মোবাইলের টাকা যায় কোথায় ?

মোবাইলের টাকা যায় কোথায় ?

মমিনুল ইসলাম মোল্লা
মোবাইল বা সেল ফোন আমাদের নিত্যসঙ্গী। বর্তমানে মোবাইল ছাড়া আমরা একদিনও চলতে পারিনা। তবে এ নিত্যপ্রয়োজনীয় যন্ত্রটির পেছনে আমাদের প্রতি বছর কত টাকা খরচ হয় তা কি আমরা কখনও ভেবে দেখেছি? যারা ব্যাবসা -বাণিজ্যের সাথে জড়িত রয়েছেন তাদের কথা না হয় বাদই দিলাম; কারণ তারা যে কোন ক্ষেত্রে  সিকিটা ফেলেন আর টাকাটা তোলেন। আমাদের মত ছা-পোষা মানুষরা প্রয়োজনীয় কল ছাড়াও বিনা প্রয়োজনে অথবা হাল্কা প্রয়োজনে অনেক সময় কথা বলে থাকি। মোবাইলে কথা বলা যেন আমাদের নেশা হয়ে গেছে। গত ৭ জুন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে পেশ করা ২০১২-২০১৩ অর্থ বছরের বাজেটে প্রিপেইড ও পোস্ট পেইড মোবাইল ফোন গ্রাহকদের ক্ষেত্রে কার্ড বিক্রি বা রিচার্জের সময় ২ শতাংশ হারে কর কেটে রাখার প্রস্তাব করা হয। এ প্রস্তাব কার্যকর হলে সরকার এ খাত থেকে প্রতি বছর ৩০০ কোটি টাকা আয় করতে পারবে। তবে শতকরা ২ ভাগ হারে কর কেটে রাখলে আমাদের মোবাইল খরচ বেড়ে যাবে। প্রথা অনুযায়ী বাজেট ঘোষণা করার পরদিন রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন- মোবাইল ফোনে বিলের ব্যাপারে বিলের উপর ২ শতাংশ হারে উৎস কর আরোপের ব্যাপারটি আসলেই ভেবে দেখার বিষয়। আমরা অবশ্যই এটি পূণর্বিবেচনা করব। নিয়ম অনুযায়ী ৩০ জুন বাজেট পাশ হওয়ার কথা। এর মধ্যে এব্যাপারে সরকার যদি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করে তা হলে আমাদেরকে ঠিকই এ কর দিতে হবে।
চারদিকে  এখন যেন কথার জোযার শুরু হয়ে গেছে। বাসায় কথা, বাসা থেকে বের হলে কথা, হাটে-মাঠে-ঘাটে সবাই কথা বলছে। কেউ কানে হাত রেখে বলছে আবার কেউবা এয়ার ফোনে বলছে। কেউ প্রয়োজনে বলছে, আবার কেউ অপ্রয়োজনে বলছে, খাওয়ার আগে কথা হচ্ছে, খাওয়ার পরে কথা হচ্ছে, আবার কেউ কেউ খাওয়ার মধ্যেই কথা বলছেন। কথার পিঠে কথা বলেন, কথার মাঝে কথা বলেন, একজন কথা বলা শেষ না করতেই আরেকজন বলতে শুরু করেন।আবার কেউ কেউ কথা শুনতে না চাইলেও কথা বলেন, কথা বলাতেই তারা আনন্দ পান। যে লোকের সাথে বিকেলে দেখা হবে ইচ্ছে করলে সরাসরি যে কথা বলতে পারেন তাও মোবাইলে বলেন।  বাসে বা ট্রেনে কোথাও যাওয়ার সময় সীটে বসার সাথে সাথেই কথা শুরু করে দেন। বাস চলতে থাকে কথাও চলতে থাকে, যানজটের কারণে বাস চলাচল বন্ধ থাকলেও কথা কিন্তু থামেনা। একথা বলার সংস্কৃতি (নাকি অপসংস্কৃতি?)  থেকে আমাদের বেড়িয়ে আসতে হবে। কবি বলেছেন-আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে ? কখায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।আমরা ইচ্ছা কররেই কথার অপচয় রোধ করতে পারি।

