শ্রীকাইল আর নরেন্দ্র নাথ দত্তের জীবনী

 ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্তের বেঙ্গল ইমিউনিটি

কুমিল্লার মুরাদনগরের শ্রীকাইল কলেজঃ

বিশ শতকে বাংলার এই প্রান্তে মেধা ও কায়িক শ্রম কোনো কোনো ব্যক্তিকে সাফল্যের শীর্ষে নিয়ে যেতে পেরেছে, তার উদাহরণ হিসাবে যার নাম সবার আগে উঠে আসে তিনি হলেন শ্রীকাইল গ্রামের কৃতী সন্তান দানবীর ক্যাপ্টেন ডাক্তার নরেন্দ্রনাথ দত্ত। 

নরেন্দ্রনাথ দত্তের জন্ম ১৮৮৪ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর বর্তমান কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরাবাজার থানার শ্রীকাইল গ্রামে। তাঁর পিতা কৃ্ষ্ণকুমার দত্ত আর মাতা শর্বানীসুন্দরী দেবী। কৃ্ষ্ণকুমার দত্ত ও মাতা শর্বানীসুন্দরী দেবী দম্পতির সন্তানেরা হলেন কামিনীকুমার দত্ত, সুরেন্দ্রনাথ দত্ত, নরেন্দ্রনাথ দত্ত ও দেবেন্দ্রনাথ দত্ত। নরেন্দ্রনাথ দত্তের ভাইদের সকলেই শিক্ষা লাভ করেছিলেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ ভাই কামিনীকুমার দত্ত(১৮৭৮-১৯৫৯) ছিলেন কংগ্রেস নেতা ও জাদরেল উকিল। তিনি পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারে আইনমন্ত্রী (১৯৫৬-৫৮)ছিলেন। কনিষ্ঠভাই দেবেন্দ্রনাথ দত্ত দেরাদুন থেকে বনবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে প্রথমে বন বিভাগের চাকরিতে নিয়োজিত হয়েছিলেন। পরে ব্যবসায়ে আত্মনিয়োগ করে যশশ্বী হয়েছিলেন।মেজো ভাই সুরেন্দ্রনাথ দত্ত ব্যবসায়ে সহযোগী ছিলেন। 

নরেন্দ্রনাথ দত্ত শিশুকালে মাকে হারান। তার বয়স যখন ৬/৭ বছর তখন তার মা মারা যান। তার ছোট ভাই দেবেন্দ্র নাথ তখন ৩/৪ বছরের শিশু। চট্টগ্রাম সরকারী স্কুলের পন্ডিত বাবা কৃষ্ণকুমার দত্ত তার বড় দুই ছেলে কামিনী কুমার ও সুরেন্দ্র নাথকে নিজের কাছে চট্টগ্রামে নিয়ে যান।আর ছোট দুই ছেলে নরেন্দ্র ও দেবেন্দ্রকে সামান্য সম্বলের উপর ভরসা করে বাড়িতে তাদের বৃদ্ধা জ্যেঠিমার পরিবারে রেখে যান। নরেনের জ্যেঠা মারা যাওয়ার পর বাড়িতে তখন জ্যেঠিমা, এক পিসতুত বিধবা বোন, পিসিমা, পিসতুত ভাই আর নরেন্দ্র ও দেবেন্দ্র দুই ভাই। নিচু এলাকা শ্রীকাইল গ্রামের ছেলেপিলেরা ছোট বেলায়ই খালে বিলে পুকুরে ডোবার পানিতে নেমে সাঁতারে অভ্যস্থ হয়ে থাকে। নরেন্দ্র নাথ তখনও সাঁতারে পারদর্শী বা পটু হয়ে উঠেননি।একদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে খালি পায়ে রাস্তা ধরে হাঁটার সময় নরেন পা পিছলে হঠাৎ রাস্তার পাশের এক ডোবায় পড়ে যান। শ্রীকাইল গ্রামের সাবেক মেম্বর ধনুরঞ্জন দাসের ভগ্নিপতি দেবীদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামের বিপিনচন্দ্র পাল তখন শ্বশুরবাড়ি শ্রীকাইলে বেড়াতে এসেছিলেন। নরেন্দ্র নাথ যখন ডোবায় পড়ে যান সেই সময়ে বিপিনচন্দ্র পাল দৃষ্টি সীমায় ছিলেন। তিনি দৌঁড়ে গিয়ে পানিতে নেমে ডুবন্ত নরেন্দ্র নাথকে তুলে আনেন। নরেন্দ্র নাথ ভাগ্যক্রমে সেদিন নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। বড় হয়ে ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত তার উদ্ধারকর্তা বিপিনচন্দ্র পালের সে ঋণের কথা ভুলেননি। ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত বড় হয়ে প্রতিষ্ঠা করেন পিতার নামে শ্রীকাইল কে কে হাই স্কুল(১৯৪০)। নন-মেট্রিক বিপিনচন্দ্র পালকে নিচের ক্লাসে পড়ানোর জন্য স্কুলের চাকরিতে নিয়োজিত করে তাঁর ঋণ কিছুটা শোধ করার চেষ্টা করেছিলেন।

