কুমিল্লার নলআরা ও এলাহাবাদ ট্রানজিট ক্যাম্প


অভিমত: স্মৃতি সংরক্ষণ করুন


কুমিল্লার নলআরা ও এলাহাবাদ
 ট্রানজিট ক্যাম্প
ট্রানজিট ক্যাম্প
ট্রানজিট ক্যাম্প

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাসে কুমিল্লার দেবিদ্বারের এলাহাবাদের নাম অবিস্মরনীয়। দেবিদ্বারের মুক্তিযোদ্ধাগন  মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের প্রত্যোক্ষ তত্তাবধানে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেন। এঅঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের হেডকোয়ার্টার ছিল এলাহাবদ। এখানে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের বাড়ি অবস্থিত। এলাহাবাদ ট্রানজিট ক্যাম্প থেকে বাছাই করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনেচ্ছুক যুবকদের বাছাই করা হতো। তাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। শারিরীক কসরতের পর তাদেরকে পূর্নাঙ্গ ট্রেনিং এর জন্য তে পাঠানো হতো।এভাবে ট্রেনিং নিয়ে ন্যাপ, সিপিবি, ও ছাত্র ইউনিয়নের নিজস্ব ১৯০০০ মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বেগবান করেছিল। বিশিষ্ট গবেষক মোতাহের হোসেন মাহবুব তার “ যুদ্ধদিনের কথা” শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন বাংলাদেশের যে কোন জেলার চেয়ে কুমিল্লায় গেরিলা যোদ্ধা বেশি ছিল। যুদ্ধকালীন সময়ে প্রবাসী সরকারের দুটি প্রধান কেন্দ্রের মধ্যে আগরতলা ছিল অন্যতম। দুনম্বর সেক্টরের যুদ্ধ ও গেরিলা তৎপরতায় কুমিল্লার মুক্তিযোদ্ধাদের ছিল অগ্রণী ভূমিকা।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সারা দেশেই প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ও ট্রানজিট ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। উদাহরন স্বরুপ চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় স্থাপিত ১৩টি  প্রশিক্ষণ শিবিরের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। এমনই একটি প্রশিক্ষণ শিবির ছিল দেবিদ্বারের নলআরা। ফতেহাবাদ গ্রামের নলআরা একটি ঐতিহাসিক স্থান। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতিকালে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনিযনের বীর গেরিলা যোদ্ধা বিশিষ্ট রাজনীতিক, গবেষক, লেখক, মেনায়েম সরকারের বড় ভাই প্রাদেশিক সরকারের সচিব, আব্দুল মান্নান সরকারের উদ্যোগে ১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল ফতেহাবাদ গ্রামের আলীম উদ্দিন সরকারের ছেলে আব্দুল মান্নান সরকার, মোজাম্মেল হকপল্টু মুন্সী ,আবু মিয়া জমাদার, আব্দুল খালেক সরকারসহ বেশ ক’জন ঐক্যবদ্ধ্য হয়ে সর্বপ্রথম পঞ্চাশজনকে নিয়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করেন। প্রশিক্ষণার্থীদের হাতিয়ার ছিল লাঠি, এয়ারগান, থ্রীনট থ্রী রাইফেল। উক্ত প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন তৎকালীন সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সদস্য বীর প্রতিক মুকুল হোসেন, বীর প্রতিক নজরুল ইসলাম, হাবিলদার আব্দুল মজিদ, ও হাবিলদার আব্দুল মালেক। পরবর্তীতে নিরাপত্তাজনিত কারণে  প্রশিক্ষণ শিবিরটি দেবিদ্ধারের এলাহাবাদে স্থানান্তরিত করা হয়।

এলাহাবাদ ট্রানজিট ক্যাম্প থেকে কারা কারা ভারতে চুড়ান্ত ট্রেনিং করতে গেল তাদের কিছু খবরাখবর পাওয়া যেত“ সাপ্তাহিক মুক্তিযুদ্ধ” ও ন্যাপের মুখপত্র সাপ্তাহিক নতুন বাংলা পত্রিকায়। এছাড়া গেরিলাদের সাফল্যের খবর এ পত্রিকার মাধ্যমে জনসাধারণ জানতে পারতো।মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে এগুলো এলাহাবাদে আসতো এবং এগুলো এখান থেকে অন্যান্য স্যাটেলাইট ক্যাম্পে পাঠানো হতো। বৃহত্তর কুমিল্লা ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি  ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নিযুক্ত হয়েছিলেন দেবিদ্ধার নিবাসী ইঞ্জিনিয়ার মোস্তাফিজুর রহমান। পরবর্তীতে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন জাকির হোসেন। ভারতের সোনামুড়ার  তমশা বাড়িতে ছিল ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি, ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর ক্যাম্প। এ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ন্যাপ নেতা ফয়েজ উল্লাহ।

