দেবীদ্বারের পটভূমি ও যে সব গুণীজনের আলোয় আলোকিত দেবীদ্বার
============================================
এবিএম আতিকুর রহমান বাশার
(বিশেষ দ্রষ্টব্য : এ ইতিহাস ঐতিহ্য ও আলোকিত গুণীজনদের তালিকা সংশোধন, পরিবর্ধন ও সংকোচন যোগ্য। তা হবে গ্রহন যোগ্য তথ্যপ্রমানের ভিত্তিতে। ঘটনা বা তালিকার বাহিরে যাদের নাম অজ্ঞতাস্বরে তুলে আনতে পারিনি, পাঠকদের প্রতি অনুরোধ তাদের নাম পরিচয় সাল, ঘটনা সহ কমেন্টস বক্সে উল্লেখ করে দেবেন। যাতে এ তালিকাটির পূর্ণতা পায়, আগামী পজন্ম জানার সুযোগ পায়।)
দেবীদ্বারের আলোকিত শত বছরের গুণীজনদের তালিকা প্রণয়নের চিন্তা মাথায় ঢুকে গেল। তাই চিন্তাও বেড়ে গেল। অবহেলায় অনাদরে, অলসতায় পেছনে অনেকগুলো দিন ফেলে এসেছি। যে দিনগুলো আর ফেরত পাবনা। সামনেও খুব বেশী সময় নেই। এখন ওপারে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। তার পরও সময় স্বল্পতার পাশাপাশি অপরিমিত বয়স, জানার মানুষের অপ্রতুলতা সহ নানা কারনে শতাধিক বছরের আলোকিত ও গুণী মানুষদের খুঁজে বেরকরে আনা খুবই কঠিন কাজ। তার পরও চেষ্টা করেছি কৃষি, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, চিকিৎসা, প্রকৌশল, প্রশাসন, ব্যবসা- বানিজ্য, শিল্প- কারখানা, সাংবাদিকতা, আইন, রাজনীতিক, সুফি- সাধক- ধর্মপ্রচারক ও সমাজ সেবকদের মধ্য থেকে ক্ষুদ্র পরিসরে উজ্বল নক্ষত্রদের তুলে আনার। এক্ষেত্রে নানা সমস্যাজনিত কারনে অনেক আলোকিত লোকজনের নাম তুলে আনা সম্ভব হয়নি। তার জন্যে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ভবিষ্যতে আড়ালে থাকা গুণীজনদের নাম পরিচয় সংযোজন করে নেয়ার চেষ্টা করব। তবে গুণীজনদের পরিচয়ের শুরুর আগে দেবীদ্বার উপজেলার পটভ‚মি নিয়ে ছোট করে কিছু কথা বলতে চাই, আর তাহল ঃ
দেবীদ্বার উপজেলার ভৌগোলিক অবস্থান ঃ-
-----------------------------------------------
গোমতী, বুড়ি, ক্ষিরদ ও মরজরা নদীর বেষ্টনিতে কুমিল্লা জেলার অন্যতম একটি উপজেলা দেবীদ্বার। এ উপজেলার আয়তন ৯১ বর্গমাইল তথা ২৩৯.১৪ বর্গ কিলোমিটার। এতে ১৫টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা সম্বলীত দেবীদ্বার উপজেলায় ১৪২ টি মৌজা ও ২১৩ টি গ্রাম রয়েছে। তা জেলা সদর থেকে ২৯কিঃ মিঃ উত্তর-পশ্চিম কোনাকোনি অবস্থিত। এর উত্তরে মুরাদনগর ও ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা, পূর্বে ব্রাহ্মণপাড়া ও বুড়িচং উপজেলা, দক্ষিণে বুড়িচং ও চান্দিনা উপজেলা এবং পশ্চিমে মুরাদনগর উপজেলা অবস্থিত।