জ্যেঠিমার সংসার এমনিতেই অর্থের টানাটানি। তার উপর আবার নরেন্দ্র নাথ ও দেবেন্দ্র নাথ আছে। সে বিষয়টি ভাবায় শিশু নরেন্দ্রকে। সে চায় কিছু উপার্জন করে সংসারে সাহায্য করতে। বাড়ির আয় হতে সংসার চলে না, ধার দেনা লেগেই খাকে।পিতাও আর চট্টগ্রাম থেকে টাকা পাঠাতে পারেন না।সংসারের খরচ, স্কুলের পাঠ্য বই, খাতা কলম প্রভৃতির ব্যয় কি করে সঙ্কুলান হবে সে চিন্তায় থাকে সে। কিছু আয়ের সুযোগ আসে গ্রামের কৃষকের ধানী জমিতে নিড়ানি দেওয়ার কাজ পেয়ে।সেটি ছিল তার প্রথম উপার্জন। নরেন যখন গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে যাওয়া আরম্ভ করেন সে সময়ে স্থানীয় শ্রীকাইল বাজারে জনৈক মুদির দোকানে সকাল বিকাল কাজ করার সুযোগ পান। কাস্টমার না থাকলে নিজের পাঠ্য বই নিয়ে পড়েন। তার বই পড়ার স্বভাব দেখে মুদি ভাবেন নরেন হয়তো আজেবাজে বা ডিটেকটিভ বই পড়ে দোকানের সময় নষ্ট করছে। একদিন গ্রামের স্কুলের মাস্টারের কাছে নরেন সম্পর্কে খবর নেন মুদি। মাস্টার তাকে জানান যে নরেন ভাল ছাত্র। লেখাপড়ায় সে খুবই ভাল। ভুল ভাঙ্গে মুদির। পরীক্ষার সময় আগত। মুদি দয়া বশত বিনা শ্রমে মাসে ৪ টাকা দিতে নরেনকে প্রস্তাব দেন। বিনা শ্রমে টাকা নিতে নরেন রাজি হননি। বাল্যকালেই কারও দান গ্রহণকে নরেন অমর্যাদাকর বলে মনে করতেন। ২টাকা বৃত্তি পেয়ে নিম্ন প্রাথমিক পাস করে ভর্তি হন পাশের গ্রাম ধনপতিখোলা মধ্যবাংলা স্কুলে। প্রায় তিন মাইল দূরের স্কুলে আসা যাওয়া করতেন কষ্ট করে হেঁটে। বর্ষাকালে মাঠ পাড়ি দিতেন হাঁটু পানি ভেঙ্গে। খাল আর নদী পাড় হতেন সহপাঠিদের নিয়ে উৎসাহের সাথে সাঁতরিয়ে। ধনপনিখোলায় ছিল অনেক জেলের বাস। তারা পুকুর ডোবা কিংবা নদী থেকে মাছ ধরে ধনপনিখোলা, হাটখোলা, শ্রীকাইল, মেটংঘর, বাঙ্গরা ইত্যাদি বাজারে নিয়ে বিক্রি করতো। গাবরদের সাথে আলোচনা করে ছুটির দিনে কিংবা লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে তাদের জাল টানায় সহায়তা করে কিছু আয় করার চেষ্টা করতেন। ধনপতিখোলা মধ্যবাংলা স্কুল থেকে ছাত্র বৃত্তি পাস করেন প্রথম বিভাগে। তিনি ১৮৯৯ সালে কুমিল্লায় গিয়ে ৭ম শ্রেণিতে ভর্তি হন কুমিল্লা জেলা স্কুলে। সেখানে প্রথমে থাকতেন গোয়ালপট্টির একটি সাধারণ হোটেলে। হোটেলে থাকা খাওয়ার খরচ মাসে ৩ টাকা, তদোপরি স্কুলের বেতন, বই খাতা পেন্সিল ইত্যাদি খরচ তো আছেই। নিজে আয় করে জমিয়ে যা নিয়ে গিয়েছিলেন মাস তিনেক পরেই তা ফুরিয়ে যায়। হোটেল থেকে মালিক একদিন বের করে দেয়। কোথায় গিয়ে উঠবেন তা স্থির না হলেও নিজের সামান্য কাপড়, বইপত্র, বিছানাবালিশ ইত্যাদি নিয়ে বের হলেন। হোটেল মালিককে অঙ্গীকার করে গেলেন শীঘ্রই বকেয়া টাকা পরিশোধ করবেন। স্কুলের বারান্দা কিংবা স্কুলের কোন একজন ঘনিষ্ট চাকরের বাড়িতে আপাতত উঠার সিদ্ধান্ত নিয়েই বেরিয়েছিলেন। কিন্তু পথিমধ্যে ভাগ্যক্রমে দেখা হয় মোক্তার প্রসন্ন কুমার চক্রবর্তীর সাথে। প্রসন্ন বাবু ছিলেন একজন হৃদয়বান মানুষ। নরেন্দ্র নাথের অসহায় অবস্থার বিষয় অবহিত হয়ে নিজের বাড়িতে তিনি আশ্রয় দিলেন তার ছোট ছেলেকে পড়ানোর বিনিময়ে।পরবর্তী জীবনে নরেন্দ্রনাথ এই হৃদয়বান ব্যক্তির কথা ভুলেন নাই। তার পরিবারকে পরে নানাভাবে সাহায্য করে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেছেন।

স্কুলে নরেন্দ্র ৭ম শ্রেণির পরীক্ষায় প্রথম হয়ে ডবল প্রমোশন পেলেন। স্কুল থেকে প্রথম বছর পেলেন হাফ ফ্রি আর পরের বছর থেকে ফুল ফ্রি পেয়েছিলেন। সে সময়ে তার বয়স ১৪ হলেও স্বাস্থ্ ছিল বেশ হৃষ্টপুষ্ট ও বলিষ্ঠ। তিনি কুমিল্লায়ও চেষ্টা চালাতে থাকলেন গ্রামের মত কোন ভাবে কিছু উপার্জন করা যায় কিনা। শহরের বড় কাঁচাবাজার রাজগঞ্জ বাজারে শাক সবজি বিক্রেতাদের সাথে আলাপ করলেন। তাদের সাথে আলাপের পর তিনি স্কুলের ক্লাসের পর শহরতলীর গোমতী তীরবর্তী গ্রাম গুলিতে ঘুরে ঘুরে তাদের উৎপাদিত সবজি কিনে ঝুড়িতে ভরে মাথায় করে নিয়ে এসে বাজারের দোকানিদের কাছে বিক্রি করতে লাগলেন। এতে দৈনিক দশ/বারো আনা লাভ থাকে। গ্রামের চাষী ও কিষাণিদের সাথে তার চমৎকার সম্পর্ক গড়ে উঠে। শাক-সবজি বিক্রিতে তারা নরেন্দ্র নাথকে অগ্রাধিকার দিত। শেষে তিনি বাজারে একটি ছোট্ট দোকান খুললেন এবং একজন লোকও পেলেন তার অবর্তমানে দোকান চালানোর জন্য। এভাবে তিনি রোজগার করে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালালেন এবং কিছু সঞ্চয় করার সুযোগ পেলেন। তার সবজি বিক্রি করে আয়ের এসব বিষয় কিন্তু নিজ পরিবারের লোকজন কখনো জানতে পারেননি। 

