😌 কন্যাশিশুরাও জাতির ভবিষ্যৎ

 😌বাংলাদেশের শিশুদের অর্ধেকই কন্যাশিশু। তাদের কুসুমিত হওয়ার সুযোগ না দিলে জাতি হিসেবে আমাদের এর খেসারত দিতে হবে। বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারের কন্যাসন্তানরা অবহেলিত হচ্ছে। তারা মনে করেন, পুত্রসন্তান তাদের জন্য সহায়ক। তাই তারা কন্যাসন্তানের প্রতি উৎসাহী নন। বাংলাদেশে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান ধর্মের লোক বসবাস করে। এসব ধর্মে নারীর চেয়ে পুরুষকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত কিছু কিছু উপজাতিতে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ লক্ষ্য করা যায়। 

   

কন্যাশিশুরাও জাতির ভবিষ্যৎ😌

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর তেমন স্বাধীনতা থাকে না। পুরুষের নির্দেশ অনুসরণ করাই তাদের কাজ। তাই এখানে ছেলেসন্তানের কদর বেশি। আমরা আমাদের বংশরক্ষা করতে চাই। ছেলেসন্তানের মাধ্যমেই বংশরক্ষা করা সহজ। কন্যাসন্তানের মাধ্যমে তা হয়তো সেভাবে রক্ষা হয় না। তাই সবাই চায় পুত্রসন্তান। ফলে কন্যাসন্তানরা অবহেলিত হচ্ছে। ৩০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে জাতীয় কন্যাশিশু দিবস পালিত হয়। কন্যাশিশুদের প্রতি অবহেলা রোধ এবং যথাযথভাবে তাদের বেড়ে ওঠার সুযোগদানে সহায়তা করাই এ দিবস পালনের লক্ষ্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, কন্যা দিবসে কন্যাদের ব্যাপারে বহু কথা বলা হয়, কিন্তু পরবর্তী সময়ে এ চেতনা ধীরে ধীরে কমে যায়। এ ব্যাপারে সরকার উদারনীতি গ্রহণ করলেও পারিবারিকভাবে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এছাড়া বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষিকাজে পুত্রসন্তানই পিতার সহায়ক। তাই পুত্রসন্তানের চাহিদা বেশি। কন্যাসন্তান জন্ম নিলে তাদের আশাভঙ্গ হয়। এ ধরনের পরিবারে কন্যাসন্তান জন্ম দেয়া পাপের শামিল। মনে হয়, মা যেন মহাপাপ করেছেন। কন্যাশিশুটি বোধ হয় সবার জন্য কোনো অশুভ বার্তা নিয়ে এসেছে। তাই সন্তান জন্মাবার পরপরই দাদা-দাদি, বাবা-কাকা, খালা-ফুফুদের মুখের হাসি মিলিয়ে যায়, সবাই হতভম্ব হয়ে যায়। মায়ের সঙ্গে কেউ হাসিমুখে কথা বলেন না। পরিস্থিতি অাঁচ করতে পেরে মাও কেঁদে ফেলেন। তাদের ধারণা- বৃদ্ধ বয়সে মা-বাবাকে ছেলেরাই দেখে। কারণ তারা চাকুরি অথবা ব্যাবসা-বাণিজ্য করে অর্থ উপার্জন করে পিতার ভিটিতে অবস্থান করে বৃদ্ধ মা-বাবার সেবা শুশ্রুষা করবে। তাদের চিন্তা একেবারে অমূলক নয়। মানুষের জীবনে এমন একটি সময় আসে যখন সন্তানের ওপর তাকে নিভর্রশীল হতে হয়। কিন্তু আপনার ছেলেই যে আপনার বিপদের দিনের সঙ্গী হবে, এমন গ্যারান্টি কে দেবে? অল্লাহ যেহেতু নারীজাতিকে অবহেলা করেননি, আমরা তার বান্দা হয়ে নাফরমানি কাজ করতে যাব কেন? পবিত্র কোরআন শরীফে ১১৪টি সুরা আছে। পুরুষদের জন্য আলাদা কোনো সুরা নেই। কিন্তু নারীদের ব্যাপারে একটি আলাদা সুরা আছে, সেটি হচ্ছে সুরা নিসা। তিনি বলেছেন- 'তোমরা নারীদের পোশাকস্বরূপ, নারীরাও তোমাদের পোশাকস্বরূপ।' কন্যাসন্তানের ব্যাপারে বলা হয়েছে- 'জমিন ও আসমানের বাদশাহীর অধিকর্তা আল্লাহ। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান দান করেন। আর যাকে ইচ্ছা কন্যা ও পুত্র উভয়টিই দেন এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন।' এছাড়া সম্পত্তির ব্যাপারে সুরা নিসায় বলেন- 'তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে আল্লাহ এই বিধান দিচ্ছেন যে, একজন পুত্রের অংশ দুজন কন্যার সমান হবে। যদি কন্যার সংখ্যা দুয়ের অধিক হয় তবে তারা পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ পাবে, আর যদি মাত্র একটি কন্যাসন্তান থাকে তাহলে সে অর্ধেক পাবে-মৃতের ঋণ পরিশোধ ও অছিয়ত পূরণ করার পরে।' তবে ইসলাম নারীকে মর্যাদা কম না দিলেও কন্যা ও ছেলেসন্তানের মধ্যে পার্থক্য বজায় রেখেছে । দুজনকে সমান দায়িত্ব ও কর্তব্য দেয়া হয়নি। মূলত সংসার চালানো ও নির্ভরশীলদের ব্যাপারে কর্তাব্যক্তিকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ইসলাম ধর্মের বিধান অনুযায়ী সন্তান জন্মগ্রহণের পর তার আকিকা করতে হয়। তৎকালীন সময়ে ইহুদিরা কন্যাসন্তানের জন্য কোনো আকিকা করত না। এ ব্যাপারে মুহম্মদ (সা.) কে সাহাবারা জিজ্ঞাসা করলে তিনি তাদের ছেলে হলে সমবয়সী দুটি ছাগল ও মেয়ে হলে একটি ছাগল দিয়ে আকিকা করতে নির্দেশ দেন। রাসূল (সা.) হাসান (রা.) ও হুসাইন (রা.) এর জন্য দুটি করে ভেড়া দিয়ে আকিকা করেন। জন্মের সপ্তম দিনে তা করে মাথা ন্যাড়া করেন। একথা সত্যি যে, বাংলাদেশের বর্তমান পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী পুত্রসন্তানের চেয়ে কন্যাসন্তান লালন-পালন, সঠিকভাবে শিক্ষিত করে সৎপাত্রে দান করা কষ্টকর। কিন্তু ছেলেসন্তান হলে এগুলো নিয়ে তেমন একটা ভাবতে হয় না। তবে এ পরিস্থিতির জন্য তো আর কন্যাসন্তানরা দায়ী নয়। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেছেন, 'এসেছে নতুন শিশু তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান- নবজাতকের জন্য এ পৃথিবী বাসযোগ্য করে যাব এই হোক মোর অঙ্গীকার।' বাংলাদেশ সংবিধানের ১০ নাম্বার ধারায় বলা হয়েছে, 'জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।' বাংলাদেশে মুসলমানদের পরই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের স্থান। এ ধর্মেও কন্যাসন্তনের চেয়ে পুত্রসন্তানকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। তাদের উত্তরাধিকার আইন হিন্দু আইন নামে পরিচিত। এটি তাদের ধর্মীয় ও ব্যক্তিগত অইন। যারা জন্মসূত্রে হিন্দু, তাদের জন্য এ আইন প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে 'দায়ভাগ' ও অন্যত্র 'মিতক্ষরা' পদ্ধতি চালু রয়েছে। যে ব্যক্তি পি- গ্রহণ করে এবং যে ব্যক্তি পি-দানে অংশগ্রহণ করে তারা মৃতের সম্পত্তির উদত্তরাধিকারী হয়। সে ক্ষেত্রে কারো যদি এক কন্যা থাকে এবং সে কন্যার যদি পুত্র থাকে, তাহলে সে নানার সম্পত্তি পাবে। অর্থাৎ, স্ত্রী /কন্যা সম্পত্তি ভোগ করতে পারবে কিন্তু এগুলোর মালিক বা হস্তান্তর করতে পারবে না। তাই বংশরক্ষার জন্য হিন্দুরাও পুত্রসন্তান প্রত্যাশা করে। রাষ্ট্রীয়ভাবে কন্যাসন্তানের মর্যাদা বৃদ্ধি করা হলেও পারিবারিক অবহেলার কারণেই তারা এগোতে পারছে না। যখন পিতা বুঝতে পারেন তাদের অতিথি