             এলাহাবাদ ছাড়াও দেবিদ্ধারের অন্যান্য প্রশিক্ষণ শিবির ও টানজিট ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রনাধীন বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে আগরতলার একটি ক্যাম্পে তাদেরকে পাঠানো হতো। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বেতিয়ারার শহীদদেও সহযোদ্ধা মৃণাল কান্তি মজুমদার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ। প্রশিক্ষণশেষে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অবস্থান করছিলাম ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগড়তলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ”আর্টস এন্ড ক্রাফ্ট ” কলেজের হোস্টেলে। হাস্টেলটি মূলত প্রশিক্ষণ প্রত্যাশী মুক্তিযোদ্ধাদের রাজনেতিক জ্ঞান , দেশেপ্রেমে উৎসাহিত করা , মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনৈতিক ছাত্র নেতৃবৃন্দকে সংগঠিত করে যুদ্ধ পরিচালনার “ট্রানজিট ক্যাম্প” হিসেবে পরিচালিত হয় ।মুক্তিযোদ্ধারা জানান, আগরড়তলার এই ট্রানজিট ক্যাম্পটির সমন্বয়কারী ও সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন নোয়াখালীর ন্যাপনেতা প্রয়াত শেখ মোহাম্মদ আ: হাই এডভোকেট। নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এখানে অবস্থান করতেন। এছাড়া এ ক্যাম্পের তদারকি করতেন ন্যাপ নেতা চৌধুরি হারুনুর রশিদ, মাওলানা আ: রহমান আযমী, ছাত্র নেতা শাহ আলম ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অধ্যাপক এমএম আকাশ। কুমিল্লার মুক্তিযুদ্ধের উপর লিখা “যুদ্ধ দিনের কথা” শীর্ষক বইয়ে উল্লেখ করা হয়-ন্যাপ-সিপিবি-কমিউনিস্ট এর গেরিলা বাহিনীর প্রথম ব্যাচের যোদ্ধা ছিলেন জাকির হোসেন, আইয়ুব আহমেদ প্রমূখ। দ্বিতীয় ব্যাচের ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন অহিদুজ্জামান শিকদার। এ ব্যাচে কুমিল্লার যোদ্ধাদের পাশাপাশি নোয়াখালীর যোদ্ধারাও অংশ নেয়।

            বিএলএফ এর হাবিবুর রহমান ছিলেন দেবিদ্ধার থানা কমান্ডার। তিনি একজন পুলিশ অফিসার ছিলেন। স্বাধীনতাত্তোরকালে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ী  বাঙ্গালী যুদ্ধে তিনি মারা যান। এলাহাবাদের এ ক্যাম্পটি শুধু মাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের  প্রশিক্ষণ ও ভারতে স্থায়ী প্রশিক্ষণের জন্য মুক্তিযোদ্ধা মনোনয়নের কাজেই ব্যবহৃত হতো না। এখানে দেশের বিভিন্ন যায়গা থেকে আসা গন্যমান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অববস্থান করেছেন। এব্যাারে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট গোলাম ফারুক বরেন, “গেরিলা বাহিনীর ট্রানজিট ক্যাম্প হিসেবে মার্চ ও এপ্রিল এ দু মাসে ঢাকার কেন্দ্রিয় নেতৃবৃন্দ প্রথমে এরাহাবাদ ক্যাম্পে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এখান থেকে তারা আগড়তলায় চলে যান। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা হুমাযুন কবির মজুমদার বলেন-৭০ এর নির্বাচনের পর পর আমরা ভিক্টোরিয়া কলেজের ডামি রাইফেল দিয়ে প্র্যাকটিস করি। ”গুনাইগর ইউনিয়নের  মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আলমগলি হোসেন বলেন -৭১ সালে দেবিদ্ধারের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রাম পুরো এলাহাবাদই  মুক্তিযোদ্ধাদের  আশ্রয় শিবিরে পরিনত হয়েছিল। আমরা তখন  সাংবাদিক মমিন মোল্লার দাদা আক্কাস মোল্লার তুলাগাছের নীচের কুরেঘড়ে থাকতাম। সেখান থেকে আমরা বিভিন্ন অপারেশনে যেতাম। দেবিদ্বারের গেরিলা বাহিনীর অপারেশনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল বারেরায় পাকিস্তানী বাহিনীর উপর এমবুশ, -যাতে বেশ কয়েকজন পাক আর্মি মারা যায়।

