রক্তাক্ত একাত্তরঃ দেবিদ্ধারের রণাঙ্গণ ও কিছু কথা



রক্তাক্ত একাত্তরঃ দেবিদ্ধারের রণাঙ্গণ ও কিছু কথা
রক্তাক্ত একাত্তরঃ দেবিদ্ধারের রণাঙ্গণ ও কিছু কথা
✌দেশ জাতির প্রয়োজনে সবসময় এগিয়ে এসেছে দেবিদ্ধারের জনগণ। শুধুমাত্র মাত্র স্বাধীনতা যুদ্ধে নয় ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে দেবিদ্ধারবাসীর অবদান অবিস্মরনীয়। বিশেষ করে কিশোরি কণ্যা সুনীতি ১৯৩১ সালের ১৪ ডিসেম্বর কুমিল্লায় প্রকাশ্য দিবালোকে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বৃটিশ জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মি: স্টিভেন্সকে হত্যার মাধ্যমে বীরত্বের পরিচয় দেয়। ১৯৭১ সালে দেবিদ্ধারের আবাল বৃদ্ধ-বনিতা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে ডিসেম্বর দেবিদ্ধারকে মুক্ত করেছেন। এক জরিপে দেখা যায়- বাংলাদেশে উপজেলাভিত্তিক হিসেব অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যার বিচারে দেবিদ্ধারের স্থান দ্বিতীয়। কুমিল্লা জেলায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা সাড়ে হাজার। এর মধ্যে দেবিদ্ধারেই রয়েছেন ১৯০০ জন। ইউনিয়ন হিসেবে সর্বাধিক মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে ফতেহাবাদে।দেবিদ্ধারের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ন্যাপ সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর অবদান বেশী। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই তারা পাকিস্তানীদের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে তৎপর ছিলেন।কুমিল্লা জেলা ন্যাপের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক খলিলুর রহমান ফরিদ বলেন-২৫ মার্চ রাতে কুমিল্লা শহরের প্যানরোমা থেকে ঢাকায় অবস্থানরত অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের বাসায় ফোন করি। ফোন রিসিভ করেন বেগম আমেনা আহমেদ(বর্তমান মহিলা সাংসদ) তিনি বলেন -প্রফেসর সাহেব বাসায় নেই। রাত ১০ টার দিকে বেড়িয়ে গেছেন। তিনি আরো জানান,রাজারবাগ পুলিশ লাইন বিডিআর ক্যাম্পে আগুন জ্বলছে। শহরের রাস্তায় রাস্তায় গোলাগুলি চলছে। তিনি ন্যাপের কর্মীদের উদ্দেশ্যে দিয়ে বলেন, তোমরা সাবধানে থেকো।
এখানকার উল্লেখযোগ্য যোদ্ধারা ছিলেন-হালিম মুন্সি,আওলাদ হোসেন,রেহান উদ্দীন,সালাইদ্দীন,আবুল কাশেম।এছাড়া আরও ছিলেন মনিরুজ্জামান,সামাদ,হুমায়ুন কবির মজুমদার,গোলাম ফারুক প্রমূখ। গ্রপের কমান্ডার ছিলেন বর্তমানে সিঙ্গাপুরস্থ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধে আঞ্চলিক সংবাদপত্রের ভুমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। তখন ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের পরিচালনায় প্রকাশিত হতো সাপ্তাহিক নতুন বাংলা পত্রিকা প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা খলিলুর রহমান তার যুদ্ধকালীন স্মৃতি বর্ননা করেন: সে দিন ছিল ১১ সেপ্টেম্বর ।ভীষণ জ্বর পায়ের ব্যাথায় অসহ্য,ডাক্তার বলেছেন বেড রেস্টে থাকার জন্য। ওই অবস্থায় : হাফিজ দুটি পত্রিকার বান্ডেল হাতে দিয়ে ভারতের সোনামুড়া থেকে দেবিদ্ধারের এলাহাবাদে পৌছে দেয়ার নির্দেশ দেন।কুমিল্লা শহরের নিকটবর্তী ভরাসার বাজারে আসার পর ভীষণ গোলাগুলি শুরু হয়।