ভিক্ষাবৃত্তি প্রতিরোধে ইসলাম

 ভিক্ষাবৃত্তি প্রতিরোধে ইসলাম

অল্পে তুষ্টি, সহনশীলতা, মিতব্যয়িতা, বিনা প্রয়োজনে কারো কাছে কিছু না চাওয়ার জন্য শরিয়তে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা.) বলেন, ‘অঢেল সম্পদ থাকলেই ঐশ্বর্যশালী হওয়া যায় না, বরং মনের ঐশ্বর্যই প্রকৃত ঐশ্বর্য।’ (সহীহ বুখারী ও মুসলিম) সুতরাং সম্পদের প্রতি অতিরিক্ত লোভ করা যাবে না। সাহাবীগণ ক্ষুধার তাড়নায় নামাজের সময় দাঁড়ানো অবস্থা থেকে পড়ে যেতেন। এমনকি কেউ কেউ তাদেরকে পাগল হিসেবে বিবেচনা করতেন যদিও তারা পাগল ছিলেন না। ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতরাতেন। তবুও তারা সম্পদের প্রতি কোন প্রকার লোভ করতেন না। ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন তো দূরের কথা। মুসলিম শরিফের বর্ণনায় আছে, নবীজী বলেন, ‘তোমরা মানুষের কাছে কিছু চাইবে না। চাওয়ার ভানও করবে না।’ সাহাবীরা এমন ছিলেন যে, কারো চাবুক মাটিতে পড়ে গেলেও তারা অন্য কাউকে তা উঠিয়ে দিতে বলতেন না। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সেই ব্যক্তি কৃতকার্য হয়েছে, যে ইসলাম গ্রহণ করেছে, প্রয়োজনমাফিক রিযিকপ্রাপ্ত হয়েছে এবং আল্লাহ তাকে যা দান করেছেন তাতে সন্তুষ্ট থাকারও তওফীক দিয়েছেন।’ (সহীহ মুসলিম)

