মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপের (মোজাফ্ফর) গেরিলাবাহিনীর অবদান
মমিনুল ইসলাম মোল্লা
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্তদানকারী দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি যা সংক্ষেপে ন্যাপ নামে পরিচিত। বর্তমানে এদলটির নেতৃত্ত দিচ্ছেন বর্ষিয়ান নেতা অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ। তিনি কুমিল্লা জেলার দেবিদ্ধার থানার এলাহাবাদে ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল জন্ম গ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম এ পাশ করার পর চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ ও ঢাকা কলেজে ও পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু শিক্ষকতা পেশা তাকে বেশি দিন আটকে রাখতে পারে নি। তিনি শোষিত, নিপিড়িত, নির্যাতি জনগণের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা ছেড়েে চলে আসেন জনগণের কাতারে। ১৯৩৭ সালে তার রাজনৈতিক জীবনের হাতে খড়ি; যদিও সক্রিয়ভাবে (চাকুরি ছেড়ে দিয়ে) রাজনীতিতে আসেন ১৯৫৪ সালে। তখন তিনি দেবিদ্ধার আসন থেকে খান বাহাদুর কায়দে আযম মাওলানা মফিজ উদ্দিন আহমদকে পরাজিত করে প্রথম বারের মত এমপি নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে তিনি পূনরায় জাতীয় সংসদের সদস্য পদ লাভ করেন। আশির দশকে তিনি একবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার। এ সরকারে আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ স্থান পেলেও সেপ্টেম্বর মাসে গঠিত জাতীয় উপদেষ্টা কমিটিতে অন্যান্য দলের নেতাদের স্থান দেয়া হয়। ৮ সেপ্টেম্বর গঠিত এ কমিটির আহবায়ক ছিলেন তাজউদ্দিন আহমদ। সদস্যদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, মাওলানা আঃ হামিদ খান ভাসানী, মনোরঞ্জন ধর ও কমরেড মনিসিং। তিনি বাঙ্গালীদের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন আদায়ের লক্ষে বুদাপেস্টে অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনে যোগদান করা করেন। এছাড়া জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করেন। ৪ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব করা হলে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো প্রদান করে। ৫ ডিসেম্বর একই প্রস্তাব আনা হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ২য় বার ভেটো দেয়। এসময় “তাস ” মারফত এক বিবৃতিতে সোভিয়েট সরকার “পূর্ব বাংলার জনগণের আইন সঙ্গত অধিকার ও স্বার্থের স্বীকৃতির ভিত্তিতে সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধানের দাবী জানানো হয়। আমেরিকা যখন দেখল যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব নাকচ হয়ে গেছে তখন পাকিস্তানের পক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ৯ ডিসেম্বর নির্দেশ দেয়া হলে ১২ ডিসেম্বর বঙ্গোপসাগরে ৭ম নৌবহর প্রবেশ করলে সোভিয়েট ইউনিয়ন একটি অত্যাধুনিক নৌযান পাঠায়। এসংবাদ পেয়ে ৭ম নৌবহর পিছু হটে যায়। বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি মুক্তিযুদ্ধকালীন সংবাদ জনগণের মধ্যে পৌছেঁ দেয়ার লক্ষে “নতুন বাংলা” নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করে। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের সম্পাদনায় মুজিবনগর থেকে পত্রিকাটি প্রকাশ পেত। ১৯ টি সংখ্যা প্রকাশিত হয় । এতে মুক্তিযুদ্ধের খবর ছাড়াও সরকারের পরামর্শদাতা কমিটির কার্যক্রমের উপরগুরুত্ব দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপের আলাদা গেরিলা বাহিনী ছিল। ন্যাপ, সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলার সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আহুত রাওয়ালপিন্ডির গোলটেবিল বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্ব করেন। মূলত ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, ৬৬ সালের ৬ দফা এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুথ্বানে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেন। বিশিষ্ট কলামিস্ট , লেখক, ও গবেষক আঃ গাফ্ফার চৌধুরি লিখেছেন-(ন্যাপের ৫৩ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকিতে) “১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের সাথে রাওয়ালপিন্ডির গোলটেবিল বৈঠকে আপোস প্রস্তাবে অসম্মত শেখ মুজিব ঢাকায় ফিরে এলে বিমান বন্দর থেকে কাকরাইল পর্যন্ত জনতার সংবর্ধনা ও মিছিলে খোলা ট্রাকে জনতার অভিভাবদনের জবাব দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তখন বঙ্গব›ধুর পেছনে খালা ট্রাকেই জনতার অভিভাদন গ্রহণরত এই নেতাকেও আমি দেবদারু বৃক্ষের মত শির উচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি।”
লেখক: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক, সাংবাদিক ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের জন্য ক্যাম্পেনার, কুমিল্লা।