সেখান থেকে পালিয়ে ফতেহাবাদে মোনায়েম সরকারের বাড়ি পৌঁছেন।সুলতানপুর বাজারে এসেও তিনি গোলাগুলির মধ্যে পড়েন।অনেক কষ্টে বিকেল বেলা এলাহাবাদে এসে পৌঁছলে তাকে সবাই ঘিরে ধরেন। তারা মনে করেছিলেন গোলাগুলিতে তিনি মারা গেছেন। তখন থানাভিত্তিক মুক্তিযোদ্ধা দলগুলোর প্রতি নির্দেশ ছিল আঘাত এলে পাল্টা আঘাত করতে হবে। আঘাত না এলে আঘাত করার নির্দেশ ছিলনা। স্থানীয় ছাত্র কৃষকসহ সর্বশ্রেণীর লোকজনের মাঝে মনোবল ঠিক রাখার নির্দেশ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি।পাকিস্তানী আর্মি যাতে সহজে যাতয়াত করতে না পারে সেজন্য রাস্তায় ব্যারিকেড দিত থানাভিত্তিক মুক্তিযোদ্ধারা।
কুমিল্লা ছিল ২নং সেক্টরের অধীন। দেবিদ্ধারর বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল। তবে এগুলো সবসময় স্থায়ী হতোনা। পাক-বাহিনীর আক্রমণের আশঙ্কায় মাঝে মাঝে ক্যাম্প গুটিয়ে ফেলতে হতো। নিম্নে কয়েকটি ক্যাম্পের বিবরণ দেয়া হলো।
✌নলআরা ক্যাম্প:ফতেহাবাদের নলআরায় এপ্রিল ক্যাম্প স্থাপিত হয়। প্রাদেশিক সরকারের সচিব আব্দুল মান্নান সরকারের উদ্যোগে ৫০ জনকে নিয়ে প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপিত হয়। তাদের হাতিয়ার ছিল লাঠি,থ্রি নট থ্রি রাইফেল এয়ারগান। তৎকালীন সীমান্ত রক্ষীবানিীর সদস্য বীর প্রতিক মুকুল হোসেন,বীর প্রতিক নজরুল ইসলাম,হাবিলদার : মজিদ,হাবিলদার আবদুল মালেক, প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।তবে নলআরার ক্যাম্পটি দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। পাঞ্জাবীদের হামলার আশংকায় অল্প কিছুদিনের মধ্যে এটি এলাহাবাদে স্থানান্তরিত হয়।
এলাহাবাদ ট্রানজিট ক্যাম্প: ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের বাড়িতে ট্রানজিট ক্যাম্পের হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয়।এখান থেকে যাচাই বাছাই করে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠানো হতো।সোনামুড়া তমশাবাড়িতে ছিল ন্যাপ,কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র বাহিনিীর ক্যাম্প।এ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ন্যাপ নেতা ফয়েজ উল্লা।১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনের মাস পরও এলাহাবাদের ক্যাম্পটি চালু ছিল।পরবর্তীতে এখানে রক্ষিত অস্ত্র ময়নামতি সেনানিবাসে জমা দেয়া হয়।
দেবিদ্ধারের কতজন মুক্তিযোদ্ধা/সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন এর সঠিক হিসেব পাওয়া যায়না। দেবিদ্ধার নিউ মার্কেটে ৪৮ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম মুক্তিযোদ্ধা স্মরণীতে লিখা থাকলেও ৩৩ জন শহীদ গনযোদ্ধার নাম এখানে স্থান পায়নি। শহীদদের মধ্যে ¯ল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোদ্ধা বাদেও সশস্ত্র বাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোদ্ধাও ছিলেন।৪ ডিসেম্বর মিত্র বানিীর মেজর পান্ডে ক্যাপ্টেন সুজাত আলীর নিকট চান্দিনা হাইস্কুর মাঠে ১৪/১৫শ পাকিস্তানী সৈন্যেও আত্মসমর্পনের মাধ্যমে দিবিদ্ধার শত্রমুক্ত হয়।
মমিনুল ইসলাম মোল্লা




শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.