বিদেশ যাত্রায় ভোগান্তিরোধে চাই নতুন আইন ও সুষ্ঠু বাস্তবায়ন

বিদেশ যাত্রায় ভোগান্তিরোধে চাই নতুন আইন ও সুষ্ঠু বাস্তবায়ন

মমিনুল ইসলাম মোল্লা
২৫ এপ্রিল সরকারিভাবে মালয়েশিয়াগামী প্রথম দলটি সেদেশে গিয়ে পৌঁেচছে। এবছর সরকারিভাবে ১০ হাজার কর্মী বাংলাদেশে থেকে মালয়েশিয়া যাচ্ছেন। তারা মাত্র ৪০ হাজার টাকায় মালয়েশিয়া যাচ্ছেন। বিমান ভাড়া কমে যাওয়ায় এ টাকা থেকেও আরো কিছু ফেরৎ দেয়া হবে বলে সরকারি সূত্র জানিয়েছে। সরকার ইউনিয়ন তথ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে এসব কর্মীর  নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছিল। এসময় ১৪ লাখ যুবক নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছিল। তাদের মধ্য থেকে ৩৬ হাজার ৩৮ জন নির্বাচিত হয়। পরে প্রাথমিকবাবে লটারীর মাধ্যমে ১১ হাজার ৭৫৮ জন কে নির্বাচিত করা হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সর্বাধিক ৩০% অবদানের পরই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে প্রবাসীদের কষ্টার্জিত উপার্জন। এখাতে অবদান ১২ শতাংশ। বর্তমানে ৭৬ লাখের বেশি বাংলাদেশী বিশ্বের ১৪৩ টি দেশে কাজ করছে। তাদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ কাজ করেন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলিম দেশে। বাংলাদেশ সরকার প্রায় সময় সরাসরি কিছু লোক বিদেশে পাঠাচ্ছে। বোয়েসেল নামের এজেন্সিটি এ কাজ করে থাকে। সরকারের সাথে সরাসরি চুক্তি হলে বিএমআইটির মাধ্যমে যাওয়া যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী গত বছর সেপ্টেম্বরে  ৮৫ কোটি ৫৪ লাখ ডলার, অক্টোবরে ১০৩ কোটি ৯৪ লাখ ডলার নভেম্বরে ৯০ কোটি ৮৭ লাখ এবং ডিসেম্বরে রেমিটেন্স আসে ৮৮ কোটি ৭২ লাখ ডলার। অথচ এর আগের বছর ডিসেম্বর মাসে এসেছে ৯৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার। 
ধরি, কুমিল্লার এরাহাবাদের সহজ সরল যুবক জীবন চিন্তা করলো তাদের গ্রামের রফিক- সফিকের মতো তিনিও দেশের বাইরে গিয়ে নিজের ভাগ্য বদলাবেন। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির চাকাও সচল করবেন। মূলত তখনই তার বিভিন্ন সমস্যা শুরু হয়, তাকে সতর্ক অবস্থায় পা ফেলতে হয়, কারণ কোথায় চোরাবালী লুকিয়ে আছে সে জানেনা। কেউ এই নবাগত বিদেশ যাত্রীটির সাহায্যে এগিয়ে আসে না। জনশক্তি ও কর্মসংস্থান অফিসসহ সরকারি সকল অফিসের দীর্ঘসূত্রিতা, ভোগান্তি, তাকে ভাবিয়ে তোলে । এক পর্যায়ে যুবকটি হাঁপিয়ে উঠে, কিন্তু হাল ছাড়েনা।  ভিসা টিকেট নিয়ে বিদেশগামী যুবকরা যখন ভাগ্যের অন্বেষণে ছুটে আসেন ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে তখন ভোগান্তি শুরু হয়। তারা কাস্টম্স, ইমিগ্রেশন, কঠিন সব নিয়ম কানুন মানতে গিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে যান। এর ওর ধমক খেয়ে শেষ পর্যন্ত যখন প্লেনে উঠতে সক্ষম হন তখন তাদের মনে হয় সোনার হরিণ হাতে পেয়েছেন। বিদেশগামী যুবকরা দালালদের মাধ্যমে প্রতারিত হয়। অনেক সময় দালালরা বলে থাকেন-আমিই সবকিছু করে দেব। আপনাকে কিছু