মেয়ে, তখন থেকেই অবহেলা শুরু হয়। তবে প্রথম সন্তান যদি ছেলে হয় দ্বিতীয় সন্তান মেয়ে হলে হয়তো কেউ আপত্তি করেন না। কিন্তু প্রথম সন্তান যদি মেয়ে হয় অথবা মেয়ে যদি ধারাবাহিকভাবে চলতেই থাকে তাহলে মেয়েরা অধিক অবহেলার শিকার হয়। কোনো কোনো পরিবারে দেখা যায় ছেলেশিশুর জন্য মায়ের দুধের পাশাপাশি বিকল্প খাবার হিসেবে উন্নতমানের দুধ বা ভিটামিনজাতীয় খাবার দেয়া হয়। কিন্তু কন্যাসন্তানের ক্ষেত্রে রহস্যজনক নিরবতা লক্ষ্য করা যায়। 'কোনোরকমে বেঁচে থাকলেই হলো' এমন একটি ভাব তাদের মধ্যে বিরাজ করে। শিক্ষাক্ষেত্রেও দেখা যায় বৈষম্য। ছেলেটাকে কোন স্কুলে পড়াবে? ইঞ্জিনিয়ারিং না মেডিকেল, বর্ণমালা শেখার আগেই এ চিন্তা তাদের মাথায় আসে। কিন্তু মেয়ের ক্ষেত্রে এ ধরনের তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় না। শুধু খাদ্য আর শিক্ষাই নয়- বস্ত্র, অবসর, বিনোদন প্রতিটি ক্ষেত্রেই বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। এ বৈষম্য কোনো কোনো সময় নির্যাতনে পরিণত হয়। পারিবারিকভাবেই নয়, সামাজিকভাবেও কন্যাশিশুরা নির্যাতিত হচ্ছে। কন্যাসন্তানের প্রতি যত্ন না নিলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কেননা দেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী। আমরা হাত দিয়ে কাজ করি। এক হাত দিয়ে কোনরকমে কাজ চললেও দুহাতের সমান কাজ করা যায় না। তাই দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে অবহেলা, বৈষম্য আর নির্যাতনের মধ্যে রেখে জাতীয় উন্নয়ন কখনো সম্ভব নয়। এজন্য কন্যাশিশুর বিকাশে যেসব সমস্যা রয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করে তা দূর করতে হবে। 'ছেলে-মেয়ে সমানে সমান' এই হোক এবারের কন্যাশিশু দিবসের অঙ্গীকার। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলমান। ইসলাম ধর্মে মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্য সন্তানদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে- 'তোমাদেরকে শৈশবে তারা যেভাবে লালন পালন করেছেন, তোমরাও তাদের প্রতি তেমনি সদয় হও। তাদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করোনা যাতে তারা বিরক্ত হয়ে উহঃ শব্দটি উচ্চারণ করে।' তাহলে দেখা যায়- মা-বাবাকে দেখার দায়িত্ব শুধু ছেলেদেন নয়, মেয়েদেরও সমান দায়িত্ব রয়েছে। তাই ছেলেটি আপন- মেয়েটি পর, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। কেউ কেউ মনে করেন, মেয়েরা হচ্ছে সংসারের অতিথি। দুদিন পর সে চলে যাবে। তাই তার প্রতি অতিরিক্ত যত্ন নেয়ার প্রয়োজন নেই। পুরুষশাসিত সমাজে বিয়ের পর মেয়েদের স্বামীর সংসারে চলে যেতে হয়। এটাই স্বাভাবিক। কারণ পুরুষশাসিত সমাজে মেয়েরা পরনির্ভরশীল। তাদের জীবনের সুখ শান্তি তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত। প্রথমত : পিতার মর্জির ওপর তাকে চলতে হয়। দ্বিতীয়ত : বিয়ের পর স্বামীর ইচ্ছার কাছে তাকে সপে দিতে হয়। তৃতীয়ত : বৃদ্ধ বয়সে সে সম্পূর্ণভাবে ছেলের ওপর নির্ভরশীল। তিনটি পর্যায়ে সুখ-শান্তি পাওয়া খুবই ভাগ্যের ব্যাপার। মমিনুল ইসলাম মোল্লা: শিক্ষক ও কলাম লেখক

শেয়ার করুন