১৯০৬ সালে তিনি এভাবে লেখাপড়া চালিয়ে কুমিল্লা জেলা স্কুল থেকে এন্ট্র্যান্স পরীক্ষা দিলেন এবং ভালভাবেই পাস করলেন। তারপর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে এফএ ক্লাসে ভর্তি হলেন। ইতোমধ্যে জ্যেষ্ঠ ভাই কামিনী কুমার দত্ত বিএ পাস করে বীরভূমের শিউড়ি হাই স্কুলে শিক্ষকতা করে টাকা জমিয়ে পরীক্ষা দিয়ে বিএল ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি মুন্সেফ পদে চাকরি নিয়ে কুমিল্লায় পোস্টিং পেলেন। কিছুদিন পরে কামিনী কুমার দত্ত মুন্সেফ পদের চাকরিতে ইস্তাফা দিয়ে আইন পেশায় যোগদান করেন। তিনি পাশের থানা নবীনগরের মালাই গ্রামের রামকানাই পালের মেয়ে মৃণালিনী পালকে বিয়ে করেন। কিছুদিন পরে তিনি শহরের গাঙ্চর এলাকার মোক্তার কুমারচন্দ্র তলাপাত্রের বাড়ির এক অংশ ভাড়ায় নেন। কিছুদিন পরেই স্ত্রীকে কুমিল্লার বাসায় নিয়ে আসেন। সে বাসায় নরেন্দ্রও লজিং ছেড়ে চলে আসেন। চট্টগ্রাম থেকে আসেন সুরেন্দ্রনাথ আর গ্রামের বাড়ি থেকে এসে উঠে ছোট ভাই দেবেন্দ্র নাথ।তাদের মায়ের মৃত্যুর পর পিতা চট্টগ্রামে আরও একটি বিয়ে করেছিলেন। পিতার ছিল টানাটানির সংসার। কামিনীকুমার দত্তের সংসারও তেমন স্বচ্ছলতা ছিল না। এ সময়ে নরেন্দ্র নাথ ভাইয়ের সংসারে উপার্জনী স্বভাবের কারণে যথেষ্ট কাজে লেগেছিলেন। অর্থ উপার্জনের জন্য সময় ব্যয় করায় লেখাপড়ায় বেশি সময় দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ১৯০৮ সালে এফএ পরীক্ষায় আশানুরোপ ফলাফল করতে না পারলেও পাস করেন। পরীক্ষা দিয়েই তিনি কলকাতা মেডিক্যালে ভর্তির জন্য দরখাস্ত দিয়েছিলেন, যদিও মেডিক্যালে পড়ার মতো আর্থিক সামর্থ তার ছিল না। পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার পর সঞ্চিত টাকা নিয়ে কলকাতার উদ্দেশে রওয়ানা হন।তিনি গিয়ে ভর্তি হন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে।

প্রথমেই চেষ্টা চালালেন সস্তায় থাকার একটি ব্যবস্থা করা। ইডেন হিন্দু হোস্টেলে চেষ্টা টালিয়ে ব্যর্থ হলেন।কারণ কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের ছেলেরা আগেই দরখাস্ত করে সুযোগ নিয়ে নিয়েছে। এমহার্স্ট স্ট্রিটের সেন্ট পলস্ কলেজ হোস্টেলে থাকবার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হলেন। আগে বড় ভাইদের জামা পরতে হলেও এবার কলকাতায় এসে এই প্রথম জামা ও চটি পায় দিতে আরম্ভ করলেন। 