করতে হবে না। এ বিশ্বাসে টাকা দিয়ে আনেকেই প্রতারিত হয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে বিদেশ যাওয়ার প্রক্রিয়াটা বাজার থেকে মুড়ি-মুড়কি কেনার মতো এতটা সহজ নয়। অনেক ক্ষেত্রেই গমনেচ্ছুর স্বাক্ষরের প্রয়োজন হয়। সেগুলো সঠিকবাবে না হলে পরবর্তীতে ভোগান্তির শিকার হোন। কাতারের রয়েল ফ্যামিলিতে চাকুরি দেয়ার নামে এক যুবককে উটের জকি হিসেবে বিক্রি করে দেয়ার প্রতারণায় পঞ্চগড়ের এক আদম ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে প্রতারণা মামলা হয়েছে। বাদী অভিযোগ করেন-কাতারে কম্পিউটার অপারেটর  হিসেবে চাকুরি দেবে এ কথা বলে ৩ লাখ টাকা নিয়ে উটের জকি হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছে। এরকম প্রতারণার ঘটনা অনেক ঘটছে কিন্তু সবগুলো ঘটনা প্রকাশ পায় না। বিদেশ যাওয়ার জন্য প্রধান শর্ত পাসপোর্ট করা। পাসপোর্ট করতে গেলেই পড়তে হয় দালালদের খপ্পরে। দালাল তাকে বোঝায় আপনি নিয়ম মেনে পাসপোর্ট করতে গেলে অনেক ফর্মালিটি মেন্টেন করতে হবে। অনেক ঝামেলা হবে। সঠিক সময়ে পাসপোর্ট পাওয়া যাবে না। এর চেয়ে ভাল আমাকে সবকিছুর দায়িত্ব দিয়ে দেন –আমি সবকিছু ওকে করে দেব। সহজ-সরল যুবকটি এভাবে প্রতারিত হয়। প্রতারণা দিয়েই শুরু হয় তার বিদেশ যাত্রার মিশন। কারণ কাকে কার কাছে কত টাকা দিতে হবে তা তার জানা নেই। এভাবে সঠিক নীতিমালার অভাব রয়েছে। কোন কোন সময় অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে পাসপোর্ট পেলেও অধিকাংশ সময় দালালরা টাকা-পয়সা মেরে দেয়।
 বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে গেলে ধরা খাওয়ার সম্বাবনা কম। দেশে বর্তমানে ৮৪৯ টি বৈধ এজেন্সি রয়েছে। এছাড়া আপনি যে কোম্পানীর মাধ্যমে যাচ্ছেন সে কোম্পানীর লাইসেন্স হালনাদগাদ করা আছে কিনা তা দেখতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় কোম্পানী বৈধ হলেও প্রতারণার কারণে সাময়িকভাবে তাদের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে এসব কোম্পানীও জনসাধারণের নিকট থেকে অর্থ সংগ্রহ করে প্রতারিত করে।  সৌদি; আরব বাংলাদেশের জনশক্তি আমদানীকারক দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এদেশের একটি প্রতিনিধি দল প্রতারণার উপর বিষেøষণ করে বলে- সে দেশে জনশক্তি রপ্তানীর সাথে জড়িত এজেন্সিগুলোর কারণে শ্রমিকরা প্রতারিত হয়। জনশক্তি, কর্মসংস্থান, ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক বেগম শামছুন্নাহার এর সাথে বৈঠক করার সময় এ কথা বলা হয়। তারা আরো বলেন- অধিকা?ংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, সৌদি আরবে কোন শ্রমিক কাজ করতে গেলে সেখানকার নিয়োগদানকারী প্রতিষ্ঠান তার বিমানভাড়া বহন করে। ভিসা ইসুতে সামান্য টাকা নেয়া হলেও এজেন্সিগুলোর চক্র বিদেশগামীদেও নিকট থেকে২/৩গূণ বেশি অর্থ আদায় করে। 