প্রাচীন কাহিনী থেকে জানা যায়, অষ্টম শতাব্দীতে লালমাই ময়নামতি দেব বংশ এবং দশম থেকে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চন্দ্র বংশের শাসনাধীনে ছিল। সপ্ত মহাদেশের স¤্রাট যযাতির পৌত্র রাজাদের মধ্যে ‘ত্রিপুরা’ ছিলেন দ্বিতীয়। তার নামানুসারে এঅঞ্চলটি ত্রিপুরা নামে পরিচয় লাভ করে। ১৭৩৩ সালে বাংলার নবাব সুজাউদ্দিন ত্রিপুরা রাজ্য আক্রমন করে দখল করে নেন এবং সমতল অংশ সুবে বাংলার অন্তভর্‚ক্ত করেন। ১৭৬৫ সালে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এ অঞ্চলটি দখলে নিয়ে ১৭৯০ সালে ত্রিপুরা জেলা স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে রূপান্তরিত করে। এসময় (১৭৩৩- ১৭৯০) এ অঞ্চলটি মোঘলদের দ্বারা শাসিত ছিল। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রদের (১৬ অক্টোবর) সময় ত্রিপুরা পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের অন্তর্ভক্ত হয়। একসময়ের ত্রিপুরা বর্তমানে কুমিল্লা জেলা। সেই ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা ‘কমলাঙ্ক’র নামানুসারে ‘কমলাঙ্ক’, কমলাঙ্ক থেকে ‘কর্মুল্যা’, কর্মুল্যা থেকে ‘কুমিল্যা’ এবং সর্বশেষ ১৯৬০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে আজকের ‘কুমিল্লা’ নামকরন হয়েছে। এ কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত ঐতিহ্যবাহি দেবীদ্বার উপজেলা।
দেবীদ্বার থানা প্রতিষ্ঠা ঃ
---------------------------------
কুমিল্লা জেলার সর্ববৃহৎ থানা/ উপজেলা ‘মুরাদনগর’র ৩২টি ইউনিয়নের মধ্যে থেকে বিভক্ত করে,- বড়শালঘর, ইউছুফপুর, রসুলপুর, সুবিল, ফতেহাবাদ, দেবীদ্বার, এলাহাবাদ, জাফরগঞ্জ, গুনাইঘর (উঃ), গুনাইঘর (দঃ), রাজামেহার সহ ১১টি ইউনিয়ন ও চান্দিনা থানার ২০টি ইউনিয়নের মধ্যে থেকে বিভক্ত করে,- ধামতী, সুলতানপুর, ভানী, বড়কামতা, মোহনপুর সহ ৫টি ইউনিয়ন আলাদা করে মোট ১৬টি ইউনিয়ন নিয়ে দেবীদ্বার থানা / উপজেলা’র সৃষ্টি হয়েছিল। কথিত আছে দেবীদ্বার থানা/ উপজেলা’র সৃষ্টি হয়েছিল ‘বড়শালঘর’ ও ‘ধামতী’ ইউনিয়নের দাঙ্গাবাজ লোকদের দমনে। ১৬টি ইউনিয়ন নিয়ে ১৯১৭ সালের ১৫ জুলাই দেবীদ্বার থানা প্রতিষ্ঠা হয়। ওই একই সালের ২১ সেপ্টেম্বর ১১২৩নং স্মারকে গেজেট আর.এ. প্রকাশ হওয়ার পর ১৯১৮ সালের ১জানুয়ারী থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে দেবীদ্বার থানার কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে ১৯৮৬ সালে থানাকে উপজেলায় রুপান্তরিত করার পর ২০০২ সাল থেকে ৫নং দেবীদ্বার সদর ইউনিয়নকে পৌরসভায় উন্নিত করার পর উক্ত উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নের মধ্যে বর্তমানে ১৫টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা করা হয়েছে।
দেবীদ্বার উপজেলার নামকরণ ঃ
=====================
দেবীদ্বারের নামকরণ নিয়ে নানামূখী প্রবাদ, গল্প, কল্পকাহিনী রয়েছে। আজকের প্রেক্ষাপটে নামকরনের সঠিক অবস্থানে পৌঁছা খুবই কঠিন। তবে লোকমুখে ত্রীমূখী নামকরনের যুক্তি পাওয়া গেছে।