বৈধ জিনিসও যদি অতিরিক্ত খরচ করা হয় সেটি অপচয়ের পর্যায়ে পড়ে। আর অপচয় অভাবে পড়ার একটি কারণ। অতিরিক্ত অভাব ভিক্ষাবৃত্তিকে ডেকে আনে। একজন সাহাবী বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে কিছু চাইলাম। তিনি আমাকে দান করলেন। আমি পুনরায় তাঁর কাছে চাইলাম। তিনি এবারো আমাকে দান করলেন। আমি আবার চাইলে তিনি আমাকে দান করলেন এবং বললেন, ‘হে হাকীম! এ সম্পদ সবুজ শ্যামল ও মিষ্ট। যে ব্যক্তি নির্বিকার চিত্তে এ সম্পদ গ্রহণ করে, তার জন্য তাতে বরকত প্রদান করা হয়। আর যে ব্যক্তি লোভ-লালসার মন নিয়ে তা অর্জন করে, তার জন্য তাতে বরকত দেয়া হয় না। তার অবস্থা এরূপ হয় যে, কোন লোক খাবার খেলো; কিন্তু তাতে তৃপ্তি পেল না। উপরের হাত নিচের হাতের চেয়ে উত্তম (অর্থাৎ দানকারী গ্রহণকারীর চেয়ে উত্তম)।’ হাকীম (রা.) বলেন, আমি বললাম, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন তাঁর শপথ, এখন থেকে থেকে দুনিয়া ত্যাগ করা পর্যন্ত আমি কারো কাছে কিছু চাইবো না।’ আবু বকর (রা.) তাঁর আমলে হাকীমকে ডেকে কিছু (দান) গ্রহণ করতে বললেন। তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। উমর (রা.) তাঁর আমলে তাকে কিছু দেয়ার জন্য ডাকলেন, কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন।
কোন ব্যক্তি যদি কিছু লোককে দেয় এবং কিছু ব্যক্তিকে না দেয় তাহলে তা নিয়ে কোন তর্ক বিতর্ক করা যাবে না। এসময় সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে। আমর ইবনে তাগলিব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে কিছু মাল অথবা বন্দী হাযির করা হলো। তিনি সেগুলো বণ্টন করতে গিয়ে কতক লোককে দিলেন এবং কতক লোককে দিলেন না। তাঁর কানে এল যে, তিনি যাদেরকে দেননি তারা অসন্তুষ্ট হয়েছে। সুতরাং তিনি আল্লাহর হামদ ও সানা পাঠ করার পর বললেন, আল্লাহর শপথ! আমি কাউকে দিয়ে থাকি এবং কাউকে দিই না। আমি যাকে দিই না সে আমার কাছে সেই ব্যক্তির চাইতে বেশি প্রিয় যাকে আমি দিয়ে থাকি। আমি তো এমন ধরনের লোকদের দিয়ে থাকি যাদের অন্তরে অস্থিরতা ও বিহ্বলতা দেখতে পাই। আর যাদের অন্তরে আল্লাহ প্রশস্ততা ও কল্যাণকামিতা দান করেছেন তাদেরকে তাঁর উপর সোপর্দ করি। এই ধরনের লোকদের মধ্যে আমর ইবনে তাগলিব একজন। আমর ইবনে তাগলিব (রা.) বলেন, আল্লাহর শপথ! আমার জন্য এ বাণী এতই মূল্যবান যে, এর বিনিময়ে লাল রংয়ের উট গ্রহণ করতেও আমি প্রস্তুত নই। (সহীহ বুখারী।
পোষ্যদের থেকেই দান শুরু করতে হবে। সচ্ছলতা বজায় রেখে যে দান খয়রাত করা হয় সেটাই উত্তম। যে ব্যক্তি পবিত্র ও সংযমী হতে চায় আল্লাহ তাকে সংযমী পবিত্র বানিয়ে দেন। যে ব্যক্তি সচ্ছল হতে চায় আল্লাহ তাকে স্বনির্ভর হতে দেন। আবু সুফিয়ান সাখর ইবনে হারব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা নাছোড়বান্দা হয়ে যাচ্ছেতাই করবে না। আল্লাহর শপথ! তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আমার কাছে কিছু চায় এবং তার চাওয়া আমাকে অসন্তুষ্ট করে কিছু আদায় করে নেয়, সে আমার প্রদত্ত মালে বরকত পাবে না। (সহীহ মুসলিম) কেউ খুশি হয়ে কিছু দিলে তা নেয়া যেতে পারে। কাউকে বিরক্ত করে কিছু আদায় করা উচিত নয়।
ভিক্ষাবৃত্তি একটি অপমানজনক পেশা। অন্যকোন উপায় না থাকলে শুধু প্রাণ বাঁচানোর জন্য তা করা যেতে পারে। আর্থিক সমস্যা শেষ হয়ে গেলে তা করা হারাম হয়ে যাবে। অতিরিক্ত লাভের আশায় বা ধনী হওয়ার আশায় তা করা যাবে না। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, তোমাদের যে ব্যক্তি সর্বদা চেয়ে-চিন্তে বেড়ায়, আল্লাহ তাআলার সাথে সাাৎকালে তার মুখম-লে এক টুকরা গোশতও থাকবে না। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)। এছাড়া আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি মাল বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে লোকদের কাছে ভিা করে, প্রকৃতপে সে জ¦লন্ত অঙ্গার ভিা করে। অতএব সে তার ভিা মেগে বেড়ানো বাড়াতেও পারে বা কমাতেও পারে। (সহীহ মুসলিম)
