বিনা কারণে গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখবেন না



যুগ যুগ ধরে দেশের গ্রামাঞ্চলে রান্নার কাজে কাঠ, খড়কুটো, নাড়া, শুকনা গোবর ব্যবহার হয়ে আসছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ৩ কোটি ৯০ লাখ টন এ-জাতীয় জ্বালানির প্রয়োজন। জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার করায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ বনজ সম্পদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। গোবর জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করায় কৃষিতে জৈবসারের অভাব হচ্ছে। এছাড়া কৃষিজমির পরিমাণ দিন দিন কমে যাওয়ায় এ জ্বালানিসংকট মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। ফলে রান্নার কাজে গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে। গ্রামের লোকজনসহ শহরের সবাই প্রাকৃতিক গ্যাসে রান্না করতে চায়। প্রধানমন্ত্রী গত ৭ মে বাসাবাড়িতে গ্যাস সংযোগ দেয়ার অনুমতি দিয়েছেন।
২০১০ সালের ২১ জুলাই শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়। এছাড়া ২০১০ সালের ১৩ জুলাই আবাসিকে গ্যাস সংযোগ নিষিদ্ধ করা হয়। চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল হাইকোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে আবাসিকে গ্যাস সংযোগ দেয়া শুরু হলো। জানা যায়, দেশের মাত্র ১০-১২ শতাংশ লোক প্রাকৃতিক গ্যাসে রান্নাবান্নার সুযোগ পাচ্ছে। দেশে উৎপাদিত গ্যাসের ৩৯ শতাংশ গ্রিড বিদ্যুতে, ১৬ শতাংশ ক্যাপটিভ বিদ্যুতে, ১০ শতাংশ সার কারখানায়, ১৭ শতাংশ শিল্পে, ১২ শতাংশ গৃহস্থালিতে ও ৫ শতাংশ সিএনজি যানবাহনে ব্যবহার হচ্ছে। বলা হয়েছে, আবাসিকে সংযোগের ক্ষেত্রে নতুন লাইন বসানো যাবে না। যেখানে আগে থেকেই লাইন রয়েছে, সেখানে নতুন সংযোগ দেয়া যাবে। পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৫৮ হাজার অবৈধ সংযোগ রয়েছে। এগুলো বৈধ করা হবে এবং এ খাতে সরকার ৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের রাজস্ব পাবে। আবাসিক গ্যাস সংযোগের জন্য যারা আগেই আবেদন করেছেন এবং অর্থ জমা দেয়ার পর যাদের আবেদন বিবেচিত হয়েছে, তারাও সুযোগ পাবেন। নতুন সংযোগ দেয়ার পর ২২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন হবে।
অর্থমন্ত্রী কিছুদিন আগেও আবাসিকে গ্যাস সংযোগের বিপক্ষে ছিলেন। তিনি বলেন, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এ খাতে অপচয় হ্রাস করতে হবে; ব্যবহারেও সাশ্রয়ী হতে হবে। এজন্য বাসাবাড়িতে গ্যাস সংযোগ দেয়া উচিত নয়। তিনি এলপিজিকে এক্ষেত্রে অধিক উপযোগী বলে মনে করেন। প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল উপাদান মিথেন হলেও (৯৭%) এর সঙ্গে অল্প পরিমাণ প্যারাফিন, হাইড্রোকার্বন ( যেমন— ইথেন, প্রপেন, বিউটেন, পেন্টেন, হেক্সেন) ইত্যাদি থাকে। এছাড়া সামান্য পরিমাণে আছে নাইট্রোজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, হাইড্রোজেন সালফাইড ইত্যাদি। বাসাবাড়িতে অপচয় রোধের জন্য গ্যাস রিডিং মিটারের ওপর অনেকেই গুরুত্বারোপ করছেন। লিকুইফায়েড পেট্রোলিয়াম বা এলপি গ্যাস বাসাবাড়িতে ব্যবহার করা ভালো। বিশ্বের বহু দেশ এ প্রযুক্তি কাজে লাগাচ্ছে। এ গ্যাস সিলিন্ডারে করে যেকোনো জায়গায় নেয়া যায়। পাইপলাইনেরও প্রয়োজন হয় না। এ গ্যাস নগদ টাকা দিয়ে সীমিত আকারে কিনতে হয় বলে এর অপচয় কম। রান্নাবান্নার ব্যাপারে গৃহিণীরা সচেতন থাকায় অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহার হয় না।
প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর চাপ কমাতে হলে এর বিকল্প খুঁজতে হবে। গ্যাসের বিকল্প হিসেবে পাঁচটি কয়লাখনি রয়েছে। এগুলোয় ৩০০ কোটি টন কয়লা রয়েছে। সবই উন্নত মানের বিটুমিনাস কয়লা। এর মধ্যে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে উত্তোলনযোগ্য ১৮০ কোটি টন। এ কয়লা দিয়ে ৫০ বছর ধরে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উৎপাদন করা যাবে। বিদ্যুত্ খাতে মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৫ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। বায়োগ্যাসের মাধ্যমে রান্না ও বাতি জ্বালানো দুটিই সম্ভব। এ গ্যাস হলো পচনশীল জৈব বস্তু থেকে তৈরি। যেকোনো প্রাণীর বিষ্ঠাই এর