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে অভিভক্ত দিনাজপুর জেলার ভাটুরিয়ার দেবীকোটের রাজ পরিবারের মধ্যে ভাতৃকলহে পৈত্রিক রাজপরিবার ত্যাগ করে বানরাজা এ অঞ্চলে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বানরাজা দেবীকোট থেকে আসায় এ অঞ্চলের মানুষের কাছে বানরাজা পরিচয়ের চেয়ে দেবীকোটের রাজা হিসাবে ব্যপক পরিচিতি লাভ করেন। কালক্রমে দেবীকোটের নাম থেকে আজকের দেবীদ্বারের নামকরণ করা হয়েছে।
এক্ষেত্রে ভিন্ন কথাও রয়েছে, কারো কারো মতে, অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বৃটিশের ক্যাপ্টেন জন ডেভিড ভারতের চিতনা নামক স্থান থেকে নৌপথে গোমতী নদী দিয়ে ঢাকা যাওয়ার পথে দেবীদ্বারের ভিংলাবাড়ি নামক স্থানে বানরাজার সৈন্যদের সাথে ক্যাপ্টেন জন ডেভিড’র নেতৃত্বাধীন সৈন্যদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এক সময় ওই যুদ্ধের নাম জন ডেভিডের নাম জড়িয়ে “ডেভিড ওয়ার” (ডেভিডের যুদ্ধ) নামে পরিচিতি লাভ করে এবং ওই যুদ্ধের নামের প্রচলন থেকে আজকের দেবীদ্বার নামের নাকরণের উৎপত্তি বলেও অনেকে দাবী করছেন।
তৃতীয় মতাদর্শীদের মতে, এ অঞ্চল এক সময় হিন্দু অধ্যুষিত ছিল। হিন্দু প্রধান এলাকা হিসাবে তাদের মূর্তী পূঁজার কেন্দ্রস্থল ছিল গোমতী নদীর পাড়। দেবীদ্বার গ্রামের টুনু দত্তের বাড়িতে একটি বড় পূঁজামন্ডপ ছিল। যাকে বলা হত ‘দেবীর ঘর’, এঘরে নির্মান হত দেব-দেবীর মূর্তী। তৈরী মূর্তীগুলো দেশের বাহিরে ত্রীপুরায়ও সরবরাহ করা হত। তখন দেবীদ্বারের জাফরগঞ্জ এবং কোম্পানীগঞ্জ’র ব্রীজ সংলগ্নে দুটি নৌবন্দর ছিল। হিন্দুসম্প্রদায় তাদের মূর্তী-পূঁজাগুলো করতেন গোমতী পাড়ে। কারন, মূর্তী বিষর্জনের নির্ভরযোগ্য স্থান হিসাবে বেছে নেয় গোমতী নদীকে। এক সাথে ৭০-১০০টি পূঁজা মন্ডব তৈরী হতো। পূঁজা শেষে এসব মূর্তীগুলো বিষর্জন দেয়া হতো গোমতী নদীতে। একসময় এ স্থানটিকে ‘দেবীর দুয়ারে’র খেতাবে ভূষিত হলো। সেই থেকে ‘দেবীর দুয়ার ’থেকে পরবর্তীতে দেবীদুয়ার - দেবীদ্ধার-দেবীদ্বার সর্বশেষ ১৯৮৪ ইং সনে দেবীদ্বারের ‘ ী’ পরিবর্তন করে ‘ ী‘র স্থলে ‘ি ’ যোগ করে আজকের দেবিদ¦ার বানানের প্রচলন শুরু করা হয়।
বিশিষ্ট লেখক তিতাস চৌধূরীর লিখা ১৯৮৩ইং সনে প্রকাশিত “কুমিল্লা জেলার লোক সাহিত্য” বইয়ে কুল্লিার গ্রাম গঞ্জের নাম করনে লোকশ্রæতি দিয়ে দেবীদ্বারের নামকরনে উল্লেখ করেন,- “দেবীদ্বার গ্রামে জনৈকা ‘দেবীমূর্তী’ উদ্ধার প্রাপ্ত হয়েছিল এবং সেই ‘দেবী’ সকলের জন্য ‘দ্বার’ উন্মোক্ত করে দিয়েছিলেন। সেই ‘দেবীর’ উন্মোক্ত ‘দ্বার’ থেকে আজকের ‘দেবীদ্বার’ হয়েছে। দেবীদ্বারের নামকরন সম্পর্কে এরচেয়ে বেশী কিছু জানাযায়নি।
দেড় হাজার বছরের সভ্যতার জনপদে দেবীদ্বার;
