দিবস পরিক্রমাঃ রবীন্দ্রনাথের চিন্তা চেতনা

দিবস পরিক্রমাঃ রবীন্দ্রনাথের চিন্তা চেতনা

মমিনুল ইসলাম মোল্লা
গান, পাখি ও কবির দেশ বাংলাদেশ। তবে এদেশের সব গান, সকল পাখি ও সকল কবির  কবিতা সবাইকে সমানভাবে আকৃষ্ট করে না। কিছু কিছু গান আমাদের হৃদয়কে নাড়া দেয়। যখনই গাই তখনই নতুন মনে হয়। এমনই একটি গান আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।” এই কালজয়ী গানটির রচিয়েতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তিনি আমাদের কবিগুরু নামে পরিচিত। বাংলাভাষাকে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বদরবারে প্রথম পরিচিত করেন। ম্যারাডোনা-আর্জেন্টিনা, পেলে-ব্রাজিল, ন্যালসন মেন্ডেলা- দক্ষিন আফ্রিকার মতই রবীন্দ্রনাথ;  বাংলার সমার্থক। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বব্যপি পরিচিতি এনে দিয়েছে।রবীন্দ্রনাথ শুধু একজন কল্পনাবাদী কবিই নন তিনি বাস্তবতার নিরিখে অনেক সাহিত্য রচনা করেছেন। তার লেখায় তৎকালীন সমাজ চিত্র ফুটে উঠেছে। কবি কাজী নজরুলের মত কারাবরন করেননি ঠিক, তবে কম নিগ্রহ ভোগ করতে হয়নি তাকে। ব্রিটিশ সরকার রবীন্দ্রনাথকে বিভিন্ন কৌশলে নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করেন। তারপরও তিনি নীতিতে অটল ছিলেন।
কথায় বলে রবীন্দ্রনাথ একবারই জন্মায়। বাংলা সাহিত্যে তার অবদান পর্যালোচনা করে দেখা যায় তার সম-সাময়িক অথবা পরবর্তীকালে কোন কবি-সাহিত্যিক চিন্তা-চেতনায় তাকে অতিক্রম করতে পারেননি। তাই রবি ঠাকুরকে ব্যক্তি হিসেবে নয় একটি শতাব্দি হিসেবেই বিবেচনা করা যায়।
তাই রবীন্দ্রনাথ একটি স্বর্নযুগের নাম, রবীন্দ্রনাথ একটি নক্ষত্রের নাম। তাকে বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্য সম্পূর্ন হয় না। তাই বাংলা সাহিত্যের প্রসঙ্গ উঠলেই মনের অজান্তে রবি ঠাকুরের মূখচ্ছবি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির পূর্বেই রবীন্দ্রনাথ মারা গিয়েছেন। তিনি ভারত বিভাগ কিংবা আমাদের স্বাধীনতা কোনটাই দেখে যেতে পারেননি। তবে তার রচিত কবিতা, গান, উপন্যাস ও নাটক আমাদেরকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। তিনি উচ্চ বংশে জন্ম গ্রহন করলেও তিনি ছিলেন সাম্যের কবি। মানুষের মধ্যে ভিন্নতা ধনী-নির্ধন, উচু-নীচু, ধর্ম-বর্ণবেদ পার্থক্য তৈরী করা কিংবা হেয় করা ছিল তার চক্ষুশূল। তাইতো তিনি বলেছেন- “সাত কোটি মানুষের হে বঙ্গ জননী, বাঙ্গালী করেছ তুমি মানুষ করনি।” সত্যিকারের মানুষ হওয়ার জন্য তিনি স্বাধীন সত্ত¡া বজায় রাখার চেষ্টা করেন। তবে তারও কিছু শত্রæ ছিল। কিছু কিছূ লোক তার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ তোষনের অভিযোগ করেন। মূলত তিনি তোষামোদীতে বিশ্বাসী ছিলেন না। বরং রাজনৈতিক ব্যপারে তিনি সব সময় ব্রিটিশদের অন্যায় অত্যাচারের বিরোধী ছিলেন। তার কথা-বার্তায়, চিন্তা-চেতনায় তা ঝাঁঝালোভাবে ফুটে না উঠলেও তার সাহিত্যকর্মে তার ছাপ সুস্পষ্ট।
তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ইংরেজদের তাড়াতে না পারলে ভারতবর্ষের উন্নতি হবে না। তাই বিভিন্ন সময় গণ-মানুষের দাবীর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। শুধুমাত্র লেখনীর মাধ্যমেই নয়, রাজনৈতিক মঞ্চেও জ্বালাময়ী বক্তব্য দেন। এ ব্যপারে ব্রিটিশ শাসনের শেষের দিকে পরিচালিত জ্বালিয়ানলাবাগ হত্যাকান্ডের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এ ঘটনায় বেশ কিছু ভারতীয় দেশ প্রেমিক নিহত হন। এ হত্যকান্ডের ন্যায্য বিচার না হওয়ায় তিনি ব্রিটিশদের প্রদত্ত “নাইটহুড” খেতাব বর্জন করেন। এ ঘটনায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশপ্রীতির পরিচয় পাওয়া যায়।
শুধুমাত্র সাহিত্যিক হিসেবেই নয় রবীন্দ্রনাথ মানুষ হিসেবেও ছিলেন খুব জনপ্রিয়। তার সততা, ন্যয়পরায়নতা, কারো বিপদের সময় এগিয়ে আসার ক্ষেত্রে তার কোন জুড়ি ছিল না। তিনি নির্দিষ্ট সময়ে বিভিন্ন শ্রেনি ও পেশার মানুষদের স াথে সাক্ষাত করতেন। একদিন দেখা গেল প্রচুর লোক জামায়েত হয়েছে। কিন্তু কবিগুরুর কোন খবর নেই। অপেক্ষমান লোকজন তখন তার সম্পর্কে বিরূপ ধারণা পোষন করতে লাগলেন। সবাই যখন রাগে ক্ষোভে চলে যাচ্ছেন তখন কোথা থেকে যেন কবিগুরু এসে হাজির হলেন। তিনি অন্যান্য দিনের মত লোকজনের সুখ-দুঃখের খবর নিলেন, কিন্তু লোকজন লক্ষ করল রবি ঠাকুরের কথায় যেন প্রাণ নেই। কথা বলতে  গিয়ে যেন খেই হারিয়ে ফেলছেন। তখন তাদের পশ্নের জবাবে জানালেন সকালে তার মেয়েটা মারা গেছে। তাকে দাহ করতে গিয়েই দেরি হয়েছে। তখন উপস্থিত লোকজন এমনদিনেও সাক্ষাৎদানের কথা ভেবে বিস্মিত হলেন।
কবি গুরুর উর্বর মস্তিষ্ক ও অক্লান্ত পরিশ্রম বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি কাব্য গ্রন্থ লিখেছেন ৫৬ টি। কাব্য নাট্য লিখেছেন ১৯ টি, নাটক ২৯ টি, ছোট গল্প ১১৯ টি, উপন্যাস ১২ টি এবং ভ্রমন কাহীনি লিখেছেন ৯টি। গল্প, কবিতা, ছাড়াও তিনি প্রচুর পরিমানে গান লিখেছেন ২২৩২ টি। এছাড়া তিনি ছবি আঁকায়ও তিনি পারদর্শী ছিলেন।
বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে শিশু শ্রেনী থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত প্রায় সকল শ্রেনীতে রবীন্দ্রনাথের গল্প, কবিতা ও ছড়া পাঠ্য রয়েছে। যতই দিন যাচ্ছে, তার জনপ্রিয়তা যেন ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের আদর্শ অনুসরণ করে আমরা ব্যক্তি জীবনে সাফল্য লাভ করতে পারি।
একসময় বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশন বাদে আমাদের কোন ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া ছিল না। এখন দেশে বহু চ্যানেল রয়েছে। তাই রবীন্দ্র সঙ্গীতকে আরোও অধিক মানুষের কানে পৌঁছে দেয়া সহজ কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য। স্যাটেলাইট চ্যানেল গুলো রবীন্দ্রনাথ প্রবেশ সীমিত। রবীন্দ্র জয়ন্তী বাদে হয় না। এসব চ্যানেল ২৪ ঘন্টা অনুষ্ঠান প্রচার করায় প্রতিদিন ১ঘন্টা পরিবেশন  রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশন করাও তা অসম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সকলের আন্তরিক সহযোগীতা প্রয়োজন।
লেখক: মমিনুল ইসলাম মোল্লা,প্রভাষক, ক্যাম্পেনার সিডিএলজি এবং সহকারী সম্পাদক , (দৃষ্টান্ত ডট কম), কুমিল্লা,



শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.