বর্তমানে পুরুষদের প্যান্টের পকেট, শার্ট, পাঞ্জাবীর পকেট, কৃষকের লুঙ্গির কোচা ,কোমর বা অন্যান্য স্থানে যে জিনিসটি সবসময় স্থান করে নিয়েছে তার নাম মোবাইল। মহিলারা কেউ কেউ পার্সের ভেতরে ,গলায় তাবিজ আকারে ঝুলিয়ে কিংবা শাড়ির আচলে বেঁধে রাখেন। কেউ কেউ মোবাইলের নিরাপত্তাজনিনত কারণে সেটি এতদিন পেটের কাছে ফিতা দিয়ে আটকে মোবাইল ব্যাগে রাখতেন। এটি মহিলাদের জন্য বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলাদের জন্য ক্ষতিকর হওয়ায় এখন আর কেউ জেনেশুনে এ ভুলটি করছেন না। কারণ সাম্প্রতিককালে একটি গবেষণায় জানা গেছে-গর্ভবতী মহিলারা পেটের কাছাকাছি মোবাইল ফোন রাখলে মোবাইলটি যখন বেজে উঠে তখন অতিরিক্ত শব্দে বাচ্চার ব্রেনের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। এতে তার স্মৃতিশক্তি কমে যেতে পারে। বাস্তবিক অর্থে কি নারী- কি পুরূষ ,কেউই এই উপকারী যন্ত্রটি দূরে রাখতে চান না। এমনকি চার্জ দেয়ার সময়ও একজনকে কাছে বসিয়ে রাখেন কেউ কল করলে যাতে সাথে সাথে তাকে খবর দেয়া হয়। সূত্র জানায়, বর্তমানে স্থানীয় পর্যায়ে মোবাইল ফোন হচ্ছে রাজস্ব আদায়ের সবচেয়ে বড় খাত। প্রতি বছর এখাত থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা সরকার রাজস্ব হিসেবে পাচ্ছে। বর্তমানে মোবাইলের সেিমর উপর মূল্য সংযোজন কর আরোপ করা আছে। মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানীগুরোর কাছ থেকে সরকার এ ট্যাক্স আদায় করছে। এছাড়া বর্তমানে মোবাইল ফোন গ্রাহকগণ কল করার ক্ষেত্রে ১৫% মূল্য সংযোজন কর পরিশোধ করছেন। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, সেবা খাত হিসেবে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে প্রথম মোবাইল ফোন খাতকে ভ্যাটের আওতায় আনা হয়। এর পরের বছর সীম সংযোজনের উপরও ভ্যাট আরোপ করা হয়। তখন প্রতি সীমের উপর ভ্যাট আরোপ করা হয় ৯০০ টাকা, যা পরে মোবাইল কোম্পানীগুলোর আবেদনের প্রেক্ষিতে কমানো হয়। মোবাইল কোম্পানীগুলো সীম বিক্রি বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আকর্ষণীয় টোপ (তাদের ভাষায় অফার) দিচ্ছে। নতুন সীম কিনলে ফ্রি দিচ্ছে টক টাইম, এমএসএস, এমএমএস, ও মেগাবাইট।  এসব সুযোগ সুবিধা প্রি লোডেড কিংবা পোস্ট লোডেড হিসেবে দিচ্ছে। কোন কোন কোম্পানী ১০০ টাকা সীমের মূল্যের বিপরীতে ২০০ টাকা ফ্রি টকটাইম দিচ্ছে। সূত্র জানায়, বর্তমানে প্রতিটি সীম বিক্রির জন্য মোবাইল কোম্পানীগুলো গড়ে ১ হাজার ১শ থেকে ১ হাজার ৩ শ টাকা পর্যন্ত ভর্তুকী দিচ্ছে। এ ভর্তুকীর কারণে তাদের ব্যায় বেড়ে যাচ্ছে। কোম্পানীগুলো দাবী করছে সীমের উপর করারোপ থাকায় তাদের ব্যবসায় লোকসান হচ্ছে। তাই মাঝে মাঝে কোম্পানীগুলোর মালিকানা ঘন ঘন পরিবর্তন হচ্ছে। যেমন সেবা পরিবর্তীত হয়ে বাংলালিংক এবং ওয়ারিদ  হয়ে গেল এয়ারটেল।
বযস, পেশা, ও সম্পর্কভেদে মোবাইলে আমরা একজন অন্যজনের সাথে কথা বলি। বহু ধরণের- বহু রকমের কথা, তবে কথার সার অংশ অনুসন্ধােন করলে দেখা যায়, ১০ মিনিটে জনৈক আমেনা খাতুন যা বল্লেন তা ২ মিনিটেই বলা যেত। যেমন তিনি অফিসে এসেই বলা শুরু করলেন-হ্যালো নিপা, ক্যামন আছিস? আমি ঢাকা থেকে এসেই ভাবলাম তোকে একটা ফোন দেয়া দরকার। কিন্তু যখনই ফোন করি তখনই বলা হয়-এই মুহুর্তে সংযোগ দেয়া সম্বভ না । আপনি আবারও ডায়াল করুন। এভাবে চেষ্ট করতে করতে বহুদিন পর তোকে পেলাম ।  