সৌদি আরবে জনশক্তি রফতানি প্রসঙ্গে
মমিনুল ইসলাম মোল্লাসৌদি আরবে কর্মী পাঠানো বন্ধ ছিল ২০০৮ সাল থেকে। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ১৭ থেকে ২৪ জানুয়ারি সৌদি আরব সফরে গেলে দেশটির পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, বাংলাদেশীদের জন্যে তারা এই শ্রমবাজার পুনরায় খুলতে যাচ্ছে। স¤প্রতি সৌদি আরব এ ব্যাপারে তাদের অভ্যন্তরীণ অনুমোদন নেয়। তারপর উপমন্ত্রী আহমেদ আল-ফাহাইদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল কর্মী নিয়োগে চুক্তি সই করতে বাংলাদেশে আসে। প্রবাসী কল্রান ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী খন্দকার মোশারফ হোসেন বলেন, বাংলাদেশি শ্রমিকরা “ বিনা পয়সায় ” সৌদি আরব যেতে পারবেন। সৌদি আরব যেতে শ্রমিকদের যাতায়াত, ভিসা, মেডিকেল ফি বাবদ কোন টাকা খরচ হবে না। তবে তাতেদর পাসপোর্ট , নিবন্ধন ও ঢাকায় যাতায়াত বাবদ ১৫-২০ হাজার টাকা খরচ হতে পারে।
জানা গেছে, সৌদি আরব গৃহস্থালি কাজের জন্যে কর্মী নিয়োগ করবে বিধায় তাদের বেশিরভাগই নারী কর্মী নিয়োগ করা হবে। বাংলাদেশ থেকে নারী র্কর্মী বিদেশে পাঠানোর জন্যে ২৯টি রিক্রুটিং এজেন্সি নির্ধারিত আছে। তবে সৌদি প্রতিনিধি দল বলছে, তাদের চাহিদা মোতাবেক কর্মী পাঠাতে প্রায় ২০০টি রিক্রুটিং এজেন্সি প্রয়োজন। তবে সৌদি আরব গৃহস্থালি কাজের জন্য ১০ ধরনের কর্মী নেবে। এ ক্ষেত্রে গৃহকর্মী, গাড়িচালক, বাগান পরিচর্যা, বাসাবাড়ির ম্যানেজার প্রভৃতি পদে লোক নেয়া হতে পারে। সৌদি আরব যেতে কর্মীদের ভিসা, বিমান ভাড়া, লেভি বাবদ কোনো খরচ করতে হবে না। সৌদি আরবের নিয়োগকারীরাই এ খরচ বহন করবে।তবে জানা গেছে, সব ধরনের জনশক্তি নয়, শুধু দক্ষ শ্রমিকই নিয়োগ দেবে সৌদি আরব।
এর আগে বাংলাদেশ থেকে অদক্ষ এবং আধাদক্ষ শ্রমিক নিয়োগ করত সৌদি আরব। সোমবার সৌদি আরব থেকে প্রকাশিত আরব নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সৌদি আরবের রাজকীয় ফরমানে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ থেকে দক্ষ নারী ও পুরুষ জনশক্তি নিয়োগ করবে সৌদি আরব।’
সৌদি আরবের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপমন্ত্রী ডঃ আহমেদ আল ফাহাদ জানান, গত বছর তার সরকার শ্রমিকদের জন্য ১৩ লাখ নতুন ভিসা দিয়েছে। এবছরও অনুরূপ ভিসা দেবে। তিনি বায়লাদেশ সরকারের সহযোগীতায় শ্রমিক নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রæত ও স্বাভাবিকভাবে সম্পন্ন করার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। আগে বিশ্বের ৯৭টি দেশে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি হতো। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবছর বিদেশে ৮ লাখ কর্মী পাঠানোর টার্গেট নিয়েছে। এজন্য মন্ত্রণালয় বিদেশে অবস্থিত প্রায় ৭০টি দূতাবাস ও হাই কমিশনের লেভার উইংকে নির্দেশ দিয়েছে। কোন দেশে কি কি কাজে কত পরিমান কর্মীর চাহিদা রয়েছে তা জানিয়ে মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট করার জন্য বলা হয়েছে। বর্তমানে মোট ২৫ লাখ বাংলাদেশী সৌদি আরবে অবস্থান করছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায় বাংলাদেশ সরকার প্রতি মাসে বাংলাদেশ থেকে ১০ হাজার কর্মী নেবে। সেদেশের সরকার বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব খন্দকার ইফতেখার হায়দার জানান, বাংলাদেশ থেকে ১২টি পেশায় কর্মী নেবে সৌদি আরব। সৌদি আরবের জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৭০ লক্ষ। এর মধ্যে নথিভূক্ত অভিবাসীর সংখ্যা ৮৮ লক্ষ আর অবৈধ অবিবাসী প্রায় ১৫ লক্ষ। সৌদি আরব যাওয়ার আগে অবশ্যই নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। মহাপরিচালক বেগম শাসমছুন্নাহার স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিদেশ গমনেচ্ছুরা ইউনিয়ন ডিজিটাল কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে অনলাইনেও নিবন্ধন করতে পারবেন। এতে বলা হয় বিদেশ গমনেচ্ছু ব্যক্তিগণ অফিস চলাকালীন সৌদি আরব সহ বিশ্বের যে কোন দেশে গমনের জন্য বিএমআইটির অধীনস্থ সকল জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস এবং দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে অবস্থিত ইউনিয়ন ডিজিটাল কেন্দ্রের মাধ্যম রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন। স¤প্রতি যে চুক্তি হয়েছে তাতে বাংলাদেশে থেকে গৃহকর্মী নেবে। তাদের বেতন হবে ৮০০ রিয়াল। বিদেশে কর্মী পাঠাতে দক্ষ কর্মীদের গুরুত্ব দেয়া উচিত। তবে আধা দক্ষ কর্মী ও পাঠানা যেতে পারে। দক্ষ কর্মী গড়ে তোলার জন্য সরকারিবাবে ৭০টি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট রয়েছে। বেসরকারিভাবে আরো ৫০টি ট্রেনিং সেন্টার রয়েছে। এসব সেন্টারে ২১ দিন থেকে ৩ মাস পর্যন্ত ট্রেনিং দেয়া হয়। এছাড়া প্রতিটি থানায় অবস্থিত সরকারি হাইস্কুলগুলোতে বিদেশগামীদের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। ভিসা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশী কর্মীদের প্রায়শই বিলম্ব হয়। অন লাইন সৌদি গেজেট জানায় সৌদি আরবে নতুন কাজের ভিসা দেয়া হবে মাত্র ১০ দিনের মধ্যে । আগে এতে সময় লাগত ৯০ দিন। তবে শ্রম অফিস ভিসার জন্য যাওয়ার আগে সব শর্ত পূরণ করতে হবে। এতে ভিসা পেতে বিলম্ব হবে না। চালক পদে বহু বাংলাদেশী শ্রমিক সৌদি আরবে কাজ করছেন। সৌদি আরবের পক্ষ থেকে ৬ হাজার নেয়ার চাহিদাপত্র বাংলাদেশ সরকারকে দিয়েছে। এবার জেলার জনসংখ্যার আনুপতিক হারে রেন্ডম সিলেক্টর এর মাধ্যমে সৌদিতে কর্মী পাঠানো হবে।
সরকারি তথ্য মতে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক এমন ২২ লাখ বেকার যুবকের নিবন্ধন রয়েছে। প্রবাসমন্ত্রণালয় আগামী ৫ বছরে ৩৭ লাখ কর্মী বিদেশ পাঠানোর টার্গেট করেছে। তাদেরকে ১৫৭ টি দেশে পাঠনোর সুযোগ রয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী বলেন, আমরা জনশক্তি রফতানি নিয়ে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। পরিকল্পনার প্রধান কাজই হবে অভিবাসন ব্যায় কমানো। আর এই খাত থেকে দালাল ফরিয়া ও দুর্নীতিমুক্ত করা। বিশ্বের প্রায় ৩০টি দেশে দূতাবাস ও ২৮টি লেবার উইং রয়েছে। ধীরে ধীরে ১৫৭ টি দেশে লেবার উইং খোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। জনশক্তি রফ্তানির সাথে ৩টিন্ত্রণালয় জড়িত। পাসপোর্ট সংক্রান্ত কাজ কওে স্বরাষ্টমন্ত্রণালয়, বিদেশ যাওয়ার ব্যাপাওে সর্বাত্মক সাহায্য কওে জনশক্তি ও কর্মসংস্থামন্ত্রণালয় তাছাড়া বিদেশে বাংলাদেশী কর্মীদেও দেখা- শোনা করে পররাষ্টমন্ত্রণালয়। বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে বেসরকারি ট্রাভেল এজেন্সিগুলোতে টাকা দিয়ে দু/ একবার ধরা খায়নি এমন প্রবাসীর সংখ্যা খুবই কম। তাই এ কাতকে দুর্নীতি মুক্ত করতে সরকার বদ্ধপরিকর। কর্মীদেও ফিঙ্গারপ্রিন্টসহ জীবন বৃত্তান্ত একটি সার্ভাওে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এতে যে দেশ কর্মী চাইবে সেদেশে দ্রæত কর্মী পাঠানোর ব্যবস্থা থাকবে। এজন্য ভিসা টেডিং বন্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে বলে সংশ্লিস্ট কর্মকর্তারা জানান। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে যেভাবে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে এবং জনশক্তি রফতানিকারক দেশগুলো অদক্ষ শ্রমিক আমদানিতে নিরুৎসাহিত করছে, সেখানে বাংলাদেশকে টিকে থাকতে হলে দক্ষ শ্রমিক তৈরির কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশকে এখন অদক্ষ শ্রমিক পাঠানোর পরিবর্তে তাদের দক্ষ করে বিদেশে পাঠাতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বর্তমানে অদক্ষ শ্রমিক আমদানি কমিয়ে দক্ষ শ্রমিক আমদানির দিকে ঝুঁকছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের বৃহৎ শ্রমবাজারটি ধরে রাখতে হলে দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর ব্যবস্থা করতেই হবে। নইলে মধ্যপ্রাচ্যের বাজারটিও একদিন আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। এজন্য বিশ্ব শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ শ্রমিক তৈরি করতে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পলিটেকনিক ও ভোকেশনাল ইন্সটিটিউটের সংখ্যা বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে যেসব পলিটেকনিক্যাল ও ভোকেশনাল ইন্সটিটিউট আছে সেগুলোর গুণগত মান নিয়ে অনেক অভিযোগ রয়েছে। এসব ইন্সটিটিউট আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করে পুনঃপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি চাহিদা অনুযায়ী নতুন নতুন কোর্স চালু করার পরামর্শ দিয়েছেন মাইগ্রেশন বিশেষজ্ঞরা। উন্নত দেশ গুলোতে বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার খরচ অনেক বেশি। এজন্য একজন প্রবাসীকে সব সময় ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে কাজ করতে হয়। একজন কর্মী যাতে ২/৩ মাসে তার যাওয়ার খরচ উঠাতে পাওে সে কথা খেয়াল রেখে সরকারকে চুক্তি করতে হবে। বাকী যে সময়টুকু পাবে তাতে সে একটি বড় অঙ্কেও টাকা নিয়ে দেশে ফিরে এসে কিছু একটা করতে পারবে। এছাড়া ৩ বছরের পরিবর্তে ৫ বছরের জন্য চুক্তি করার ব্যাপারেটিকে প্রাধান্য দিতে হবে।
লেখকঃ গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের ক্যাম্পেনার, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক ও সাংবাদিক, ধর্মীয় গবেষক,সহকারী সম্পাদক,দৃষ্টান্ত ডট কম কুমিল্লা।
আর্ক্ইভ থেকে 1/08/2017