প্রসঙ্গঃ অপরের মতামত গ্রহণ ও বর্জণ
মমিনুল ইসলাম মোল্লাশান্তির ধর্ম ইসলাম। ইসলামে পরমত সহিষ্ঞুতা বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে। এটি একটি মহৎ গুণ। আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। গণন্ত্রের সাফল্য নির্ভর করে পরমত সহিষ্ঞুতার উপর। বিশিষ্ট দার্শনিক ভলটেয়ার বলেছেন “ আমি তোমার মতকে গ্রহণ নাও করতে পারি কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য জীবন ও দিতে পারি। ”অন্যের মতামতকে প্রাধান্য দিলে নিজেকে ছোট মনে করার কোন কারণ নেই। এতে বরং পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালবাসা বৃদ্ধি পায়। কোন কারণে অন্যেও মতামত গ্রহণ করা সম্ভব না হলে সে মতকে উপেক্ষা করা যাবে না। সে মতের অসারতা বুঝিয়ে নিজের মতামতকে প্রাধান্য দেয়া যেতে পারে। কেননা গণতন্ত্রে জনমতকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দেয়া হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় জনমত হচ্ছে গণতন্ত্রের অতন্ত্র প্রহরী। জন স্টুয়ার্ট মিল এর মতে “ কোন সুনির্দিষ্ট জাতীয় সমস্যার উপর জনগণের সংগঠিত অভিমতের নামই জনমত”। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমত গ্রহণ করে দেশের সমস্যা সমাধান করা যায়। তবে বৃহত্তর কল্যাণে অধিকাংশ লোকের মতামত গ্রহণ করা হলেও অন্যান্য মতামতকে কোনভাবেই অবজ্ঞা করা যাবে না। মুসলমানদের জীবনের সকল ক্ষেত্রে এ গুণের প্রতিফলন ঘটানো যেতে পারে। ক্ষমা ও উদারতার মাধ্যমে পৃথিবীতে স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি করা যেতে পারে। ক্ষমাশীল ব্যক্তি সহজেই অন্যের মন জয় করতে পারেন। হযরত আবু হোরায়রা থেকে বর্ণিত “ হযরত মুসা (আঃ ) আল্লাহ তায়ালাকে জিজ্ঞেস করেন হে রব! তোমার নিকট কোন বান্দা বেশি মহিমান্বিত ? জবাবে আল্লাহ বল্লেন- যে ব্যক্তি প্রতিশোধ নেয়ার মত ক্ষমতা থাকা সত্বেও ক্ষমা করে দেয় ( মিশকাত ২/৪৩৪) ।” আমরা অনেক সময় ক্রোধ বা জেদের বশে অনেক কিছু করে থাকি। এর ফল কি হবে তা ভেবে দেখি না। এব্যপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন- যারা অসচ্ছল- সচ্ছল উভয় অবস্থায় দান করে এবং যারা ক্রোধ সমন্বয়কারী আর মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল , আল্লাহ নেক্কার লোকদের ভালবাসেন ” (সূরা আল ইমরান- ৩ঃ১৩৪ )। আমাদের প্রিয় নবি হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) এর জীবনে সহনশীলতার বহু দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই। মহানবী ( সাঃ ) ৬২২ সালে মক্কা থেকে মদীনায় হিযরত করেন। হিযরতের ৬ষ্ঠ বছরে তিনি ওমরা পালনের জন্য মক্কার দিকে রওয়ানা হন। সেখানে মুশরিকরা তাঁকে বাঁধা দিলে তিনি সাহাবীদের নিয়ে হুদায়বিয়া নামক স্থানে অবস্থান নেন। সেখানে মুশরিকদের সাথে যে সন্ধি হয় সেটি ইসলামের ইতিহাসে “ হুদায়বিয়ার সন্ধি” নামে পরিচিত। এখানে রাসূলের সহিষ্ঞুতার পরিচয় পাওয়া যায়। সন্ধি প্রস্তাবে মুসলমানদের পক্ষে “মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” লিখা হলে মুশরিক নেতা আমর আপত্তি করে বল্ল- “ আমরা যদি তাকে রাসূলুল্লাহ মানতাম তাহলেতো হতোই। লেখা হোক মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ। ” হযরত আলী (রাঃ ) এতে দিধান্বিত হলে না রাসূল নিজে তা কেটে দেন এবং পরবর্তীতে মুশরিক নেতার ইচ্ছা অনুযায়ী সন্ধিপত্র লিখা হয় ।
