করার জন্য একটা বড় রুম খুলে দেয়া হয়েছে। এ রুমটি পাওয়ার ব্যাপারে সহযোগিতা করেছেন আমাদের পরিচিত বন্ধু শামসুদ্দিন ভাইয়ের স্ত্রী শিরিন ভাবী। তিনি এ হাসপাতালে চাকুরি করেন। ভাবী আমাদের শুধু বড় রুমটির ব্যবস্থাই করে দেন নাই, উপরন্ত প্রতিদিন বাসা থেকে আমাদের সবার জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে আসতেন।

২৩ জুন দুপুরে একজন সিনিয়র নার্স এসে আমাদের সাথে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করে, আমরা কি সিদ্ধান্ত নিলাম জানতে চাইলেন। তিনি পুরো বিষয়টি আমাদের আবারও বুঝিয়ে বললেন। তিনি জানান আমরা অস্ত্রপচারে রাজি না হলে তারা আম্মার লাইফ সাপোর্র্টিং যন্ত্রপাতিগুলি খুলে আইসিইউ থেকে তাঁকে হসপিস বিভাগে পাঠিয়ে দিবেন। এ জন্য হাসপাতালকে লিখিত ভাবে আমাদের সম্মতি জানাতে হবে। আম্মার বড় সন্তান হিসাবে আমাদের পক্ষ থেকে আপা স্বাক্ষর করে দেয়ার পর সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি। হসপিস বিভাগে রোগির সাথে শুধু সেলাইন সংযোগটি থাকবে। নার্সরা বললেন হসপিসে কোন কোন রোগি দুই ঘন্টা আবার কেউ কেউ দুই দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকেন। আমরা বুঝে গেলাম অলৌকিক কিছু না হলে আম্মা সর্বোচ্চ আর দুই দিন আছেন এ ধরনীতে। 

আম্মা সবসময়ই বলতেন- আমি চাই মৃত্যুর সময় আমার চার সন্তানই যেন আমার পাশে থাকে। আল্লাহপাক তাঁর এ চাওয়া এমনভাবে পুরন করেছেন যে, শুধু চার সন্তানই না, জামাতাগন এবং সব নাতি নাতনিরাও তাঁর মৃত্যু মুহুর্তে পাশে ছিলেন।

পৃথিবীর কোন সন্তানই তাদের মায়ের মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকে না। কিন্তু অসহায় আমরা আমাদের অচেতন মায়ের মুখের দিকে চেয়ে আছি কখন তাঁর নিঃশ্বাস নেয়া শেষ হয়, কখন তিনি তাঁর অনন্ত অশেষ জীবনের যাত্রা শুরু করেন। ২০২১ সালের ২৩, ২৪, ২৫ জুন ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে কঠিন, সবচেয়ে নিষ্ঠুর তিনটি দিন।                              

নার্সদের কথা সত্যি প্রমান করে হসপিস বিভাগে দুই দিন থেকে তৃতীয় দিন ২৫ জুন ২০২১ শুক্রবার বেলা ১২টায় আম্মা একটা মুচকি হাসি দিয়ে নিঃশ্বাস নেয়া বন্ধ করে দিলেন। ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন।

বাকীন রাব্বী


শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.