লেখাপড়ার খরচ সংকুলানের উদ্দেশে উপার্জনের চেষ্টা চালালেন। নিজের আর্থিক অবস্থা জানিয়ে দরখাস্ত করে প্রথমে মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক ড. চুনীলাল বসুর নিজের কেমিক্যাল ল্যাবরেটরিতে সহকারীর কাজ পেলেন।কলেজের ক্লাসের অবসরে কাজ করার সুবিধা ছিল এখানে। কিন্তু ল্যাবরেটরির কর্মীগণ সব সময় তাকে চান এবং না পেয়ে ড. বসুর নিকট ক্রমাগত অভিযোগ করে চলেন। নরেন্দ্র নাথের আর্থিক অসুবিধার কথা বিবেচনা করে বিনা কাজেই মাসে ৫ টাকা সহায়তা দিতে ইচ্ছুক ছিলেন অধ্যাপক ড. বসু। কিন্তু নরেন্দ্র নাথ বিনাশ্রমে সে সহায়তা নিতে অস্বীকার করে কাজটি ছেড়ে দেন। কিছুদিন তিনি একটি মাড়োয়ারী দোকানে খাতা ও চিঠিপত্র লেখার কাজ নিয়েছিলেন। সেখানে কাজের তুলনায় পারিশ্রমিক সামান্য হওয়ায় তা ছেড়ে দেন। তারপর অনেক স্থানে খোঁজ নিয়েও ভাল পারিশ্রমিকের কোন কাজ না পেয়ে অবশেষে খিদিরপুর ডকে রাতের বেলায় কুলির কাজের খোঁজ পেলেন এবং খিদিরপুর ডকেই রাতের শিফ্টের কুলির কাজ নিতে বাধ্য হলেন। সেখানে দিনের চেয়ে রাতের পারিশ্রমিক ছিল দ্বিগুণ অর্থাৎ এক টাকা বারো আনা। সেখানে কাজ করতে হতো রাত ৮টা থেকে ভোর ৪ টা পর্যন্ত। জাহাজে মাল উঠানো-নামানোর মত কঠিন কাজ ছিল এটি। অল্প বয়সের ছাত্র বিবেচনায় ডকের দায়িত্বরত অফিসার কাজ দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন। কিন্তু নরেন্দ্র নাথের দৃঢ় আস্থা দেখে তাকে তিনি কাজ দিলেন। এমন কঠিন শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করে এক ঘণ্টার পথ পায়ে হেঁটে এসে হোস্টেলে পৌঁছে বেলা ৮-৯ টা পর্যন্ত একটানা তিনি ঘুমান। ডকের কাজেই তিনি শেষ পর্যন্ত টিকে যান এবং ডকের কুলির কঠিন পরিশ্রমের কাজ তার সমগ্র মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষাজীবন(৭ বছর) করে গেছেন। প্রথম বছরে মেডিক্যালের ছাত্রদের রাতে ডিউটি থাকে না। তবে পরের বছর থেকে তার রাতের ডিউটি অন্য ছাত্রদের সাথে কৌশলে পরিবর্তন করে নিতেন। রাতে হোস্টেলে অনুপস্থিতির কারণে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন। খিদিরপুর ডকে রাতে কাজ করেন বলায় কেউ বিশ্বাস করেননি। সেটি খিদিরপুর ডক পর্যন্ত মিলিতভাবে যাচাই করেন কলেজের অধ্যক্ষ ডা. কালভার্ট ও সেন্ট পলস্ কলেজের অধ্যক্ষ রেভারেণ্ড হল্যান্ড। খিদিরপুর ডকের গেটের অফিসারের কাছে নরেন্দ্র নাথের কাহিনী শুনে তাঁরা অবাক হলেন। পরে সে অভিযোগ থেকে রেহাই পেয়ে সমগ্র ছাত্রজীবনে তাঁদের সহানুভূতি পেয়ে ভীষণ লাভবান হয়েছিলেন।

ছাত্র জীবনের শেষ লগ্নে এসে ঘটে এক অঘটন । নরেন্দ্র নাথের স্বভাব হচ্ছে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে কিছুক্ষণ চুপ করে নিচের দিকে দৃষ্টি দিয়ে চিন্তার পর জবাব দেন। পরীক্ষার বেলায়ও কোন প্রশ্নের উত্তরের আগে নিচের দিকে দৃষ্টি দিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তার পর লেখা আরম্ভ করেন। ১৯১৪ সালের মেডিক্যাল কলেজের এমবি শেষ বছরের পরীক্ষার সময় হলের এক গার্ড সন্তর্পণে এসে জাপটে ধরেন নরেন্দ্রকে, বললেন, তুমি নকল করতেছ। এতো কষ্টে পড়ালেখা করে সৎভাবে পরীক্ষা দেওয়ার পরে এমন কথা শুনে তার মাথা যায় বিগড়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে হালকা পাতলা দেহী গার্ড বাবুকে এমন এক থাপ্পড় লাগালেন দেখা গেল তাতে বলিষ্ঠ দেহী নরেন্দ্র নাথের এক থাপ্পড়ে গার্ড চিৎপটাং। সহকারী রেজিস্ট্রার গিরিশচন্দ্র মুখার্জি এসে খাতা নিয়ে যান এবং নরেন্দ্র নাথকে হল থেকে বের করে দেন। পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে নরেন্দ্র নাথ সোজা গিয়ে আশ্রয় নেন মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. কালভার্ট ও অধ্যক্ষ রেভারেণ্ড হল্যান্ডের কাছে।সব কিছু খুলে বলেন তাঁদের কাছে। তাঁরা তাকে অভয় দেন।অভিযোগ যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ছাত্রটিকে চিরতরে বহিস্কার করবেন। কিন্তু বাধ সাধেন মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. কালভার্ট ও সেন্ট পলস কলেজের অধ্যক্ষ রেভারেন্ড হল্যান্ড। তারা চান এবারের মত পরীক্ষা থেকে বিরত রাখতে, চিরতরে বহিস্কার নয়। অবশেষে সাবেক ভিসি স্যার গুরুদাস বন্দোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে নিষ্পত্তি হয় কেবল এবারের পরীক্ষা বাতিলের মাধ্যমে। এই কারণে নরেন্দ্র নাথের একটি বছর নষ্ট হয়ে গেলেও জীবনে তিনি অধৈর্য্যেির এক চরম শিক্ষা পেয়েছিলেন। পরের বছর ১৯১৫ সালে পরীক্ষা দিয়ে ঠিক ভাবেই এমবি পাস করেন। অধ্যক্ষ ডা. হল্যান্ডের সহযোগিতায় প্রেসিডেন্সি জেনারেল হাসপাতালে প্রথমে সহকারী হাউজ সার্জন পদে যোগদান করেন। পরে ইন্ডিয়ান আর্মির মেডিক্যাল কোরে চাকরি পেয়ে ইমার্জেন্সি কমিশনে অস্থায়ী পদ গ্রহণ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ‘লে্ফট্ন্যান্ট’ পদে চাকরি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমান। উদ্দেশ্য সৎ চাকরির মাধ্যমে অর্থ বলে বলীয়ান হওয়া।আর্মির মেডিক্যাল কোরে চাকরির সময় পুলিশের তরফ থেকে প্রবল বাধা আসে এই জন্য যে যুগান্তর দলের ছেলেদের সাথে উঠাবসা থাকার কারণে পুলিশের খাতায় তার নাম ছিল। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. কালভার্ট ও সেন্ট পলস কলেজের অধ্যক্ষ রেভারেন্ড হল্যান্ডের বিশেষ চেষ্টায় সব প্রতিবন্ধকতা তিনি কাটিয়ে উঠতে সমর্থ হয়েছিলেন। 

