![]() |
| কবি নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত কুমিল্লার মুরাদনগরের দৌলতপুর |
মমিনুল ইসলাম মোল্লা
মানুষের জীবনের উজ্জ্বল সময় তার যৌবন। একজন কবির জীবনে এ সময়টি নক্ষত্রের মতো আলোকিত। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের যৌবনের কিছু সময় কেটেছে কুমিল্লার মুরাদনগরের দৌলতপুরে। বিদ্রোহী কবি দৌলতপুরে এসে হয়ে গেলেন প্রেমের কবি। কবির জীবনের গতিপথ বদলে দিল এক নারী। কবি নিজেই বলেছেন এক অচেনা পল্লী বালিকার কাছে এত বিব্রত আর অসাবধান হয়ে পড়েছি, যা কোন নারীর কাছে হয়নি।
এ বালিকাটি আর কেউ নয় সে হচ্ছে মুরাদনগরের বাঙ্গরা ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামের মুন্সী বাড়ির আবদুল খালেক মুন্সীর মেয়ে সৈয়দা খাতুন। কবি আদর করে ডাকতেন নার্গিস।
দৌলতপুরে যাওয়ার আগেই বাঙ্গরা পেরিয়ে দেখবেন নজরুল গেট। জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে সম্প্রতি নজরুল তোরণটি পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে।
নজরুল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ যুদ্ধ জাপান-জার্মান-ইতালির সঙ্গে অন্য পক্ষের দীর্ঘ পাঁচ বছর চলেছিল। নজরুল যুদ্ধে গিয়েছিলেন ১৯১৭ সালে। তিনি ব্যাটালিয়ন কোয়ার্টার মাস্টার ছিলেন। তখন ক্যাপ্টেন আলী আকবর খাঁর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ১৯১৯ সালে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। নজরুল তখন মুসলিম সাহিত্য সমিতির (কলকাতায়) অফিসে আফজাল-উল-হক সাহেবের সঙ্গে থাকতেন। সে সময় আলী আকবর খানের সঙ্গে নজরুলের হদ্যতা গড়ে ওঠে। আলী আকবর নজরুলের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাকে কুমিল্লায় তার গ্রামের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান।
নজরুল ৩ এপ্রিল ১৯২১ কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম মেইলে রাতে আসেন। আলী আকবর খাঁ নজরুলকে নিয়ে যান। ওঠেন কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে। এখানে তার সহপাঠী বন্ধু ইন্দ্র কুমার সেনের ছেলে বীরেন্দ্র কুমার সেনের বাড়িতে ওঠেন। এখানে বীরেন্দ্রের মা বিজয়া সুন্দরীদেবীকে নজরুল মা বলে সম্বোধন করতেন।
দুদিন বেড়ানোর পর ছয় এপ্রিল আলী আকবর খাঁ নজরুলকে নিয়ে মুরাদনগরের বাঙ্গরা ইউনিয়নের দৈলতপুরে নিয়ে আসেন। বর্তমানে যেখানে আলী আকবর মেমোরিয়াল ট্রাস্টের বিল্ডিংটি অবস্থিত। এখানে আরেকটি ঘর ছিল, এ ঘরেই নজরুলকে থাকতে দেয়া হয়। এ ঘরটি ৪৫ হাত দৈর্ঘ্য ও ১৫ হাত প্রস্থ ছিল। বাঁশের তৈরি আটচালা ঘরটির একেবারে পূর্ব পাশে নজরুল থাকতেন।
নজরুলের কক্ষটির পাশেই ছিল কামরাঙ্গা গাছ। কবি এ গাছকে নিয়েই লিখেছেন কামরাঙ্গা রঙ্গ লোকের পীড়ন থাকে/ঐ সুখের স্মরণ চিবুক তোমার বুকের/তোমার মান জামরুলের রস ফেটে পড়ে/হায় কে দেবে দাম। সে সেথায় একডজন কামরাঙ্গা গাছ ছিল। এখন পুরো বাড়িতে ঘুরে মাত্র দুটি কামরাঙ্গা গাছ দেখতে পাবেন। একটি গাছে একটি ফলক লাগানো রয়েছে।