কাঁচামাল। প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে মানুষ, পশু-পাখির বিষ্ঠা থেকে এ গ্যাস তৈরি করা সম্ভব। এছাড়া বাড়িঘর কিংবা রাস্তাঘাটের ময়লা আবর্জনা পচিয়ে এ গ্যাস তৈরি করা যায়। এতে অধিকাংশই থাকে মিথেন। অবশিষ্টাংশ জৈবসার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। নীলফামারীর আবু সুফিয়ান বায়োগ্যাসকে প্রাকৃতিক গ্যাসে রূপান্তর করে বিস্ময় সৃষ্টি করেছেন। তিনি ফোর স্ট্রোকবিশিষ্ট প্রাইভেটকার চালিয়ে দেখিয়েছেন। তার বাড়িতে ব্যবহূত ৪ লাখ টাকা ব্যয়ে বায়োগ্যাসের টেস্ট প্যানেল প্রকল্প থেকে তিন মাসের মধ্যে সাফল্য পেয়েছেন তিনি। সরকারিভাবে এ ধরনের প্রকল্প চালু করে প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর চাপ কমানো যেতে পারে। আবু সুফিয়ান জানান, তিনি বর্তমানে ১৮টি গরুর বর্জ্য থেকে ১০ কিউবিক মিটার গ্যাস পাচ্ছেন। ১০০টি গরুর বর্জ্য দিয়ে বায়োগ্যাস প্লান্ট করলে ১০০ বাড়িতে বিদ্যুত্ ও ১০০ পরিবারে রান্না করা সম্ভব। বুয়েটের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন জানান, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বায়োগ্যাসের প্লান্ট করতে পারলে দেশের জ্বালানির ওপর চাপ কমবে।
বর্তমানে যানবাহনে পেট্রলের পবিবর্তে গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে।  এক্ষেত্রে ড. শওকত হোসেনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পরিবেশদূষণের অজুহাতে ২০০১ সাল থেকে দেশে আসতে থাকে চার স্ট্রোকবিশিষ্ট যানবাহন। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতায় সারা দেশে সিএনজিচালিত গাড়ি আমদানি হতে থাকে। ১ কিউবিক মিটার সিএনজিতে একটি বাস ১ দশমিক ৩ কিলোমিটার চলতে পারে। সারা দেশে সিএনজিচালিত গণপরিবহন রয়েছে ২০ হাজার। এছাড়া ব্যক্তিগত ব্যবহারে রয়েছে আরো কয়েক হাজার। এগুলোয় প্রতিদিন কী পরিমাণ গ্যাস যাচ্ছে এর হিসাব কে রাখে? সবাই সিএনজির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ধোঁয়া নেই, চোখ জ্বলে না, গ্রামের সাধারণ রাস্তায়ও চলাচল করতে পারে। হঠাত্ করেই সিএনজিচালকদের এ সুখে আগুন দিলেন নীতিনির্ধারকরা; তারা কয়েক দফায় বাড়িয়ে দিলেন সিএনজির দাম।
দেশে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুত্ ও
গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। বিদ্যুতে ঘাটতি দৈনিক ৫০০ মেগাওয়াট, গ্যাসে প্রায় ৪৮০ মিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুত্ সুবিধা পাচ্ছে। বর্তমানে গড়ে উৎপাদন হয় ২ হাজার ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। সিএনজি খাতে দেশের ৫ শতাংশ গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে। এ গ্যাস বাঁচানো গেলে হয়তো সংকট এতটা থাকত না। দেশের স্বার্থে আমাদের কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সম্ভাবনাময় গ্যাস ব্লকগুলো একযোগে ইজারা দেয়া যাবে না। দেশে যে পরিমাণ চাহিদা আছে তার চেয়ে বেশি গ্যাস যাতে উত্তোলন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের চেষ্টা আরো জোরদার করতে হবে। সরকারির পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগকেও স্বাগত জানাতে হবে। তবে অনুসন্ধান কাজ যেন পুরোপুরি বিদেশনির্ভর না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বর্তমানে বাসাবাড়িতে গ্যাসসংকট এবং শিল্প-কারখানাসহ বিদ্যুত্ ও সার কারখানায় গ্যাসের অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। প্রাকৃতিক গ্যাস নবায়নযোগ্য জ্বালানি নয়। যতটুকু শেষ হয়ে গেল তা আর পূরণ করা সম্ভব নয়। এক হিসাবে দেখা যায়, বাংলাদেশে যে পরিমাণ গ্যাস মজুদ রয়েছে তা বর্তমান হারে ব্যবহূত হলে আগামী ১০-১২ বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। এ কথা সত্য, আগামীতে আরো গ্যাস পাওয়া যাবে, কিন্তু অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশায় বর্তমানে গ্যাসের অপচয় করা যুক্তিসঙ্গত নয়। আমরা যদি চন্দন কাঠ পুড়িয়ে চা বানাই, তাহলে কাঠের সদ্ব্যবহার করা হয় না। তাই আমাদের বহু মূল্যবান সম্পদ গ্যাসকে কোন খাতে আমরা কাজে লাগাব, তা ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
লেখক: প্রভাষক maminmollah@yahoo.com


শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.