মধ্যপ্রাচ্যের ইরাকে গিয়ে দক্ষতার সাথে আর্মি ক্যাম্পের মেস পরিচালনা করে সুনাম কুড়িয়েছেন এবং কর্তৃপক্ষের নজর কেড়েছেন।আরবি ও ফারসি ভাষা রপ্ত করেছেন এবং প্রতি ভাষার জন্য ২০০০ টাকা করে পুরস্কৃত হয়েছেন। তিন বছর পরে ছুটিতে দেশে এসে নদীয়ার কৃষ্ণনগরের মহারাজার নিকট থেকে ৮০ বিঘা জমি লীজ নিয়ে সেখানে মাছ চাষ, ফলফলাদির বাগান ইত্যাদি সৃজন করে গেছেন। ৬ বছরের মাথায় ছুটিতে এসে উড়িষ্যার বন লীজ নিয়ে রেল বিভাগের কাছে স্লিপার বিক্রির ব্যবসা চালু করে ছোট ভাই দেবেন্দ্রনাথ দত্তকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসে পুঁজি দিয়ে পুরাপুরি ব্যবসায় চালু করে দিয়ে গিয়েছিলেন। তৃতীয় বার ১৯২৫ সালে ছুটিতে এসে দেখা হয় মেডিক্যাল কলেজ জীবনের বন্ধু ডা. অমূল্যরতন চক্রবর্তীর সাথে। তাঁকে জানালেন স্থায়ী কমিশনে প্রমোশন পেলেও আর চাকরিতে যাবেন না। অবসরে চলে আসবেন এবং ব্যবসায়ে আত্মনিয়োগ করবেন। তখনই নরেন্দ্র নাথকে ডা. অমূল্যরতন চক্রবর্তী ডা. বিধানচন্দ্র রায় ও তাঁর বন্ধুদের দ্বারা ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল ইমিউনিটি কোম্পানির সন্ধান দেন। তাঁরা কোম্পানিটি চালাতে পারছেন না কেবল একজন দক্ষ পরিচালকের অভাবে। ডা. অমূল্যরতন চক্রবর্তী বললেন, যদি ডাক্তারি বা প্র্যাকটিস না করে ব্যবসা করতে চাও তাহলে বেঙ্গল ইমিউনিটি কোম্পানির দায়িত্ব নিতে পারো। তিনি স্বভাবগত ভাবে ভেবে দেখার সুযোগ নিলেন। একদিন কোম্পানিতে গিয়ে ঘুরে দেখলেন। দুদিন পরে তাঁর বন্ধুকে জানালেন যে বেঙ্গল ইমিউনিটি কোম্পানির দায়িত্ব তিনি নেবেন। ১৯২৫ সালে ক্যাপ্টেন ডাক্তার নরেন্দ্রনাথ দত্ত যখন চাকরি থেকে অবসরে এসে বেঙ্গল ইমিউনিটি কোম্পানির দায়িত্ব নেন তখন কোম্পানির তহবিলে পান ৪১ টাকা ১২ আনা। আর কোম্পানির দেনা ছিল তখন ৩৪ হাজার টাকা।

মাত্র ১৬ মাস নিজ যোগ্যতায় পরিচালনার ফলে ৩৪,০০০ টাকা দেনা পরিশোধের পর রিজার্ভ ফান্ড সৃষ্টি করেন ১০, ০০০ টাকার। ১৯২৭ সালে কলকাতার উপকণ্ঠে বরাহনগরে ২৫ বিঘা জমি কিনে ভবন নির্মাণ করে ব্যবসা বাড়াতে থাকেন। ভারতের নানা স্থানে ব্যবসা বাড়াতে শুরু করেন। ভারতের বাইরে বার্মা, সিঙ্গাপুর, মালয়, সিংহল, ইরান, ইরাক ও আফ্রিকায় ব্যবসা বিস্তৃত হতে থাকে। ধর্মতলা হেড অফিসে এবং বরাহনগরের ল্যাবরেটরিতে কাজ করতে থাকেন নিরলস ভাবে। বেঙ্গল ইমিউনিটির রিসার্চ ইনস্টিটিউট, বেঙ্গল ইমিউনিটি থেরাপিউটিক ওয়ার্ড বা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৪ সালে প্রতিষ্ঠানের রজত জয়ন্তী পালিত হয় ধুমধামের সাথে।

ক্যাপ্টেন দত্ত আরও যে সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন বা গড়ে তুলতে সহায়তা করেছিলেন, সেগুলি হলো,

১. উড়িষ্যা প্রদেশে ব্যবসা প্রচেষ্টা। একাজে ছোট ভাই দেবেন্দ্রনাথ দত্ত রেলওয়ে স্লিপার তৈরি করে রেল কোম্পানিকে সরবরাহ করে প্রচুর আয় করেন।তা ছাড়া বিশাল চিল্কাহ্রদে ঘাট ইজারা নিয়ে মাছ চাষ করেন।

২. সমুদ্রে মৎস্য ধরার প্রচেষ্টা।বার্মা সরকার ক্যালকাটা মেটাল সিন্ডিকেটকে আদেশ দিয়েছিল ২৭৫ টনের একটি ট্রলার তৈরি করার জন্য। কিন্তু শেষে আর নিতে পারেনি। সেটি কিনে ১৯৩৮ সালে সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য কোম্পানি গঠন করে চালু করেছিলেন তিনি। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সরকার সামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য এটি নিয়ে যায়। ১৯৪২ সালে এক দুর্ঘটনায় ট্রলারটি সমুদ্রে এটি ডুবে যায়।ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন তিনি।

