বাংলাদেশর প্রততাত্ত্বিক নিদর্শনসমৃদ্ধ স্থানগুলোর
মধ্যে কুমিল্লার ময়নামতি অন্যতম। ঢাকা থেকে অতি সহজেই বাসযোগে অথবা ট্রেনযোগে আপনি
কুমিল্লা পৌঁছতে পারেন। কুমিল্লা শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে কোটবাড়ি বা ময়নামতি অবস্থিত।
তবে শুধু বৌদ্ধ সভ্যতার প্রততাত্ত্বিক নিদর্শন দেখতে চাইলে কুমিল্লা ক্যান্টনম্যান্ট
পেরিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডে ৫ কিলোমিটার সামনে গিয়ে ডানদিকে ৩ কিলোমিটার গেলেই চলবে।
এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাপিডিয়ায় বলা
হয়েছে বৌদ্ধ বিহার বা মঠ প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান।
একে ভিক্ষুদের বাসস্থান, ধর্মীয় আচারাদিসম্পন্ন ও ধ্যান করার স্থান এবং বৌদ্ধ শিক্ষার
কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করা য়ায়। বাংলাদেশের উল্লেখ্যযোগ্য বিহারগুলো হচ্ছে শালবন বিহার,
ভাসু বিহার, সোমপুর বিহার, সীতাকোট বিহার ও দেবীকোট বিহার।
বর্তমান কুমিল্লা একসময় সমতট রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত
ছিল। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত ভাগিরথীর পূর্ব তীর থেকে মেঘনার মোহনা পর্যন্ত
সমুদ্র উপকূল ঘেঁষে সমতট রাজ্য বিস্তৃত ছিল। খ্রিস্টীয় আনুমানিক ৩৩৫-৭৫ রাজত্বকারী
সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ স্তম্ভলিপিতে সমতটের উল্লেখ্য পাওয়া যায়। কুমিল্লার সন্তান
মহাপণ্ডিত শীল ভদ্রের সুযোগ্য চীনা ছাত্র পর্যটক হিউয়েন সাং-এর লেখায় ও সমতটের উল্লেখ
রয়েছে।
ইতিহাসের সিঁড়ি বেয়ে পেছনের দিকে গেলে দেখা যায়,
শুধু বৌদ্ধ নয় ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের রাজারা ও সমতট শাসন করেছেন। এগুলোর মধ্যে খরাগ
(৬২৫-৭০৫ খ্রিঃ) রাত (৬৪০-৬৭০) দেব (৭২০-৮০০) চন্দ্র (৮৬৫-১০৫৫)এবং বর্মন (১০৫৫-১১৪৫
খ্রিঃ) অন্যতম। উল্লেখযোগ্য কয়েকজন রাজা হচ্ছেন পূর্নচন্দ্র, সুবর্ণচন্দ্র, ত্রৈলক্য
চন্দ্র, মানিক চন্দ্র, কল্যাণ চন্দ , লহর চন্দ্র, গোবিন্দ চন্দ্র ও বৈন্য গুপ্ত।
ময়নামতি এলাকাটি পাহাড়ি এলাকা। উত্তর দক্ষিণে এটি
প্রায় ১১ মাইল লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে আধ মাইল থেকে দেড় মাইল চওড়া। প্রায় ৫০
ফুট উঁচু এই পাহাড় শ্রেণীর উপরের অংশ প্রায় সমতল। মাঝে মাঝে কোনও কোনও টিলার উচ্চতা
১০০ ফুট পর্যন্ত দেখা যায়। পাহাড় শ্রেণীর উত্তর ভাগের নাম ময়নামতি আর দক্ষিণ ভাগের
