স্মরণঃ জ্ঞানের আলো সোনাকান্দার পীর সামছুল হুদা

 —–মমিনুল ইসলাম মোল্লা

প্রতি বছর ১৪ ও ১৫ ফাল্গুন কুমিল্লার মুাদনগরের সোনাকান্দায় বার্ষিক ইছালে ছাওয়াবের মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
এ মাহফিল নিয়মিতভাবে শুরু করেছিরেন আবু বকর শামছুল হুদা পীর সাহেব। তিনি ২০০৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ইন্তেকাল করেন। বার্ষিক মাহফিলে প্রতি বছর তাঁর রুহের মাগফেরাতের জন্য বিশেষ দোয়া করা হয়। আমরাও তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। তিনি সোনাকনাদা দারুল হুদা দরবার শরীফের প্রতিষ্ঠাতা হাফেজ মাওলানা আঃ রহমান হানাফী ( রঃ) এর সুযোগ্য পুত্র ছিলেন। জনাব হুদা পিতার প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শ্রীবৃদ্ধি , নতুন প্রতিষ্ঠান স্থাপন, ও ওয়াজ নছিয়তের মাধ্যমে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি ছিলেন তাঁর পিতার ২য় ছেলে। বড় ভাই আঃ আাউয়াল মারা যাওয়ার পর ১৯৩৪ ইং তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। তাই শৈশবে অত্যন্ত যতেœর সাথে তিনি লালিত পালিত হন। সোনাকান্দা ফোরকানিয়া মাদ্রাসার মাধ্যমে তার প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শুরু হয়। ফতেহাবাদ জুনিয়র হাইস্কুল থেকে( নিউ স্কিম জুনিয়র মাদ্রাসায়) ৬ষ্ঠ শ্রেণি পাশ করে গোপালনগর হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে ১৯৫৭ সালে তিনি মেট্রিক পাশ করেন। তারপর (মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে সোনাকান্দা মাদ্রাসা -কেন্দ্র ঢাকা) ১৯৬২ সালে দাখিল পাশ করেন। তারপর বুড়িচং হরিমঙ্গল ফাজিল মাদ্রাসা থেকে আলিম,(১৯৬৪) ফাজিল (১৯৬৬) পাশ করেন। তারপর ফরিদগঞ্জ আলিয়া মাদ্রাসায় কামিল ক্লাশে ভর্তি হয়েও পিতার ইন্তেকাল ও টাইফয়েড জ্বরের কারণে তিনি পরীক্ষা দিতে পারেননি।পীর সাহেব জনাব আঃ রহমান হানাফি এর জীবদ্দশায়ই তিনি তরিকতের খেলাফতপ্রাপ্ত হন। এসময় তিনি তাফসির, ফিকা ও আরবি সাহিত্যে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি বহুবার হজ্জে যান এবং সৌদি আরবের সৈয়দ আলভী মালেকির কাছে তিনি হাদিস , তাফসীর ও আরবি সাহিত্যে ব্যক্তিগতভাবে দারস নেন। তিনি ব্যক্তি জীবনে এগুলোর প্রতিফলন ঘটান।
পিতা মারা যাওয়ার পর তিনি লেখাপড়া শেষ না করেই সংসার ও দরবার পরিচালনার দায়িত্ব নেন। তিনি সোনাকান্দা মাদ্রাসায় লিল্লা বোর্ডিং চালু করেন। আগে শুধু মাত্র হাদিস গ্রুপে কামিল পড়ার ব্যবস্থা ছিল। তিনি হাদিস ছাড়াও ফিকাহ, তাফসীর ও ফেকাহ সাহিত্যে কামিল পড়ার ব্যবস্থা করেন। কুমিল্লা জেলার মধ্যে অন্য কোন মাদ্রাসায় ফোর টাইটেল পড়ার ব্যবস্থা নেই বলে মাদ্রাসার ছাত্র আঃ মালেক জানান। ১৯৮৫ সালে কেন্দ্রিয় পরীক্ষার সেন্টার স্থাপন, নূরাণী মাদ্রাসা, ও হেফজ বিভাগ চালু, ছাত্র- শিক্ষকদের খাওয়ার ব্যবস্থা বিভিন্ন যায়গায় তালিমি সেন্টার , মসজিদ মাদ্রাসা স্থাপনও কুতুবখানায় বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি করেন। মুরাদনগরের মোচাগড়ার ছিদ্দিকুর রহমান হোছামীর কন্যা সৈয়দা সেলিনা আক্তারের সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার মাতা সাহেরা খাতুনের অনুপ্রেরণায় তিনি পূর্ণ উদ্যোমে কাজ করেন। পিতা মারা যাওয়ার সময় কামিল হাদিসে ৭জন ছাত্র ফরম ফিলাপ করেছিল, তাদের