৩. পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসা আশ্রয় প্রার্থীদের জন্য স্থান ব্যবস্থা। ১৯৪৭ সালে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা রিফিউজিদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য তার উদ্যোগে সরকারের পাশাপাশি তিনিও কাজ করেন।

৪. ওয়েস্ট বেঙ্গল ল্যান্ড ডেভেলাপমেন্ট কোম্পানি লি.। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ডেভেলাপার হিসাবে তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন।

৫. র্যা ডিক্যাল ইনসিওরেন্স কোম্পানি লি.-এর  সদর দপ্তর ছিল কুমিল্লায়। ১৯৩১ সালে চালু হয়। পরিচালনায় ব্যর্থ হলে উদ্যোক্তারা ১৯৩৯ সালে ক্যাপ্টেন দত্তের শরণাপন্ন হন। ক্যাপ্টেন দত্ত একে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিলেন।

৬. ইন্ডিয়ান রিচার্স ইনস্টিটিউট। ১৯৩৩ সালে প্রথমে একটি ভাড়া বাড়িতে স্থাপন করেন।পরে নিজস্ব ভবনে যান।

৭. ভারতী প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং কোম্পানি লি.

৮. এস, এন্টুল এণ্ড কোম্পানি লি.

৯. নবশক্তি নিউজপেপারস্ কোম্পানি লি.।অমৃতবাজার পত্রিকা কর্তৃপক্ষের সাথে মিলিত উদ্যোগে বিপ্লবীদের যুগান্তর পত্রিকা আবার চালু করেন। এ কে ফজলুল হকের নবযুগ পত্রিকা ক্রয় করেন।নবযুগ বন্ধ হলে ছাপাখানা এই নামে চালু থাকে। সাপ্তাহিক নবশক্তি ক্রয় করে তিনি আবার চালু করেন। নবশক্তির সম্পাদক ছিলেন বিজয়ভূষণ দাশগুপ্ত আর সহকারী সম্পাদক ছিলেন তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাস খ্যাত অদ্বৈতমল্ল বর্মণ। পরে অদ্বৈত মল্ল বর্মণ ১৯৪১ সাল অবধি সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত শিল্পোন্নয়নের মাধ্যমে অর্থোপার্জনের পর শিক্ষার জন্য তিনি উদ্যোগ নিতে থাকেন। ১৯৪০ সালে পিতার নামে নামকরণ করে প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীকাইল কৃষ্ণকুমার উচ্চ বিদ্যালয়।কুমিল্লা বারের প্রথিতযশা উকিল শ্রীকাইল গ্রামের উমেশচন্দ্র দত্ত বিএল, উকালতি পেশা ছেড়ে এসে ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্তের অনুরোধে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই স্কুলের প্রচুর ছাত্র বোর্ডে মেধা তালিকায় স্থান লাভ করেছেন। এই স্কুলের ছাত্র ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শাহপুর গ্রামের মনিরুল ইসলাম ১৯৮০ সালে কুমিল্লা বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন।বিসিএস পরীক্ষায় প্রথম হয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি নিয়ে এখন রাষ্ট্রদূত হয়েছেন। শ্রীকাইল কৃষ্ণকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র মুরাদনগরের শাহগদা গ্রামের বাছেদ আলম পরে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হয়ে ১৯৮৩ সালে ঢাকা বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন।

ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত নিজগ্রাম শ্রীকাইলে ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীকাইল কলেজ। শ্রীকাইল কলেজের আগে সারা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে কেবল গুটি কয়েক কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল(১৯২৬ সালে টাঙ্গাইলের করটিয়ার চাঁন মিয়া প্রতিষ্ঠিত সাদত কলেজ, ১৯৩৮ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মনাকোষায় ইদ্রিস আহমেদ মিঞার আদিনা ফজলুল হক কলেজ, ১৯৩৯ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়ায় রেবতীরমন দত্তের স্যার আশুতোষ কলেজ আর ১৯৪০ সালে বরিশালের বানারীপাড়ার শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের চাখার কলেজ অন্যতম)।

ক্যাপ্টেন দত্ত ১৯৪১ সালে মাত্র ৪২ জন ছাত্র নিয়ে চালু করেন শ্রীকাইল কলেজ। সে সময় কলেজে কোনো ছাত্রী ভর্তি হননি। শ্রীকাইল কলেজে সূচনা থেকে পর পর তিনজন অধ্যক্ষ ছিলেন পিএইচ.ডি ডিগ্রি ধারী। তারা হলেন, ড. অতীন্দ্রনাথ বোস, এমএ, পিআরএস, পিএইচডি(তিনি পরে পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন); ড. অনিলচন্দ্র ব্যানার্জি এমএ, পিআরএস, পিএইচ.ডি; ড. ধীরেন্দ্রলাল দাস, এমএ, পিআরএস, পিএইচ.ডি। কলেজে পিআরএস ও পিএইচ.ডি ডিগ্রিধারী অধ্যক্ষ নিয়োজিত হয়েছিলেন এমন সুযোগ পাওয়া কলেজ শ্রীকাইল কলেজ ছাড়া বাংলাদেশে আর একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্তের ইচ্ছায় শ্রীকাইল কলেজের সূচনাতে যে শিক্ষকমণ্ডলী নিয়োজিত হয়েছিলেন তাও অভূতপূর্ব। কোনো কলেজের সূচনাতে এমন মানের শিক্ষকমণ্ডলী আজকাল কল্পনাও করাও কঠিন।

শ্রীকাইল কলেজের সূচনাতে অর্থাৎ ১৯৪১ সালে নিয়োজিত টিচিং স্টাফে ছিলেন,

১. অধ্যক্ষ ড. অতীন্দ্রনাথ বোস, বিএ(অনার্স), প্রথম শ্রেণিতে প্রথম, এমএ, প্রথম শ্রেণিতে প্রথম(ইতিহাস), পিআরএস, পিএইচ.ডি।