শিক্ষা- সংস্কৃতি ও প্রত্নকীর্তির এক গৌরবময় ঐতিহ্যের অধিকারী ঃ
-------------------------------------------------------------
প্রতœকীর্তির ক্ষেত্রে দেবীদ্বার উপজেলা এক গৌরবময় ঐতিহ্যের অধিকারী। বাংলাদেশের প্রাচীনতম বৌদ্ধবিহার অন্তর্ভ‚ক্ত দেবীদ্বার উপজেলার গুনাইঘর গ্রাম। যাকে গুনিতক অর্থাৎ গুণীজনদের এলাকা বলা হত। এখানে গুণীজনদের কয়েকটি বিশ্ব বিদ্যালয় ছিল। ৫০৭-৫০৮খ্রিষ্টাব্দে গুনাইঘর গ্রামের বাসুদেব বাড়ীর পাশে একটি পুকুর খননকালে একটি তা¤্র শিলালীপি উদ্ধার হয়েছিল। ওই প্রতœতাত্তি¡ক মূল্যবান নিদর্শন তা¤্র শিলালীপিটি বর্তমানে ঢাকা জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। সেই সময়টিকে দেবীদ্বারের সভ্যতার জনপদের মাইল ফলক হিসেবে চিহ্নীত করে দেবীদ্বারের জনপদ প্রায় দেড় হাজার বছরের জনপদ হিসেবে প্রচলিত হয়ে আসছে।
সমতটের রাজধানী দেবীদ্বারের বরকামতা ঃ
-----------------------------------------------
চন্দ্রবংশীয় রাজা ভবদেব কুমিল্লায় আনন্দ বিহার বা শালবন বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময়ে বিহার এশিয়ার জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিগণিত হয়। সে সময় একে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দেওয়া হয়। বিখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং আনন্দ বিহারে আসেন। তখন বিহারে চার হাজার ভিক্ষু (ছাত্র) ছিল। হিউয়েন সাং ময়নামতি অঞ্চলে ৩৫টি শিক্ষাকেন্দ্র (বিহার) দেখতে পান। তখন তিনি সমতট তথা কুমিল্লা বাসীকে প্রবল শিক্ষানুরাগী বলে আখ্যায়িত করেন। চৈনিক পরিব্রাজক হুয়েনসাং’র বর্ণনা অনুযায়ী সমতট রাজ্যের রাজধানী খ্যাত এবং হিন্দু অধ্যুষিত ঐতিহ্যমন্ডিত দেবীদ্বার উপজেলার ‘বরকামতা’ গ্রামটিকে ইঙ্গীত করেছেন। নানা দিক থেকে দেবীদ্বার’র এ গ্রামটি ইতিহাস ঐতিহ্যের শীর্ষস্থানে রয়েছে। ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়ক’র পাশে দেবীদ্বার এবং চান্দিনা উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় ক্ষীরদ নদীর তীরে অবস্থিত বরকামতা গ্রাম। গ্রামটি কুমিল্লা শহর থেকে পশ্চিম দিকে প্রায় ১২কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
১৭২২ সালে মুর্শিদ কুলি খাঁর শাসনামলে এ অঞ্চলের জমিদার ছিলেন আগা সাদেক পরবর্তীতে আগা সাদেক’র কনিষ্ঠ পুত্র মীর্জা মোহাম্মদ জাফর এ পরগনার মালিক হলে পশ্চিম এলাকাকে বর্দাহাত এবং পূর্বাঞ্চলকে গঙ্গামন্ডল বলে চিহ্নী করেন। আজও যা প্রচলিত আছে। মীর্জা মোহাম্মদ জাফর’র নামানুসারে জাফরগঞ্জ গ্রাম ও জাফরাবাদ গ্রামের নামকরণ করা হয়।
চলবে---
এবিএম আতিকুর রহমান বাশার,
রাজনীতিক, সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।
০১৮১৯৮৪৪১৮২, ০১৭৬১৭৪০২২৭।