দুটি বড় আম গাছ নজরুলের স্মৃতির সঙ্গে জড়িত। পুকুরের দক্ষিণপাড়ে অবস্থিত আম গাছটির নিচে বসে নজরুল বাঁশি বাজাতেন। যদিও সে গাছটি আর নেই। কয়েক বছর আগে গাছটি মারা গেছে। গাছের গোড়াটি পাকা করে রাখা হয়েছে। আম গাছের সামনে রয়েছে একটি শান বাঁধানো ঘাট। এ পুকুরটি ছিল তার নিত্যদিনের সঙ্গী। কবি এখানে নিয়মিত সাঁতার কাটতেন। পাড়ার ছেলেমেয়েদের নিয়ে খেলতেন। পানিতে ডুব দিয়ে কলের গান বাজাতেন। কবি সাবান দিয়ে গোসল করার সময় পুরো পুকুর ফেনায় আচ্ছাদিত হয়ে যেত। কবি একবার পানিতে নামলে আর উঠতেই চাইতেন না।
পুকুরের পশ্চিমপাড়ে একটি আম গাছ দেখতে পাবেন। এ আম গাছটিতে এসে কবির মা (কবি আলী আকবর খাঁর নিঃসন্তান বোন ইফতেখারুন্নেছাকে মা ডাকতেন) খাবার নিয়ে এসে ডাকতেন আয় নুরু, খেতে আয়! তখন কবি গোসল সেরে বাড়িতে এসে ভাত খেতেন।
নজরুল যখন বিকালবেলা গাছের ছায়ায় শীতলপাটি বিছিয়ে কবিতা, গান রচনা করতেন, আলী আকবর খাঁ এর সঙ্গে গল্প করতেন, রূপকুমারী নার্গিস খানম নানা কাজের ছলে তখন ছুটে আসতেন। কবি ও কবির প্রিয়া চোখের ভাষায় ভাব বিনিময় করতেন। খাঁ বাড়ির পাশেই মুন্সী বাড়ি। আপনি সেখানে যাবেন। নার্গিস এ বাড়ির আবদুল খালেক মুন্সীর মেয়ে। বাল্যকালে নার্গিসের বাবা-মা মারা গেছেন। নার্গিস অধিকাংশ সময় মামার বাড়িতে থাকতেন।
সেখানে গিয়ে শুনবেন নজরুলের কবিতায় আটি গাঙ্গের কথা এসেছে। এটি দৌলতপুরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। বুড়ি নদী একটি, তবে কবি নজরুলের সেই আটি এখন খালে পরিণত হয়েছে। আটি নদীতে তিনি সাঁতার কেটেছেন। গোমতীতে নিয়মিত সাঁতার কাটার কোন সংবাদ পাওয়া না গেলেও গোমতীকে তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তাই তো তার কবিতায় এসেছে আজো মধুর বাঁশরী বাজে/গোমতীর তীরে পাতার কুটিরে/আজো সে পথ চাহে সাঁঝে।
নজরুলের দৌলতপুরে আগমন যেন নজরুলের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তেমনি বাংলা সাহিত্যের জন্যও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নজরুল দৌলতপুরে ৭৩ দিন অবস্থানকালে লিখেছেন ১৬০টি গান ও ১২০টি কবিতা। এগুলো নজরুলকে প্রেমিককবি হিসেবে পাঠক দরবারে পরিচিত করেছে। আর এ গান ও কবিতার বিষয় শুধুই নার্গিস। এখানেই ১৮ জুন ১৯২১ নজরুল-নার্গিসের বিবাহ সম্পন্ন হয়। বর্তমানে সেখানে আলী আকবর খাঁ মেমোরিয়াল স্কুলের বিল্ডিংটি অবস্থিত। এর পশ্চিমপাশে নজরুল-নার্গিসের বাসর হয়েছিল। বাসর ঘরে ব্যবহত খাট, পালঙ্ক ও নজরুল ব্যবহত কাঠের সিন্ধুকটিও এখনও সংরক্ষিত রয়েছে।
নজরুলের জবার্ষিকী অনুষ্ঠান সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য নজরুল মঞ্চ পালন করা হয়েছে। পাশে একটি পাঠাগারও রয়েছে। এদিকে আলী আকবর খাঁর বাড়িটিকে নজরুল জাদুঘর, বাসর ঘরটি নজরুল গবেষণাগার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি দীর্ঘদিনের হলেও তা প্রতিষ্ঠা হয়নি।