সাপ্তাহিক ‘ মুক্তিবার্তায় ’ প্রকাশিত এলাহাবাদ ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মজিবুর রহমান, সামছুল হক, রশিদ সরকার, ময়নাল হোসেন বূইয়া, নূরূল ইসলাম আজিজ ভূইয়া, আকামত আলী, আ: মান্নান, আব্দুল হক, ; সোবহান, আ: হান্নান, খায়রুল আলম ভূইয়া, তাজুল ইসলাম ভূইয়া, শামসুল হক, এড: আব্দুর রহমান, সফিকুর রহমান ভূইয়া, আ: জলিল এর বীরত্বের কাহিনী উল্লেখ করা হয়েছে।

            এলাহাবাদ ক্যাম্পের ব্যাপারে হুমায়ুন কবির মজুমদার বলেন- রোজার ঈদের দিন আমি শুভপুর থেকে এলাহাবাদ ক্যাম্পে যাই। সন্ধার পর সেখান থেকে ফিরে আসি। হরিমোহন দাশ ও তার পরিবার আমাকে আশয় দেয়। হরিমোহন দাশের স্ত্রী রনজিত পালের মা আমাকে অত্যন্ত ¯েœহ করতো। আমি তাকে মা বলে ডাকতাম। ” এলাহাবাদ ট্রানজিট ক্যাম্পের প্রশিক্ষণ, খাওয়া-দাওয়া,থাকা, ভারতে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তাদেরকে সার্বিক সহযোহগীতা করেন এলাহাবাদের কাজী মাজহারুল ইসলাম, জাফর চেয়ারম্যান, ফুল মিয়া চেয়ারম্যান, আব্দুল মতিন মাস্টার,আব্দুল বারেক, প্রমুখ।

            বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে গেরিলা যোদ্ধাদের অবদান সর্বজন স্বীকৃত। উইকিপিডিয়াতে এব্যাপারে বলা হয়েছে-আগস্টের পর পরই গেরিলা পদ্ধতিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী তাদের দোসরদেও ওপর হামলা চালাতে থাকে। পাকিস্তানী সামরিক ঘাটি থেকে শুরু করে সামরিক স্থাপনা , যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে রাস্তা-ঘাট ব্রিজ, কালভার্ট, ইত্যাদি মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত হয়। দেবিদ্ধারের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা দেবিদ্ধার সুজাত আলী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ক্যাপ্টেন সুজাত আলী ও ভরতীয় মিত্র বাহিনীর মেজর পান্ডের নেতৃত্বে ১৯৭১ সারের ৪ ডিসেম্বর দেবিদ্বার-চান্দিনা এলাকা মুক্ত হয়। চান্দিনা হাই স্কুল মাঠে মিত্র বাহিনীর কাছে ১৪/১৫শ পাকিস্তানী আর্মি আত্মসমর্পন করে। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ট্রানজিট ক্যাম্পটি চালু ছিল। ট্রানজিট ক্যাম্পের অস্ত্র গুদামের দায়িত্বে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা জুয়েল । চূড়ান্ত বিজয় লাভের পর বঙ্গবন্ধুর আহবানে সবাই অস্ত্র জমা দিলে ট্রানজিট ক্যাম্পটির পরিমসমাপ্তি ঘটে। কুমিল্লার দেবিদ্বারের নলআরাও এলাহাবাদ ট্রানজিট ক্যাম্পটির স্মৃতি রক্ষায় সরকারিভাবে উদ্যোগ নেয়া উচিত।এছাড়া সারাদেশেই এরকম প্রশিক্ষণ শিবির ও ট্রানজিট ক্যাম্প রয়েছে। এগুলো খুঁজে বের করে এতে যাদের অবদান ছিল তাদের অবদানের স্বীকিৃতি দিয়ে এসব স্থান সংরক্ষণ করা উচিত।

 লেখকঃ মমিনুল ইসলাম মোল্লা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের  প্রভাষক ও সাংবাদিক, কুমিল্লা।



           



           






শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.