ফরমগুলো বুকে নিয়ে অশ্রুসজল নয়নে তাদের জন্য তিনি দোয়া করেন। এটি তার হৃদয়ে দীর্ঘদিন দাগ কাটে। পরের বছর তার তত্তাবধানে ৯ জন ছাত্র কামিল পরীক্ষা দিয়ে ৯জনই উত্তীর্ণ হওয়ায় তিনি আনন্দে আপ্লুত হন। তিনি বিশ্ব জমিয়াত তালিমে হিযবুলাল্লাহ এর প্রতিষ্ঠাতা। সোনাকন্দার পাশেই শ্রীকাইল কে কে কলেজ অবস্থিত। এটি ১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর কলেজের ছাত্রদের মধ্যে উছংখলা দেখা দেয় । ফলে কলেজের মঞ্জুরী বাতিল হয়ে যায়। এভাবে দীর্ঘ ১৩ বছর অতিবাহিত হয়। পীর সাহেব তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মফিজ উদ্দিনের কাছে এ ব্যাপারে আলাপ করেন। তিনি করেজটি পুনঃ অনুমোদনের ব্যবস্থা করেন। মফিজ উদ্দিনের সোনাকন্দা মাদ্রাসার কামিল মঞ্জুরীর ব্যাপারেও বিশেষ ভূমিকা পালন কেেরন।
তিনি বেদাত সম্পর্কে সচেতন ও ধর্মের নামে অধর্মীয় কাজের সাথে জড়িতদের বিরোধিতা সারা জীবন করে গেছেন। আলী আজগর রেজভী ধর্ম নিয়ে ফাসাদ সৃষ্টি করলে তাকে যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে মোকাবেলা করার জন্য বাঙ্গরা হাইস্কুল মাঠে বাহাছের আয়োজন করেন। নির্দিষ্ট দিনে তিনে সেখানে আলেম ওলামাদের নিয়ে যান কিন্তু রেজভী আসেননি। ১৯৯০ সালে বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় সোনাকন্দা মাদ্রাসার ছাত্ররা উত্তেজিত হয়ে শ্রীকাইলের দিকে যাত্রা করলে তিনি তাদের শান্ত করেন। ১৯৮৮-৮৯ সালে খামারগ্রাম মাদ্রাসায় জটিলতার কারণে ছাত্ররা অন্য মাদ্রাসায় চলে যেতে চাইলে তিনি খামারগ্রাম মাদ্রাসার ছাত্রদের সোনকান্দা ভর্তির ব্যাপারে নিষেধ্জ্ঞা জারি করেন। ফলে খামারগ্রাম মাদ্রাসাটি রক্ষা পায়। উল্লেখ্য খামারগ্রাম মাদ্রাসা. ঈদগাহ, মসজিদসহ বহু প্রতিষ্ঠান তার মরহুম পিতা তৈরি করেছিলেন। জনাব হুদা এই এলাকায় বহু প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। তার উৎসাহে দরবারের খলিফা ও ভক্তদের মাধ্যমে বহু মসজিদ মাদ্রাসা গড়ে উঠে। এর মধ্যে ঠাকুরগাঁও রাণী শৈংকৈল এ মহারাজা পাঁচ পীর জামে মসজিদ, দারুল হুদা রহমানিয়া খানকা শরীফ ও হাফিজিয়া মাদ্রাসা, বার্ষিক ইছালে ছাওয়াবের মাহফিল ( ১৪ ও ১৫ ফাল্গুন ) তিনি প্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি সোনাকন্দা থেকে প্রকাশিত মাসিক হুদা পত্রিকার সম্পাদনা করেন। তিনি সর্বশেষ মাহফিল করেন ১ ফেব্রুয়ারি , বাখরাবাদ খানকা শরীফে, ২ ফেব্রুয়ারি চিকিৎসার জন্য ঢাকা গিয়েিেছলেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি (২০০৫)শাহাদাতবরণ করেন। তখন মাসিক হুদা পত্রিকাটি নিয়মিত বের হতো। তিনি এটি সম্পাদনা করতেন। তার মৃত্যুর পুর্বে হুদা পত্রিকার চলতি সংখ্যা বার্ষিক মাহফিলের আগে বের করার তাগিদ দেন। জুনায়েদ সিদ্দিকিকে বলেন- তুমি সেলিমকে নিয়ে সব কাজ শেষ করতে তাকে, টাকা পয়সার ব্যবস্থা হবেই ইনশাল্লাহ। “ পত্রিকা সঠিক সময়ে বের হলেও তিনি তা দেখে যেতে পারেন নি। তার ৭ছেলে ও ৩ মেয়ে বর্তমানে দরবারের খেদমতে নিয়োজিত রয়েছেন। তাদের মধ্যে আলহাজ্ব মাওলানা মাহমুদুর রহমান বর্তমানে পীর হিসেবে প্রধান দায়িত্ব পালন করছেন । তাকে সার্বিকবাবে সহযোহিগতা করছেন মাওলানা মাকছুদুর রহমান ও মাওলানা মোঃ মাহফুজুর রহমান। লেখকঃ ধর্মীয় গবেষক ও সাংবাদিক email : maminmollah@yahoo.com

শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.