মানুষের জীবনের উজ্জ্বল সময় তার যৌবন। একজন কবির জীবনে এ সময়টি নক্ষত্রের মতো আলোকিত। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের যৌবনের কিছু সময় কেটেছে কুমিল্লার মুরাদনগরের দৌলতপুরে। বিদ্রোহী কবি দৌলতপুরে এসে হয়ে গেলেন প্রেমের কবি। কবির জীবনের গতিপথ বদলে দিল এক নারী। কবি নিজেই বলেছেন এক অচেনা পল্লী বালিকার কাছে এত বিব্রত আর অসাবধান হয়ে পড়েছি, যা কোন নারীর কাছে হয়নি।
এ বালিকাটি আর কেউ নয় সে হচ্ছে মুরাদনগরের বাঙ্গরা ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামের মুন্সী বাড়ির আবদুল খালেক মুন্সীর মেয়ে সৈয়দা খাতুন। কবি আদর করে ডাকতেন নার্গিস।
দৌলতপুরে যাওয়ার আগেই বাঙ্গরা পেরিয়ে দেখবেন নজরুল গেট। জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে সম্প্রতি নজরুল তোরণটি পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে।
নজরুল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ যুদ্ধ জাপান-জার্মান-ইতালির সঙ্গে অন্য পক্ষের দীর্ঘ পাঁচ বছর চলেছিল। নজরুল যুদ্ধে গিয়েছিলেন ১৯১৭ সালে। তিনি ব্যাটালিয়ন কোয়ার্টার মাস্টার ছিলেন। তখন ক্যাপ্টেন আলী আকবর খাঁর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ১৯১৯ সালে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। নজরুল তখন মুসলিম সাহিত্য সমিতির (কলকাতায়) অফিসে আফজাল-উল-হক সাহেবের সঙ্গে থাকতেন। সে সময় আলী আকবর খানের সঙ্গে নজরুলের হদ্যতা গড়ে ওঠে। আলী আকবর নজরুলের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাকে কুমিল্লায় তার গ্রামের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান।
নজরুল ৩ এপ্রিল ১৯২১ কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম মেইলে রাতে আসেন। আলী আকবর খাঁ নজরুলকে নিয়ে যান। ওঠেন কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে। এখানে তার সহপাঠী বন্ধু ইন্দ্র কুমার সেনের ছেলে বীরেন্দ্র কুমার সেনের বাড়িতে ওঠেন। এখানে বীরেন্দ্রের মা বিজয়া সুন্দরীদেবীকে নজরুল মা বলে সম্বোধন করতেন।
দুদিন বেড়ানোর পর ছয় এপ্রিল আলী আকবর খাঁ নজরুলকে নিয়ে মুরাদনগরের বাঙ্গরা ইউনিয়নের দৈলতপুরে নিয়ে আসেন। বর্তমানে যেখানে আলী আকবর মেমোরিয়াল ট্রাস্টের বিল্ডিংটি অবস্থিত। এখানে আরেকটি ঘর ছিল, এ ঘরেই নজরুলকে থাকতে দেয়া হয়। এ ঘরটি ৪৫ হাত দৈর্ঘ্য ও ১৫ হাত প্রস্থ ছিল। বাঁশের তৈরি আটচালা ঘরটির একেবারে পূর্ব পাশে নজরুল থাকতেন।
নজরুলের কক্ষটির পাশেই ছিল কামরাঙ্গা গাছ। কবি এ গাছকে নিয়েই লিখেছেন কামরাঙ্গা রঙ্গ লোকের পীড়ন থাকে/ঐ সুখের স্মরণ চিবুক তোমার বুকের/তোমার মান জামরুলের রস ফেটে পড়ে/হায় কে দেবে দাম। সে সেথায় একডজন কামরাঙ্গা গাছ ছিল। এখন পুরো বাড়িতে ঘুরে মাত্র দুটি কামরাঙ্গা গাছ দেখতে পাবেন। একটি গাছে একটি ফলক লাগানো রয়েছে।