নাম লালমাই। কথিত আছে, কোন এক রাজার দুটি মেয়ে ছিল। একজনের নাম লালমতি অন্যজনের নাম
ময়নামতি। তাদের নামেই দুটি স্থানের নামকরণ করা হয়েছে বলে কেউ কেউ ধারণা করেন।
যা যা দেখবেন
শালবন বিহার
বার্ডের নিকটবর্তী পাকা রাস্তা ধরে ৩ কিলোমিটার গেলেই
শালবন বিহারে পৌঁছে যাবেন। পার্শ্ববর্তী গ্রামটির নাম শালবনপুর। এ থেকেও নামকরণ হতে
পারে তবে বিহার তৈরির সময় কি নাম ছিল তা জানা যায়নি।
মূল বিহারটি দেব বংশের চতুর্থ রাজা বভদেব আনুমানিক
৮ম শতাব্দীতে নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায়। পাতলা ইটের চুন-সুরকিতে এটি তৈরি। বিহারটি
বর্গাকার। এর প্রতি বাহুর দৈর্ঘ্য ৫০০ ফুট। প্রতিটি ১২ী১২ ফুট মাপ বিশিষ্ট কক্ষ চিল
১১৫টি। এটি ১৬ ফুট পুরু। কক্ষসমূহের অভ্যন্তরীণ প্রাচীর ৫ ফুট পুরু। প্রতি কক্ষে ৩টি
করে কুলঙ্গি ছিল। এগুলোতে প্রদীপ, পুস্তক, দোয়াত-কলম ও মূর্তি রাখা হতো। ভিক্ষুরা এখানে
জ্ঞান সাধনা করতেন। বিহারের কক্ষগুলোর সামনে রয়েছে ৮ ফুট বারান্দা। বারান্দাটি ছিল
অনুচ্চ দেয়ালে ঘেরা। বিহারের একমাত্র প্রবেশ পথটি ছিল উত্তর দিকে।
শালবন বিহারে ৬টি নির্মাণ যুগের প্রমাণ পাওয়া যায়।
অর্থাৎ প্রথমবার নিমার্ণের পর ৫ বার এটি সংস্কার করা হয়েছিল। বিহারটির
পাশে একটি হলঘর ছিল। চারদিকের দেয়ালও চারটি স্তম্ভের ওপর এর ছাদ নির্মিত হয়েছিল।
হলঘরের পাশে ছোট দুটি কামরা ছিল। হলঘরটি খাবার ঘর আর কামরা দুটি রান্নাঘর
হিসেবে ব্যবহার করা হতো বলে অনুমান করা হয়। রান্না ঘরের ভেতরে প্রচুর পরিমাণে কাঠ কয়লা
ও ছাই পাওয়া গেছে।
শালবন বিহারে ও এর পাশে কয়েকটি মন্দির ছিল। এর মধ্যে
বড় মন্দিরটি কেন্দ্রীয় মন্দির নামে পরিচিত। এটি ইংরেজি ক্রস-এর আকারে তৈরি। বিহারটির
মতো এই মন্দিরেও ৬টি নির্মাণ যুগের প্রমাণ পাওয়া যায়। অর্থাৎ এটি ৫ বার সংস্কার করা
হয়েছে। সমতল ভূমি থেকে ২৫ ফুট নিচে অবস্থিত মাটি পাওয়া গেছে। মন্দিরটি ১৬৮ ফুট লম্বা
ও ১১০ ফুট চওড়া।
বিহারের বাইরে এবং বিহারের উত্তর পশ্চিমে কোণ
থেকে প্রায় ৬০ ফুট উত্তরে একটি বর্গাকারে তৈরি বৌদ্ধ মন্দির রয়েছে। মন্দিরের মুখ পূর্ব
দিকে। পূর্ব দিক থেকে একটি বাঁধানো চওড়া রাস্তা দিয়ে ছিল মন্দিরে ঢোকার প্রবেশ পথ।
মন্দিরের মাঝখানে একটি পূজার ঘরছিল। কেন্দ্রীয় মন্দিরের পাশে আরও দুটি মন্দিরের অস্তিত্ব
পাওয়া যায়। একটি বড় ও অপরটি ছোট। বড়টি চার কোণওয়ালা। পূর্ব দিকে ছিল দরজা। মন্দিরের
বাইরে চারদিকে ছিল ইট বাঁধানো চওড়া পথ। ছোট মন্দিরটি ছিল চার কোণওয়ালা এবং এর প্রতি