তা তুই ভাল আছিস তো? এটুকু বলার পর লাইনটা কেটে গেল । আমেনা খাতুন ব্যালেন্স চেক করে দেখলেন টাকা ফুরিয়ে গেছে। তারপর টাকা লোড করে আবার সেই প্রথম থেকে কথা শুরু করলেন এবং বার বার একই কথার পুনরাবৃত্তি করতে থাকলেন। সম্প্রতি স্পেনের বার্সিলোনায় অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে জানানো হয়,  বিম্বের ৬ শ কোটি মোবাইল ফোন গ্রাহকের প্রত্যোক মাসে গড়ে ২৯৩ মিনিট করে কথা বলে। আবার মোট গ্রাহকের ৮৬ শতাংশ  প্রিপেইড গ্রাহক এবং বিশ্বের ৮৬ শতাংশ লোকের হাতে মোবাইল ফোন রয়েছে।  আরপিইউ এর হিসেব অনুযায়ী মোবাইলে টাকা খরচের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে উত্তর াামেরিকা, এখানে একজন গ্রাহক মাসে মোবাইল ফোনের পেছনে খরচ করে ৫০ ডলার। মাসে গড়ে ২১ ডলার খরচ করে দক্ষিণ ও মধ্র আমেরিকার গ্রাহক। আর ১১ ডলার খরচ করে মধ্য প্রাচ্য্র ও আফ্রিকার গ্রাহক। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে বাংলাদেশের মোবাইল কোম্পানীগুলোর যোগাযোগ রয়েছে। এসব দেশের সাথে টেলিফোনকলের ক্ষেত্রে ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইজিডবিøউ) সার্ভিসের প্রাপ্ত সমুদয় অর্থের উপর বর্তমান বাজেটে এক শতাশ হারে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে  আইজিডবিøউ প্রদত্ত অর্থের ওপর ৫ শতাংশ হারে উৎস  অয়কর কাটার ও প্রস্তাব করেন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী।
সূত্র মতে ,বাংলাদেশের মোবাইল ফোন কোম্পানীগুলো তাদের গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রতি মাসে ১৫ হাজার কোটি টাকা বিল হিসেবে আয় করে। আর এ টাকার সিংহভাগ চলে যাচ্ছে বিদেশে। কেননা শুধুমাত্র টেলিটক বাদে সবগুলো কোম্পানীর মালিকই হচ্ছে বিদেশীরা। বিটি আরসি এর তথ্য মতে ২০১১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত হিসেবে ধরে দেশে গ্রাহক সংখ্যা জিপি-৩ কোটি ৬১ লাখ ১৩ হাজার ,রবি  ১ কোটি ৫৮ লাখ ৫৫ হাজার, এয়ারটেল ৫৮ লাখ ১ হাজার, বাংলা লিংক ২ কোটি ৩৩ লাখ ৬৭ হাজার, টেলিটক ১১ লাক ৯৮ হাজার, এবং সিটিসেলের গ্রাহক সংখ্যা হচ্ছে ১০ লাখ ৩৯ হাজার। শুধু মাত্র কথা নয়  ঘন ঘন রিংটোন  ডাউনলোড, গান বাজনা শোনা, খেলাধুলা করা, ফ্যাশান পাল্টানোর কারণে ঘন ঘন মোবাইল পাল্টানো, ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে ফেসবুকে দিন-রাত পড়ে থাকার মাধ্যমেও আমরা টাকা অপচয় করি। আসুন সপ্তাহে কমপক্ষে ১ দিন  (ধরা যাক বৃহস্পতিবার ) মোবাইলে কল করা বন্ধ রাখি। তাহলে বাংলাদেশের  ৯ কোটি গ্রাহকের  (যদি ৩ কোটি সীমও চালু থাকে)  গড়ে ২০ টাকা করে সাশ্রয় হলেও দেশের ৬০ কোটি টাকা বাঁচবে। মনে রাখবেন ব্রিটিশরা প্রায় ২শ বছর বাংলাদেশ শাসন করে যে টাকা এদেশ থেকে নিয়ে গেছে তার চেয়ে অধিক পরিমান টাকা প্রতিবছরই বাংলাদেশ থেকে মোবাইল বাবদ বিদেশে চলে যাচ্ছে। আমরা ইচ্ছে করলেই (অপচয় রোধ করে) এ টাকা কিছুটা হলেও বাঁচাতে পারি। লেখকঃ মমিনুল ইসলাম মোল্লা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের  প্রভাষক ও সাংবাদিক, কুমিল্লা।




শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.