কয়েক লাখ টাকা করচ করে বিদেশে গিয়েছেন কুমিল্লার ছেলে জামান। স্ত্রী-পুত্র, মা-বোন, সবাই দিন বদলের স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু ফোনে কোন যোগযোগ করতে পারছেন না জামানের সাথে। কিন্তু আয় উপার্জনের আশায় গেলেও আয়ের মুখতো দেখেনইনি, উল্টো ফিরেছেন খালি হাতে। গায়ের জামা ছাড়া আর কোন সম্বল হাতে নেই। তবে সম্বল আছে একটাই দুচোখের কান্না;স্বনদের ছেড়ে গিয়েছিলেন মরুভূমির দেশে। বালিকারাশির মাঝে খোলা ময়দানে থেকেছেন দিনের পর দিন, জেল খেটেছেন মাসের পর মাস। তার কোন দোষ না থাকলেও পুলিশ ধরে নিয়ে যায় জেলে। সেখান থেকে দেশে পাঠিয়ে দেয়।  তবুও শান্তনা খুঁজছেন হাজার কষ্ট হোক দেশেতো ফিরেছেন।  এ ধরনের খবর প্রায়ই আমাদের দেশের পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়। ২০১২ সারের ৩০ জুলাই মালয়েশীয় সংবাদ সংস্থা “বারনামা” মালয়েশিয়ার “কেদাহ”রাজ্যের রাজধানী আলোর স্টারে ৪শ প্রবাসী বাংলাদেশী ৩ কোটি ১০ লাখ টাকা দিয়ে প্রতারিত হয়েছেন। র্ভক্তভোগীরা বলেন- আমরা বাংলাদেশ থেকে বৈধবাবে ৫ থেকে ১৮ বছর আগে এদেশে এসেছি। কেউ কেউ এখানে বিয়ে-সাদিও করেছে। ২৫ জুলাই ওই কারখানা এজেন্টের বিরুদ্ধে প্রতারণা মামলা করে। এছাড়া কানাডা প্রবাসী আরিফ হোসেন জানান রুপসী বাংলা এয়ারলাইন্সের বিরুদ্ধে প্রায় ৫ শকোটি টাকা প্রতারণার মামলা ৩ বছর আগে হলেও প্রতারিতরা টাকা ফেরৎ পাননি।  এভাবে রিকুটিং এজেন্সি, দেশীয় ও বিদেশী দালাল দ্বারা বিদেশগামী যুবকরা প্রতারিত হচ্ছেন। এদেিক হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠনোর পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স থেকে বাংলাদেশ সরকার বঞ্চিত হচ্ছে। কোন কোন প্রবাসী অভিযোগ করেন, বেশি পরিমাণ টাকা পাঠাতে গেলেই তাকে বিভিন্ন ধরণের প্রশ্নের সম্মুখ্খীন হতে হচ্ছে। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে মানি লন্ডারিং এর প্রশ্ন তোলা হয়। এসব ব্যাপারে সেদেশে থাকা বাংলাদেশী দ;ূতাবাসের সাহায্য চেয়েও কোন সমাধান পাওেয়া যায় না। তাই হুন্ডির মাধ্যমে লেন-দেন করাটা প্রবাসীরা সহগজ মনে করেন। 
বাংলাদেশ সরকার বিদেশগামী ও প্রবাসীদের বিভিন্ন ধরণের প্রতারণার হাত থেকে বাঁচাতে চেষ্টা করছে। এব্যপারে একটি নতুন আইনের খসড়ায় মন্ত্রীসভার অনুমোদন পাওয়া গেছে। প্রতারণার জন্য সর্বোচ্চ ৭ বছরের জেল ও ৫ লক্ষ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এ আইনটি ’বৈদেশিক কর্মসংস্তান ও অভিবাসী আইন ২০১৩ নামে পরিচিত। বিদেশে শ্রমিক পাঠানো এজেন্সিগুলোর স্চ্ছতা ও জবাবদিহীতি নিশ্চিত করা এবং অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণে এ আইন তৈরি করা হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ। বহুকষ্টে অর্জিত ঘাম নিসৃত অর্থ পাঠিয়ে তারা গ্রামীণ অর্থনীতিকে বদলে দেয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু  যখন তাদের  কেউ বিদেশে বিপদে পড়েন তখন সহযোগীতা করার তেমন কাউকে পাওয়া যায় না; এটি নিতান্তই দুঃখজনক। আমরা আশা করি নতুন আইন প্রনয়ন ও বাস্তবায়ন করা হলে এখাতে দুর্নীতি ও ভোগান্তি কমবে। আর্কাইভ থেকে ৩১/০৮/২০১৭


লেখক: মমিনুল ইসলাম মোল্লা,প্রভাষক, ক্যাম্পেনার সিডিএলজি






শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.