কোণে ৩টি করে স্তম্ভ ছিল।
ইতিহাস অনুসন্ধান
১৮৭৫ সালে রাস্তা পুনঃ নির্মাণের সময় শ্রমিকরা কিছু
ইট পায়। তখন থেকেই মূলত ইতিহাস অনুসন্ধান শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কুমিল্লায়
বিমানবন্দর তৈরির সময় বিহারগুলো থেকে ইট সংগ্রহ করা হয়। তখন তাৎক্ষাণিকভাবে ১৮টি
স্থানকে চিহ্নিত করে সংরক্ষণ করা হয়। ১৯৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথম খনন কাজ শুরু
হয়। ফলে একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে শালবন বিহার, আনন্দ বিহার, চারপত্রমুড়া, রূপবান মুড়া,
রানী ময়নামতির প্রাসাদ ইত্যাদি।
শালবন বিহার পাহাড়পুর বিহারের অনেক আগে তৈরি হয়েছিল।
তবে এটি পাহাড়পুর বিহার থেকে ছোট। এ পযর্ন্ত খননকালে এখানে পাওয়া গেছে পোড়ামাটির সিল,
গুপ্ত যুগের স্বর্ণমুদ্্রা,পাথর ও প্রুরীভূত কাঠের তৈরি প্রস্তর যুগের কুঠার ও বাটালী,
পোড়ামাটির চিত্র ফলকে শিকারি, যোদ্ধা, বিভিন্ন প্রাণীর মূর্তি, পিতলের নিবদন স্তূপ,
৮টি তাম্রলিপি, সোনার দুল, রুপার মুদ্রা, ব্রোঞ্জের মূর্তি ও গৃহস্থালী দ্রব্যাদি।
ময়নামতি প্রততাত্ত্বিক জাদুঘর
শালবন বিহারের পাশেই জাদুঘর। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১২
মার্চ ১৯৬৬ সালে। এখানে ৪০টি শোকেসে প্রায় ১ হাজার সামগ্রী রয়েছে। জাদুঘরের প্রবেশপথের
বাঁ পাশেই রয়েছে বুদ্ধের বিশাল ব্রোঞ্জের মূর্তি। তারপর রয়েছে বেলে পাথরে দণ্ডায়মান
বৌদ্ধের মূর্তি। এর ব্যাস ২.১৫ ী ৬৬। এটি আনুমানিক ৭ম শতকে তৈরি। ১২-১৩ শতকের দুটো
তাম্র শাসন রয়েছে। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য দ্রব্যের মধ্যে ব্রোঞ্জের বিশাল ঘণ্টা, (ওজন
৩৭০ কেজি) কালো পাথরের শিবের বাহন, তালপাতার বর্মী পাণ্ডুলিপি অন্যতম।
কীভাবে যাবেন?
ঢাকার সায়েদাবাদ ও রাজধানী সুপার মার্কেটের পাশে
টিকাটুলি হতে বেশ কয়েকটি ভালোমানের বাস পাবেন। কুমিল্লা পৌঁছবেন মাত্র ২ ঘণ্টায়। এছাড়া
কমলাপুর স্টেশন থেকে ট্রেনেও আসতে পারবেন। ঢাকা থেকে কুমিল্লার দূরুত্ব ৯৫ কিলোমিটার।
এছাড়া বরিশাল ৩৭৩, বগুড়া ৩২৫, চট্টগ্রাম ১৬৭, দিনাজপুর ৫১০, ফরিদপুর ২৪১, যশোর
৩৭০, খুলনা ৪৩১, কুষ্টিয়া ৩৭৩, ময়মনসিংহ ২৯০, নোয়াখালী ৯৫, পাবনা ২৫৭, রাজশাহী ৩৬৭,
রংপুর ৪৩১, রাঙ্গামাটি ২৪৩ এবং সিলেট থেকে কুমিল্লার দূরত্ব ২৫৭ কিলোমিটার।
কোথায় থাকবেন?
কুমিল্লা এসে থাকতে পারেন, বেশ কয়েকটি ভালোমানের
হোটেল আছে এখানে। যাওয়ার সময় খদ্দরের পোষাক ও রসমালাই নিয়ে যেতে ভুলবেন না।