২. অধ্যাপক শ্যামাদাস ভট্টাচার্য, বিএ(অনার্স)প্রথম শ্রেণিতে প্রথম, এমএ, প্রথম শ্রেণি, গোল্ড মেডালিস্ট, বিএল, প্রথম শ্রেণি, গোল্ড মেডালিস্ট।

৩. অধ্যাপক কান্তিপ্রসাদ চৌধুরী, বিএ(অনার্স), প্রথম শ্রেণিতে প্রথম, এমএ(ইংরেজি) প্রথম শ্রেণি, রেজিনাগুহ গোল্ড মেডালিস্ট।

৪. অধ্যাপক জ্যোতিষচন্দ্র গুপ্ত, বিএ(অনার্স), প্রথম শ্রেণিতে প্রথম, এমএ, প্রথম শ্রেণি(দর্শন), গোল্ড মেডালিস্ট।

৫. অধ্যাপক ইসমত আলী, এমএ, প্রথম শ্রেণিতে প্রথম(আরবি), গোল্ড মেডালিস্ট।

৬.অধ্যাপক দুর্গাদাস রায়, বিএ(অনার্স)প্রথম শ্রেণিতে প্রথম, এমএ, প্রথম শ্রেণি(সংস্কৃত)।

৭. অধ্যাপক হরিপদ চক্রবর্তী, বিএ(অনার্স), প্রথম শ্রেণি, এমএ, প্রথম শ্রেণি(বাংলা)।

৮. অধ্যাপক যতীন্দ্রমোহন রায়, বিএ(অনার্স), প্রথম শ্রেণি, এমএ প্রথম শ্রেণি(রাষ্ট্রবিজ্ঞান)।

৯. অধ্যাপক সত্যেন্দ্রমোহন চট্টোপাধ্যায়, এম.এসসি(ডবল),পদার্থবিদ্যা ও রসায়নশাস্ত্র।

১০.অধ্যাপক ক্ষিতিশ্চন্দ্র রায়, এমএ, দ্বিতীয় শ্রেণিতে দ্বিতীয়(ইতিহাস)।

১১. অধ্যাপক রেণুকা বোস, এমএ, দ্বিতীয় শ্রেণি(অর্থনীতি)।

১২. ফিজিক্যাল ইনস্ট্রাক্টর বিজয়কৃষ্ণ আইচ, বিএ, ডিপ্লোমা ইন ফিজিক্যাল এডুকেশন।

তিন তলা কলেজ ভবনটি অনেক দূর থেকেই মানুষের দৃষ্টিগোচর হতো। অধ্যক্ষের আবাসিক ভবনও ছিল তিন তলা। শ্রীকাইল কলেজে নিয়োজিত অধ্যাপকদের সকলেই ছিলেন মেধাবী ছাত্র হিসাবে সুনামের অধিকারী এবং বড় মাপের স্কলার। শিক্ষার প্রতি তাঁদের আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও যত্নের সাথে লেখাপড়া শেখানোর ফলে ছাত্রদের অধীত বিষয় তারা সুন্দরভাবে আয়ত্ত করতে সক্ষম হতো। 

১৯৪৫ সালে শ্রীকাইল কলেজের ছাত্র অরুণকুমার দত্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত এফএ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। দরিদ্র পরিবারের মেধাবী সন্তান মেদেনীপুরের অরুণকুমার দত্তের লেখাপড়ার সকল খরচ বহন করেছিলেন ক্যাপ্টেন ডাক্তার নরেন্দ্র নাথ দত্ত নিজে। অরুণকুমার দত্ত পরবর্তী সময়ে আইসিএস হয়েছিলেন এবং চাকরি জীবনে ভারতে সচিব পদে উন্নীত হয়ে অবসর গ্রহণ করেছিলেন।

ক্যাপ্টেন দত্ত কলকাতার বরাহনগরে একটি স্কুল ও হোস্টেল চালাতেন। তাঁর মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারীগণ সেটি পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫৫ সালে বিদ্যালয়টি নরেন্দ্রনাথ দত্তের নামে নামকরণ করে একে হাই স্কুলে উন্নীত করা হয়। বরানগর নরেন্দ্রনাথ বিদ্যামন্দির এখন প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শাখা চালু হয়ে ক্যাপ্টেন দত্তের স্মৃতি বহন করে চলেছে।

ক্যাপ্টেন দত্তের জীবনে অনেক ঘটনার কথা এলাকার মানুষের স্মরণে আছে এবং সেগুলি নিয়ে আলোচনাও হয়। এখানে এমন দুটি ঘটনার কথা আলোচনা করা হলো। 

ক্যাপ্টেন দত্ত গ্রামাঞ্চলে অর্থাৎ নিরেট গ্রাম শ্রীকাইলে কলেজ করার ভাবনায় ছিল গ্রামের গরীব মানুষের ছেলে মেয়েরা পান্তা খেয়ে, লুঙ্গি পরে,খালি পায়ে এসে কলেজে লেখাপড়া করবে।এমনই চলছিল ছাত্রদের চলাফেরায়। তিনি একদিন লক্ষ্য করলেন একটি ছাত্র নিয়মিত প্যান্ট জুতা পরে কলেজে আসে।ক্যাপ্টেন দত্ত ছাত্রটিকে ডেকে অন্যান্যদের মতো সাধারণভাবে ক্লাসে আসার জন্য বলেন। সে শহরের স্কুলে লেখাপড়া করে আসায় তার অসুবিধার কথা জানালো। ক্যাপ্টেন দত্ত তাকে শ্রীকাইল কলেজ থেকে গিয়ে  শহরের কোনও কলেজে লেখাপড়া করার জন্য বলেন। সে শহরে চলে যায়। সে ছেলেটি লেখাপড়ায় তেমন সুবিধা করতে পারেনি বলে জানা যায়। 