দুটি বড় আম গাছ নজরুলের স্মৃতির সঙ্গে জড়িত। পুকুরের দক্ষিণপাড়ে অবস্থিত আম গাছটির নিচে বসে নজরুল বাঁশি বাজাতেন। যদিও সে গাছটি আর নেই। কয়েক বছর আগে গাছটি মারা গেছে। গাছের গোড়াটি পাকা করে রাখা হয়েছে। আম গাছের সামনে রয়েছে একটি শান বাঁধানো ঘাট। এ পুকুরটি ছিল তার নিত্যদিনের সঙ্গী। কবি এখানে নিয়মিত সাঁতার কাটতেন। পাড়ার ছেলেমেয়েদের নিয়ে খেলতেন। পানিতে ডুব দিয়ে কলের গান বাজাতেন। কবি সাবান দিয়ে গোসল করার সময় পুরো পুকুর ফেনায় আচ্ছাদিত হয়ে যেত। কবি একবার পানিতে নামলে আর উঠতেই চাইতেন না।
পুকুরের পশ্চিমপাড়ে একটি আম গাছ দেখতে পাবেন। এ আম গাছটিতে এসে কবির মা (কবি আলী আকবর খাঁর নিঃসন্তান বোন ইফতেখারুন্নেছাকে মা ডাকতেন) খাবার নিয়ে এসে ডাকতেন আয় নুরু, খেতে আয়! তখন কবি গোসল সেরে বাড়িতে এসে ভাত খেতেন।
নজরুল যখন বিকালবেলা গাছের ছায়ায় শীতলপাটি বিছিয়ে কবিতা, গান রচনা করতেন, আলী আকবর খাঁ এর সঙ্গে গল্প করতেন, রূপকুমারী নার্গিস খানম নানা কাজের ছলে তখন ছুটে আসতেন। কবি ও কবির প্রিয়া চোখের ভাষায় ভাব বিনিময় করতেন। খাঁ বাড়ির পাশেই মুন্সী বাড়ি। আপনি সেখানে যাবেন। নার্গিস এ বাড়ির আবদুল খালেক মুন্সীর মেয়ে। বাল্যকালে নার্গিসের বাবা-মা মারা গেছেন। নার্গিস অধিকাংশ সময় মামার বাড়িতে থাকতেন।
সেখানে গিয়ে শুনবেন নজরুলের কবিতায় আটি গাঙ্গের কথা এসেছে। এটি দৌলতপুরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। বুড়ি নদী একটি, তবে কবি নজরুলের সেই আটি এখন খালে পরিণত হয়েছে। আটি নদীতে তিনি সাঁতার কেটেছেন। গোমতীতে নিয়মিত সাঁতার কাটার কোন সংবাদ পাওয়া না গেলেও গোমতীকে তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তাই তো তার কবিতায় এসেছে আজো মধুর বাঁশরী বাজে/গোমতীর তীরে পাতার কুটিরে/আজো সে পথ চাহে সাঁঝে।
নজরুলের দৌলতপুরে আগমন যেন নজরুলের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তেমনি বাংলা সাহিত্যের জন্যও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নজরুল দৌলতপুরে ৭৩ দিন অবস্থানকালে লিখেছেন ১৬০টি গান ও ১২০টি কবিতা। এগুলো নজরুলকে প্রেমিককবি হিসেবে পাঠক দরবারে পরিচিত করেছে। আর এ গান ও কবিতার বিষয় শুধুই নার্গিস। এখানেই ১৮ জুন ১৯২১ নজরুল-নার্গিসের বিবাহ সম্পন্ন হয়। বর্তমানে সেখানে আলী আকবর খাঁ মেমোরিয়াল স্কুলের বিল্ডিংটি অবস্থিত। এর পশ্চিমপাশে নজরুল-নার্গিসের বাসর হয়েছিল। বাসর ঘরে ব্যবহত খাট, পালঙ্ক ও নজরুল ব্যবহত কাঠের সিন্ধুকটিও এখনও সংরক্ষিত রয়েছে।
নজরুলের জবার্ষিকী অনুষ্ঠান সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য নজরুল মঞ্চ পালন করা হয়েছে। পাশে একটি পাঠাগারও রয়েছে। এদিকে আলী আকবর খাঁর বাড়িটিকে নজরুল জাদুঘর, বাসর ঘরটি নজরুল গবেষণাগার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি দীর্ঘদিনের হলেও তা প্রতিষ্ঠা হয়নি।
