সাফল্য কথনঃ এগিয়ে যাচ্ছে কুমিল্লার বার্ড

বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। অধিকাংশ মানুষের পেশা কৃষি হলেও আমরা আমাদের চাহিদা মেটাতে পারি না। অথচ আমাদের দেশের মাটি জাপানের মাটির তুলনায় ১৫% বেশী উর্বর। শুধমাত্র তথ্য-প্রযুক্তির অভাবে আমরা পিছিয়ে আছি। তবে অতীতের তুলনায় বর্তমানে কৃষকরা তথ্য-প্রযুক্তিতে অনেক বেশী উন্নত। এক্ষেত্রে সরকারী সংস্থাগুলোর চেয়েও বেশী অবদান কুমিল্লায় অবস্থিত বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন এডেমী বা বার্ড এর।
বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী ১৯৫৯ সালে পরীক্ষামূলক প্রকল্প প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ প্রকল্প প্রবর্তনের উদ্দেশ্য ছিল কৃষি উন্নয়নের প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং কুমিল্লার বিভিন্ন জায়গায় এগুলো প্রয়োগ করে সাফল্য লাভের পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় এ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ করা।
বার্ডের প্রতিষ্ঠাতা ডঃ আক্তার হামিদ খান। তিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের সদস্য হিসেবে সরকারী চাকুরী জীবন শুরু করেন। ১৯৪৪ সালে আই সি এস অফিসার পদ থেকে পদত্যাগ করেন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ অধ্যক্ষ থাকাকালীন সময় ভিক্টোরিয়া কলেজের শ্রী বৃদ্ধি পায় এবং ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
জনশ্রুতি অনযায়ী জানা যায় ডঃ আখতার হামিদ খান একদিন ক্লাশ নিচ্ছিলেন, এমন সময় পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান কলেজের নাম্বারে টেলিফোন করে আখতার হামিদ খানকে চান। পিয়ন তাকে টেলিফোনের সংবাদ পৌঁছালে তিনি পিয়নকে ফিরিয়ে দিয়ে বলেন- ক্লাশ শেষে প্রেসিডেন্ট মহোদয়ের সাথে কথা হবে। অন্য কেউ হলে হয়ত সাথে সাথে ক্লাশ ফেলে অফিসে এসে ফোন ধরতেন। এছাড়া আইয়ুব খান ফোনে কথা বলতে চেয়েছেন- এ ব্যপারে কালক্ষেপন করার সাহসও কারো ছিল না। কিন্তু খান সাহেব তার পেশাগত দায়িত্বকেই বড় করে দেখেন। পরবর্তীতে তাকে প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ে নিয়ে শিক্ষকতার প্রতি আন্তরিকতা প্রদর্শনের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
১৯৫৯ সালে তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে কুমিল্লা কোট বাড়িতে নাম একটি পল্লী উন্নয়ন মূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি এ প্রতিষ্ঠানের প্রথম পরিচালক। তিনি লক্ষ করলেন কুমিল্লার জমির উর্বর শক্তি বেশী হওয়ার পরও জমিতে অধিক ফলন পাচ্ছে না। তাই তিনি কৃষকদের আধুনিক প্রযুক্তির সাথে পরিচিত করে তোলার প্রয়াস নেন।
সবুজ বিপ্লবের সূচনা করতে গিয়ে ১৯৬১-৬২ সালে কলম্বো প্লানের আওতায় কিছু জাপানিজ বিশেষজ্ঞকে বার্ডে নিয়োগ দেন। তারা বার্ডের আওতাধীন ৫ একর জমিতে উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে কৃষকদের উৎসাহ বৃদ্ধি করেন। বার্ডের শুরুতেই খালের/দিঘির পানি কাজে লাগিয়ে কিভাবে শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদ করা যায় সেদিকে চিন্তা করা হয়। সে আলোকে ৭টি এল এল পি দিয়ে সেচ প্রদর্শনের কাজ শুরু হয়। আগে গ্রামের কৃষকরা সেউতি দিয়ে, দোন ইত্যাদির মাধ্যমে পানি সেচ দিত। এল এল পি প্রযুক্তির ব্যবহারে কৃষকদের ফলন বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার কৃষকদের মত কুমিল্লার কৃষকরাও গরু দিয়ে জমি চাষ করত। ১৯৬১-৬২ সালে দুটি ট্রাক্টর বার্ডের প্রকল্প এলাকায় প্রদর্শন করা হয় এবং এগুলো দিয়ে জমি চাষ করা হয়। ১৯৬২-৬৩ সাল আরও ২০টি ট্রাক্টর কেন্দ্রীয় সমবায়ের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। এখন বাংলাদেশের এমন কোন জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে ট্রাক্টরের মাধ্যমে চাষ করা হচ্ছে না। শুষ্ক মৌসুমে পুকুর-খাল-বিলের শুকিয়ে গেলে কৃষকরা চাষাবাদ করতে পারত না। এ সমস্যা সমাধানে ১৯৬২ সালে প্রথম গভীর নলকূপ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। কুমিল্লার দক্ষিণ রামপুরে প্রথম নলকূপ বসানো হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশের সবজায়গায় ইরি চাষ হচ্ছে। কোন কোন এলাকায় ইরি বা স্কীমের ধানই তাদের এক বছরের ধানের চাহিদা মেটাচ্ছে। ১৯৬৫ সালে বার্ডের সাহায্যে এ ধান চাষ শুরু হয়। ১৯৬৭ সালে পুরনো অভয় আশ্রমে (প্রতিষ্টাকালীন বার্ড ক্যম্পাস) বীজ উন্নয়ন কর্মসূচি নেয়া হয়। বর্ডে এ পর্যন্ত ধানের অনেকগুলো উন্নত জাত আবিষ্কার করেছে।
এছাড়া গাজর, ফুলকপি, বরবটি, মুলা,  ইত্যাদি শাক-সবজির জাত উন্নয়নে বার্ড প্রতিনিয়ত কাজ করছে। আধুনিক পদ্ধতিতে মৎস্য চাষ ও মাছের রেণু উৎপাদনের জন্য বার্ড ১৯৬১ সাল থেকেই কাজ করছে। ১৯৬৬ সালে হ্যাচারীতে ৫ লক্ষ পোনা উৎপাদন করে কৃষকদের মধ্যে সরবরাহ করা হয়। এছাড়া ১৯৬৫ সালে দুটি কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন ও ১৯৬২ সালে পনির ও মাখন তৈরীর কারখানা স্থাপন করা হয়। ১৯৭৬ সালে বায়োগ্যাস প্রযুক্তি সরবরাহ করা হয়। বর্তমানে মানব বৃষ্ঠা ব্যবহার করে ইকোটয়লেট প্রকল্পের কাজ চলছে। ডঃ আখতার হামিদ খান ৯ অক্টোবর ১৯৯৯ সালে ইন্তেকাল করেন। তার প্রতিষ্ঠিত বার্ড বা কুমিল্লা মডেল শুধু কুমিল্লায় নয় সারা দেশে কৃষি বিপ্লব ঘটাচ্ছে। কৃষি উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন দেশীয় ও বিদেশী সংস্থা থেকে বার্ড বহু পুরুষ্কারও পেয়েছে।
লেখক: মমিনুল ইসলাম মোল্লা,প্রভাষক, ক্যাম্পেনার সিডিএলজি এবং সহকারী সম্পাদক, (দৃষ্টান্ত ডট কম), কুমিল্লা,
মমিনুল ইসলাম মোল্লা, কুমিল্লা, ০৪ এপ্রিল :





শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.