কারিগরি শিক্ষায় অবহেলা ও কর্মসংস্থানে বিপর্যয়



মমিনুল ইসলাম মোল্লা :
http://www.comillaweb.com/wp-content/uploads/2011/07/fff.jpg
শিক্ষা মানুষের জীবনকে সহজ সাবলীল করে তুলে। আর কারিগরি শিক্ষা ব্যাক্তিকে স্বনির্ভর করে তুলে। তাই জনবহুল বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে বেকারত্ব দূর করে বাংলাদেশকে একটি স্বনির্ভরও সমৃদ্ধ দেশে পরিনত করা সম্ভব। সরকার কারিগরি শিক্ষাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিলেও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেশি শিক্ষক মাস ধরে বেতন না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বেকারত্ব আমাদের দেশের জন্য অভিশাপ। অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিনত করার জন্য বৃত্তিমূলক কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে প্রত্যেক নাগরিককে দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। কেননা দক্ষ জনশক্তি আমাদের আশির্বাদ। তাই পারিবারিক , সামাজিক জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষার সম্প্রসারণ যতটা জরুরি তার চেয়ে বেশি জরুরি বৃত্তিমূলক কারেগরি শিক্ষার উন্নয়ন।জানুয়ারি মাস থেকে ৩৮ টি বেসরকারি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেতন বন্ধ রয়েছে। অসুস্থ স্বামী শয্যাশায়ী অর্থাভাবে চিকিৎসা হচ্ছেনা। একমাত্র ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে ,থাকে ঢাকা শহরের একটি মেসে। মাসের টাকা না পাওয়ায় মেসে থাকাও সম্ভব হচ্ছেনা জানুয়ারি থেকে বেতন বন্ধ থাকায় যেখানে খাবারের সংস্থান করাই কষ্টকর, মুদি দোকানি আর বাকি দিবেনা বলে হূমকি দিয়েছে, সেখানে স্বামীর চিকিৎসা আর সন্তানের লেখাপড়ার খরচ যোগাবে কিভাবে শারমিন? রাজশাহীর শারমিনের মতো এরকম শতাধিক পরিবাওেরএখন চরম দুর্ভোগ চলছে। দুর্ভোগ কবে কাটবে কেউ বলতে পারেনা
বেতন বন্ধ রয়েছে ৩৮টি (এসএসসি ভোকেশনাল) স্কুল এবং ৭টি এইচএসসি (ব্যাবসায় ব্যবস্থাপনা )কলেজের শিক্ষক-কর্মচারিদের। সব প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে মাউশির মাধ্যমে বেতন পেয়ে আসছিল। ২০০৯ সালে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর পৃথক হয়ে যায়। ফলে তাদের কাগজ পত্র পাঠিয়ে দেয়া হয় কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরে, কিন্তু আর্থিক বাজেট হস্তান্তর করা হয়নি। ফলে তাদের বেতন আটকে গেছে বলে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর জানায়। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলী চৌধুরি ক্ষোভের সাথে জানান-কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে ডিজি আলাদা হওয়ায় একটি স্বপ্ন দেখেছিলাম, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। অদক্ষতার কারণে কাজের গতি নেই বল্লেই চলে। কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক
(ভোকেশনাল) ডঃ খান রেজাউল করিম (দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিজি) জানান, বেতন প্রদানের জন্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রনালয় সমর্থন দিলেই সমস্যার সমাধান হবে। ভূক্তভোগী শিক্ষকগন জানান, প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী অর্থ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলে বকেয়া বেতন দেয়া হয় না। মাসের বেতন পুরোপুরি বাদ গেলে শিক্ষকগণ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন
যারা হাতে কলমে কাজ করে তারাই কারিগর তারা একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞান লাভ করে এবং বাস্তবে সে জ্ঞান কাজে লাগায়। কৃষি প্রধান বাংলাদেশে ধীরে ধীরে কৃষি জমির পরিমান হ্রাস পাচ্ছে। জনসংখ্য বৃদ্ধি পাওয়ায় পৈত্রিক সম্পত্তির উপর নির্ভর করে কৃষকের সন্তানগণ জীবিকা নির্বাহ করতে পারছেনা। তাই বিভিন্নমুখী পেশায় জড়িত হয়ে পড়ছেন। বর্তমানে খাদ্য, বস্ত্র, গার্মেন্টস, কাঠজাত সামগ্রী , কাগজ, বোর্ড, প্যান্টিং, প্যাকেজিং, ঐষধ, রাসায়নিক, রাবার, পলাস্টিক, সিরামিকস, হোটেল, মোটেল, অটোমোবাইলস, মেশিন টুলস, যান্ত্রিক ওয়ার্কসপ, লৌহ, ধাতব, ইলেকট্রনিক্স. বৈদ্যুতিক স্থাপনা, রাস্তা নির্মাণ, ভবন নির্মাণ, বিষয়ে চাহিদা বেশি। এসব বিষয়ে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেগুলোতে পড়ানো হয়। বাংলাদেশে শিক্ষার হার বাড়লেও বেকারত্ব কমছেনা। বরং শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। সাধারণ মাধ্যমে পড়াশোনা করে শিক্ষিত তরুণরা চাকুরির জন্য দীর্ঘদিন ঘুরে ফিরে চাকুরি না পেয়ে হতাশ হচ্ছে। কেউ কেউ বিপথগামীও হয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে কেউ বেকার থাকছেনা। এমন কিছু কিছু বিষয় রয়েছে যেখানে লেখাপড়া শেষ করার আগেই চাকুরি হয়ে যায়। তাই কারিগরি শিক্ষার কদর বাড়ছে
এক সমীক্ষায় দেখা যায়যুক্ত রাজ্য , জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুরে ১৭ থেকে ৫৮ শতাংশ মধ্যম স্তরের দক্ষ জনশক্তি তৈরি হয়। ফলে এসব দেশের মানুষের বার্ষিক আয় হাজার থেকে ৪২ হাজার মার্কিন ডলারের বেশি। অন্যদিকে বাংলাদেশের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। বাংলাদেশে মাত্র শতাংশ মধ্যম স্তরের দক্ষ জনসম্পদ তৈরি হচ্ছে ফলে মাথাপীছু আয় মাত্র শত মার্কিন ডলার। আমাদের দেশে যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে হারে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছেনা। তাই আমাদেরকে বিদেশের বাজার খঁজতে হয়। কিন্তু সেখানে অদক্ষ শ্রমিকের কোন মূল্য নেই। ইরাক , ইরান, সেীদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত , জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া আফ্রিকার কয়েকটি দেশে আমাদের দেশের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের ভাল চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোন কারিগরি কোর্স নেই। মাধ্যমিক পর্যায়ে রয়েছে এসএসসি ভোকেশনালও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে রয়েছে এইচএসসি ভোকেশনাল এবং এইচ এসসি বি এম। বর্তমানে বাংলাদেশে রয়েছে সরকারি ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং ৪৮টি , কৃষক প্রশিক্ষক ইনস্টিউট ১৩টি, টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট ৬টি , মেরিন ইনিয়ারিং ১টি, এবং সার্ভে ইনস্টিইট ২টি। তাছাড়া রয়েছে ৩৫টি টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইনস্টিউট, ৬৪টি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার, ৬৪টি টেকনিক্যাল স্কুল ন্ড কলেজ। বেসরকারি পর্যায়ে রয়েছে ৯৭ টি কৃষি ডিপ্লোমা এবং ১২৮টি ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ দেশে গার্মেন্টস শ্রমিকের কোটা রয়েছে ৭০ হাজার। কিন্তু সে অনুযায়ী দক্ষ শ্রমিক গড়ে উঠছেনা। তবে বর্তমানে তেজগাও টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তরের উদ্যোগ নেয়ায় প্রতি বছর বহু দক্ষ কর্মী গড়ে উঠবে। বর্তমানে দেশের ৯১টি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬৮ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারে। এছাড়া ৫০০টি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কারিগরি বিষয় পড়ানো হচ্ছে। মাদ্রাসাগুলোর মধ্যে ১০০টিতে দাখিল পর্যায়ে ভোকেশনাল কোর্স চালু করা হয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে সহ¯্রাধিক বিদ্যালয়ে এসএসি ভোকেশনাল কোর্স চালু রয়েছে। এছাড়া ২০০টি বেসরকারি কলেজে এইচ এসসি (বিজনেস ম্যানেজম্যান্ট)পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে
বাংলাদেশে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের চাহিদা বেশি। তারা ইঞ্জিনিয়ারদের অধীনে কাজ করেন। সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী একজন ইঞ্জিনিয়ারের অধীনে জন ট্রেডসম্যান কাজ করেন। পলিটেকনিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়ে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সুযোগ রয়েছে। বছর মেয়াদী এধরণের কোর্সে যেকোন বিভাগ থেকে জিপিএ পেলেও ভর্তি হওয়া যায়
কিছু কিছু সমস্যার কারণে বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষা বিঘিœ হচ্ছে। সমস্যাগুলোর মধ্যে শিক্ষক সংকট, ল্যবরেটরিতে প্রয়োজনীয় উপকরণের সল্পতা, সনাতনধর্মী সিলেবাস, শিক্ষাদানের সনাতন পদ্ধতি, কর্মক্ষেত্রের সাথে সমণ¦য়হীন শিক্ষা প্রকল্প গ্রহণ বাস্তবায়নে দূরদর্শিতার অভাব, সংশ্লিষ্ট বিভাগে কাজের সুযোগ কম। এসব কারণে মেধাবি ছাত্র-ছাত্রীরা কারিগরি শিক্ষায় আসতে চাচ্ছেনা। শুধু মাত্র ডুয়েট ছাড়া তাদের জন্য কোন প্রতিষ্ঠানে কোন কোটা নেই। একারণে এসএসসি পাশের পর অনেকে সাধারণ শিক্ষায় চলে আসে। এছাড়া আরেকটি বিশেষ সমস্যা হচ্ছে-উন্নয়নমুখী প্রজেক্টগুলোতে শুধু বিল্ডিংই তেরি হচ্ছে। কোন কোন সময় দেখা যায়, বিল্ডিং বানাতে বানাতেই প্রজেক্টের মেয়াদ শেষ হয়েযায়। ফলে শিক্ষকগন চাকুরি হারান এবং ছাত্ররা দিশেহারা হয়ে যায়। কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীন ৬টি প্রকল্পে কর্মরত সবার চাকুরি রাজস্ব খাতে নেয়ার কথা থাকলেও এখনও নেয়া হয়নি। প্রকল্পের আওতায় ৬০,০০০ শিক্ষার্থি রয়েছে। এধরণের বহু প্রকল্প চাহিদা থাকা সত্বেও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে কারিগরি শিক্ষা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নতুন শিক্ষানীতিতে সরকার কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নে বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে। নীতি অনুযায়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কারিগরি শিক্ষার বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভূক্ত করা হবে। এছাড়া একটি কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় চালুর কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর্ন্তজাতিক শ্রমসংস্থার (আইএলও)সহযোগিতায় কারিগরি বৃত্তিমূলক শিক্ষার সংস্কার (টিভিইটি) প্রকল্পের মাধ্যমে একটি দক্ষতা উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন করেছে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেেেছন-সরকার বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় কারিগরি শিক্ষাখাতে দেড় লক্ষাধিক শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি প্রদান করবে। বেসরকারি ৩০টি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য ৫৩৪ কোটি টাকার প্রজেক্ট গ্রহণ করা হয়েছে। কারিগরি শিক্ষার উন্নয়ন করতে হলে মানুষ গড়ার কাগিরদের প্রতি অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। যারা শিক্ষা দিবেন তারা যদি মাসের পর মাস অভূক্ত থাকেন, তাহলে তারা কিভাবে সত্যিকারের শিক্ষা দেবেন? জনসংখাবহুল বেকারত্বপিড়িত বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে দক্ষ মানব সম্পদে পরিনত করতে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর কারিগরি শিক্ষার কোন বিকল্প নেই
লেখক :
কলেজ শিক্ষক সাংবাদিক



শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.