ভিা চাওয়াটাই হচ্ছে একটি তবিশেষ। এর দ্বারা ভিাকারী তার মুখম-লকে ত-বিত করে। কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে কিছু চাওয়া বা যা না হলেই নয়, এরূপ েেত্র চাওয়া যেতে পারে। মানুষের কাছে হাত পাতার আগে আল্লাহর কাছে দরিদ্রতা থেকে মুক্ত থাকার জন্য দোয়া করতে হবে। রাসুল (সা.) নামাযের মধ্যে ঋণমুক্তি, দরিদ্রতা ইত্যাদি থেকে পানাহ চাইতেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, অভাব-অনটন যার উপর হানা দেয়, সে যদি তা জনসমে প্রকাশ করে তবে তার এ অভাব দূরীভূত হবে না। আর যে ব্যক্তি তার অভাব সম্পর্কে আল্লাহর শরণাপন্ন হয়; তাড়াতাড়ি হোক কি বিলম্ব হোক আল্লাহ তাকে রিযিক দেবেনই। (আবু দাউদ)।
আবু বিশর কাবীসা ইবনুল মুখারিক (রা.) বলেন, আমি (ঋণ বা দিয়তের) যামিনদার হয়ে অপারগ হয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এ ব্যাপারে কিছু সাহায্য চাইতে গেলাম। তিনি বললেন, অপো কর, এরি মধ্যে আমাদের মাঝে সদকার মাল এসে গেলে তোমাকে তা দেয়ার আদেশ দেবো। তিনি পুনরায় বলেন, হে কাবীসা! তিন ধরনের লোক ছাড়া আর কারো জন্য চাওয়া (ভিা করা) বৈধ নয় : (১) যে ব্যক্তি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। সে ঋণ পরিশোধ করা পর্যন্ত চাইতে পারে, অতঃপর তাকে বিরত থাকতে হবে। (২) যে ব্যক্তি এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়লো যা তার মালসম্পদ ধ্বংস করে দিল, সেও তার প্রয়োজন মেটাতে প্রয়োজন পরিমাণ চাইতে পারে অথবা তিনি বলেন, তার অভাব দূর হওয়া পর্যন্ত চাইতে পারে। (৩) যে ব্যক্তি দুর্ভিরে শিকার হয়েছে এবং তার গোত্রের তিনজন সচেতন ব্যক্তি সত্যায়ন করেছে যে, অমুকের উপর দুর্ভি হানা দিয়েছে, তার জন্যও প্রয়োজন মেটানো পরিমাণ সওয়াল করা বৈধ অথবা তিনি বলেন, অভাব দূর হওয়া পর্যন্ত চাওয়া বৈধ। হে কাবীসা! তিন প্রকারের লোক ছাড়া আর সবার জন্য কারো কাছে হাত পাতা হারাম এবং যে ব্যক্তি হাত পাতে সে হারাম খায়। ইমাম মুসলিম হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন।
ভিক্ষাবৃত্তি প্রতিরোধে কুরআনে বহু নির্দেশনা রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতএব নামায যখন সমাপ্ত হয়, তখন তোমরা যমীনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) অন্বেষণ কর।’ (সূরা আল-জুমআ : ১০)। আবু আবদুল্লাহ যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের কেউ তার রশি নিয়ে পাহাড়ে চলে যাক, নিজের পিঠে করে কাঠের বোঝা বয়ে এনে বাজারে বিক্রয় করুক এবং তার চেহারাকে আল্লাহর আযাব থেকে রা করুক। এটা তার জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ভিা করে ঘুরে বেড়ানোর চাইতে উত্তম এবং মানুষ তাকে ভিা দিতেও পারে বা নাও দিতে পারে। (সহীহ বুখারী) নবী করীম (সা.) বলেছেন, ‘নিজ হাতে উপার্জন করে খাওয়ার চাইতে উত্তম খাদ্য কেউ কখনো খায়নি।’ আল্লাহর নবী দাঊদ (আ.) নিজ হাতে উপার্জন করে জীবিকানির্বাহ করতেন। যাকরিয়া (আ.) ছিলেন ছুতার। এভাবে প্রত্যেক নবী পরিশ্রম করেছেন।
যে ব্যক্তি আল্লাহর দোহাই দিয়ে আশ্রয় কামনা করে তাকে আশ্রয় দান করা উচিত। যে আল্লাহর নাম নিয়ে কিছু চায় তাকে কিছু দিতে হবে। সে যদি ঘোড়ায় চড়েও আসে তাকে বিনা কারণে ফেরত দেয়া যাবে না। কারণ গরিব, মিসকিন, অসহায়, মুসাফিরের হক আমাদেরকে আদায় করতে হবে। তবে যে চাচ্ছে তাকে অবশ্যই শরিয়ত মোতাবেক চাইতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে আল্লাহর কাছে এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ তাআলা দাতা এবং গ্রহীতা উভয়ের কল্যাণ সাধন করুন।
লেখক :

মমিনুল ইসলাম মোল্লা

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক ও সাংবাদিক, কুমিল্লা।

শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.