ক্ষমা ও পরমত সহিষ্ঞুতার ফলে একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে শান্তি আসতে পারে। বিরোধীপক্ষ বন্ধুতে পরিনত হতে পারে। ফলে অসংযমী আচরণকারীরা ধীরে ধীরে দেশপ্রেমিকে পরিণত হয়। দেশটি বাঁধার সকল প্রাচীর ভেঙ্গে শান্তির দিকে ধাবিত হতে পারে। বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের সংবিধানে গণতন্ত্রের বিধান রাখা হয়। তারপর বিভিন্ন সময় তা বাধাগ্রস্ত হলে গণতন্ত্রের চারা গাছটি সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারেনি। ইতিহাসের সিঁড়ি বেয়ে পেছেনের দিকে গেলে দেখা যায় খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে সর্বপ্রথম গ্রিকগণ “ গণতন্ত্র ” শব্দটি ব্যবহার করেছেন। সে হিসেবে গণতন্ত্রের ধারণা অতি প্রাচীন। প্রায় ৩ হাজার বছর পূর্বে ইতিহাসবিদ হিরোডটাস গণতন্ত্র সম্পর্কে বলেছেন- “ গণতন্ত্র এমন এক ধরণের শাসন পদ্ধতি যেখানে শাসন ক্ষমতা কোন শ্রেণি বা শ্রেণিসমুহের ওপর ন্যস্ত থাকেনা, বরং ব্যাপকভাবে তা সমাজের সদস্যদের উপর ন্যস্ত থাকে।গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণের শাসন। মূলত জনগণের সম্মতিতেই শাসক পরিচালিত হয়। তাই সহনশীলতা জনগণের মধ্যেও থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে সরকার অস্থায়ী , রাষ্ট্র স্থায়ী। তাই রাষ্ট্রের বৃহত্তর কল্যাণে জনগণকেই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নেতৃবৃন্দ অনেক সময় দলীয় স্বাথর্কে বড় করে দেখেন। নেতা-কর্মীরাও যদি তাতে সায় দেন তাহলে সর্বনাশ হয়। তাই গণতন্ত্র যেহেতু জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা জনগণের শাসন। তাই অন্ধভাবে নেতৃবৃন্দের অনুসরণ করা উচিত নয়। প্রয়োজনে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে নেতা-কর্মীদের দিক নির্দেশনা দিতে হবে । গোঁড়ামী ত্যাগ করে কিছুটা ক্ষতি স্বীকার করে হলেও সমঝোতায় পোঁছতে হবে। অস্থিতিশীলতা রোধ করতে হলে ক্ষমা ও সহনশীলতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলমান তারা ইসলাম পরিপন্থী নয় এমন শাসন ব্যবস্থা চায়। আর এজন্য আমাদের সকলের মধ্যে সহনশীলতার গুণ থাকতে হবে। আমরা একগুয়েমী ত্যাগ করে ক্ষমা, মহানুভবতা, ও সহনশীলতার মনোভাব নিয়ে এগুলো এদেশের শান্তি কেউ আটকে রাখতে পারবে না। রসুল সাঃ ) বলেছেন- যে মুসলমান মানুষের সাথে মিলে থাকে এবং তাদের কষ্ট ও আঘাত সহ্য করে সে ঐ ব্যক্তি থেকে অধিক শ্রেয় যে কারো সাথে মিলেনা এবং কারো কষ্ট সহ্য করেনা। ( তিরমিজি /মেশকাত ২/৪৩২)
লেখকঃ মমিনুল ইসলাম মোল্লা,গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের ক্যাম্পেনার, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক ও সাংবাদিক, ধর্মীয় গবেষক,সহকারী সম্পাদক,দৃষ্টান্ত ডট কম কুমিল্লা।