আরেকটি ঘটনা এক হাঁড়ি-পাতিল বিক্রেতাকে নিয়ে। বাঁশের বাঁকে করে মাটির হাঁড়িপাতিল নিয়ে এলাকায় ফেরি করে সে। দিন শেষে সে তার হাঁড়িপাতিল সব বিক্রি করতে পারেনি। ক্ষুধার্ত ছিল। কলেজ ক্যাম্পাসে ছিল একটি পেয়ারার বাগান। কাউকে না দেখে সে চুপিসারে বাগানে ঢুকে আরামে পেয়ারা খেল। ক্যাপ্টেন দত্ত সেদিন হাঁটতে হাঁটতে বাগনের কাছে এসে টের পেলেন কিন্ত তাকে তখন কিছু বললেন না। সে যখন বাগান থেকে বের হয়ে হাঁড়িপাতিলের বাঁক কাঁধে নিয়ে বাড়ির দিকে পথ চলা আরম্ভ করে তখন লোক দিয়ে তাকে ডাকানো হয়। সে ভয়ে ভয়ে ক্যাপ্টেন দত্তের কাছে গিয়ে হাজির হয়। বিনা অনুমতিতে কলেজের বাগানের পেয়ারা খাওয়ার অপরাধ সে স্বীকার করে ক্ষমা চায়। তার অপরাধের শাস্তি স্বরূপ তার সকল হাঁড়িপাতিল ভেঙ্গে দেওয়ার নির্দেশ দেন। একজন সেই আদেশ পেয়ে একটি লাঠি দিয়ে সবগুলি পাতিল একে একে ভেঙ্গে গর্তে ফেলে দেয়। সব হাঁড়িপাতিল বিক্রি করে যা পেত তার চেয়েও কিছু বেশি টাকা দেন তাকে। তাকে অঙ্গীকার করান যে আর কোনদিন বিনা অনুমতিতে কারও কোন জিনিস সে নিবে না বা খাবে না। হাঁড়িপাতিল বিক্রেতা সেদিন অঙ্গীকার করে বিদায় নিয়ে স্থান ত্যাগ করে। 

ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর সাথে কংগ্রেসের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেন। ১৯৩০ সালে সরকারের আইন অমান্য আন্দোলনে নেতাজীর সাথে রাজপথে মিছিলে অংশ গ্রহণ করার প্রাক্কালে পুলিশের লাঠিচার্জ থেকে নেতাজীকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজেও আহত হয়েছিলে। কুমিল্লার ডা. সুরেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় মেডিক্যাল কলেজে ক্যাপ্টেন নরেন্দ্র নাথ দত্তের সহপাঠী ছিলেন। ১৯২৩ সালে কুমিল্লায় অভয় আশ্রম প্রতিষ্ঠার সময় ডা. সুরেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় ক্যাপ্টেন দত্তের অর্থ সাহায্য পেয়েছিলেন। ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে মাস্টার দাকে সহায়তাকারী কয়েকজন আসামীকে গোপনে ক্যাপ্টেন দত্ত কলকাতায় তাঁর বরাহনগর গোডাউনে দীর্ঘ দিন আশ্রয় দিয়েছিলেন।

স্বাধীনতার পরে কংগ্রেসের উর্ধ্বমহল ও ব্যবসায়ী মহলের সাথে মতের অমিল হওয়ায় প্রথম মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ড. প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের(ঢাকার নবাবগঞ্জের কৈলাইলের সন্তান) পদত্যাগের পর যখন ডা. বিধানচন্দ্র রায় মুখ্যমন্ত্রী হন তখন তাঁর কেবিনেটে মন্ত্রী হিসাবে যোগদানের জন্য ক্যাপ্টেন দত্তকে তিনি আহবান করেছিলেন। ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের সে আহবান ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত বিনীতভাবে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।

মৃত্যুর কিছুদিন আগে অর্থাৎ ডিসেম্বরে(১৯৪৮) ক্যাপ্টেন দত্ত শ্রীকাইল এসেছিলেন। তাঁর সকল সম্পত্তি বাণী দেবী ট্রাস্টে ন্যাস্ত করে যান। কুমিল্লা জেলার ডেপুটি কমিশনার হচ্ছেন বাণী দেবী ট্রাস্টের প্রধান। শ্রীকাইল থেকে কলকাতায় ফিরে ক্যাপ্টেন দত্ত অবহিত হন যে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার বেঙ্গল ইমিউনিটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্তের নামে মার্চ মাসের ২৩ তারিখ(১৯৪৯) আয়কর সংক্রান্ত একটি নোটিশ করেছেন, যাতে বলা হয়েছে বিগত ৮ বছরে(১৯৪০-৪৮) মোট ৫৮,২৪,০২৩ টাকা কর গোপন করা হয়েছে(শুদ্ধ ব্যবসায়ে অর্থ খাটিয়ে আয়ের পর নিয়মিত কর পরিশোধের পরও আয়ের যে আয় হয়েছে তার কর দেওয়া হয়নি স্বীকার করে আদালতে আপীল করার পর ১৯৬০ সালে রায় হয় ৫২,৩৪,৬৬৩ টাকা পরিশোধের যা ক্যাপ্টেন দত্তের উত্তরসুরীরা পরে মামলার খরচসহ সমান ৮ কিস্তিতে পরিশোধ করেছিলেন)। 

১৯৪৯ সালের ৬ই এপ্রিল বিকাল তিনটায় তাঁর ধর্মতলার বাসায় বিশ্রাম নেওয়ার সময় তিনি হঠাৎ  হৃদরোগে আক্রান্ত হন। বাসায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ৯টা ১৫ মিনিটের সময় চিরকুমার মনীষী ক্যাপ্টেন ডাক্তার নরেন্দ্রনাথ দত্ত মৃত্যুবরণ করেন।

-জয়নাল হোসেন

লেখক ও গবেষক।


শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.