ইতিহাস হাজার বছরের ঐহিহ্য লালিত গোমতী পাড়ের দেবিদ্বার মমিনুল ইসলাম মোল্লা

ইতিহাস
হাজার বছরের ঐহিহ্য লালিত গোমতী পাড়ের দেবিদ্বার
মমিনুল ইসলাম মোল্লা


আবহমান বাংলার ঐতিহ্যে লালিত শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতির লীলাভ‚মি ময়নামতি খ্যাত কুমিল্লার স্বনামধন্য উপজেলা দেবিদ্বার। ১৯১৫ সালের প্রতিষ্ঠিত এ থানা বর্তমানে পৌরসভায় উন্নীত হয়েছে।নামকরণঃ দেবিদ্বারের নামকরণ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন- এখানে প্রচুর পরিমাণে হিন্দু বসবাস করতো। হিন্দুরা ধর্মীয় কারণে বিভিন্ন দেব-দেবীর উপাসনা করত। হিন্দুদের উপাসনার দেবীর দুয়ার বা দ্বার থেকেই হয়েছে “দেবীদুয়ার” যা কালক্রমে দেবিদ্বার নামে পরিচিতি লাভ করেছে। আবার কেউ কেউ বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে- ব্রিটিশ শাসনামলে জন ডেভিড এর সাথে এলাকাবাসীর ওয়ার বা যুদ্ধ হয়েছিল। সে থেকেই ডেভিডওয়ার বা দেবিদ্বার শব্দটি এসেছে।

সীমানাঃ দেবিদ্বারের উত্তরে মুরাদনগর, দক্ষিণে চান্দিনা, পূর্বে বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়া এবং পশ্চিমে মুরাদনগর উপজেলঅ। দেবিদ্বারের আয়তন ২৩৮.৩৬ বর্গ কিলোমিটার। উপজেলা শহর ২টি মৌজা নিয়ে গঠিত। দেবিদ্বার থানা সৃষ্টি হয় ১৯১৫ সালে। থানাকে উপজেলা করা হয় ১৯৮০ সালে। পৌরসভা বাদে দেবিদ্বারে ১৫ টি ইউনিয়ণন এবং ১৪১টি মৌজা ও ২০১ টি গ্রাম রয়েছে।
রাজনীতিতে দেবিদ্বারঃ দেবিদ্বারে বহু রাজনৈতিক নেতা জন্মেছেন। বিট্রিশ শাসনামলে ব্রিটিশ, নীলকর ও জমিদারদের বিরুদ্ধে পরিচালিত আন্দোলনে দেবিদ্বারের শান্তি-সুনীতিসহ বহু নারী-পুরুষ অংশ নিয়েছেন।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা মুক্তিযুদ্ধ কালীন মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের বাড়ি উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামে। তিনি ১৯৫৪ সালে অত্র এলাকার সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। এ ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দেবিদ্বারের যোদ্ধারা বিশেষ অবদান রেখেছেন। ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কে পাকবাহিনীর সঙ্গে বাঙ্গালীর এক সংঘর্ষ হয়। এতে ৩৩ জন বাঙ্গালী শহীদ হন। বর্তমানে দেবিদ্বার নিউমাকের্ট একটি গনকবর রয়েছে। 
ধর্ম প্রচারে দেবিদ্বারঃ আমরা জানি হযরত শাহজালাল (রহঃ) ১৩০০ সালের দিকে বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করেন। কিন্তু এরও দেড়শ বছর আগে দেবিদ্বারে ১১৫০ সালে শাহ্ মোহাম্মদ আব্বাস হুসাইনী দেবিদ্বারের রাজামেহের এলাকায় ইসলাম প্রচার করেন বলে জানা যায়। রাজামেহের এখনও ওনার মাজার এবং বংশধরগন রয়েছেন।
এছাড়া দেবিদ্বারের এলাহাবাদে উটখাড়ায় দুই কামিল পীরের মাজার রয়েছে। তারা হযরত শাহ জালাল (রহঃ) এর সফরসাঙ্গী। উটযোগে ইসলাম প্রচারের নির্দেশ দেন বলেন“ যেখানে গিয়ে উট থেকে যাবে সেখানে ইসলাম প্রচার করবে” নির্দেশ মোতাবেক এলাহাবাদে এসে উট খাড়া হয়ে যাওয়ায় তারা সেখানে ধর্ম প্রচার করেন। মসজিদ ঐহিহ্যের দেবিদ্বারে রয়েছে নতুন ও পুরাতন কয়েকটি ঐতিহাসিক মসজিদ। নতুন মসজিদের মধ্যে গুনাইঘরের বাইতুল আজগর গম্বুজ মসজিদ অন্যতম। কোটি টাকা ব্যায়ে দেবিদ্বারের সাবেক সংসদ ইঞ্জিনিয়ার মঞ্জুরুল আহসান মুন্সী এ মসজিদ নির্মাণ করে দেবিদ্বারকে সারা দেশে পরিচিত করে তুলেছেন।
এছাড়া দেবিদ্বারের নূরমানিক চরে রয়েছে পাঁচশ বছরের পুরনো মসজিদ। সাত গম্বুজ বিশিষ্ট এ মসজিদ পঞ্চদশ শতাব্দীর আগে মরহুম সৈয়দ নূর আহম্মদ কাদেরী পীর সাহেব প্রতিষ্ঠা করেন বলে জানা যায়। এ ছাড়া দেবিদ্বারের চরবাকরে রয়েছে শাহ্ বাকেরের মসজিদ। হযরত শ্হ বাকের (রহঃ) হযরত শাহ জালালের সফরসঙ্গী ছিলেন বলে অনুমান করা হয়।
শুধুমাত্র ইসলাম ধর্ম নয় হিন্দু ধর্মের ঐহিহ্যও রয়েছে দেবিদ্বারে। উপজেলার ধামতী গ্রামে রয়েছে দেশের সর্ব প্রাচীনতম কোনাকৃতির শিব মন্দির। মন্দিরের তত্ত¡াবধায়ক শ্রী বীরেন্দ্র পাল জানান- এ মন্দিরটি বাংলা ১০৩৮ বা ইংরেজী ১৬৩১ সালে নির্মিত হয়। এটি নির্মাণ করেন রঘুনাথ পাল। তিনি একজন বিখ্যাত জমিদার ছিলেন। বাংলা পিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী দেবিদ্বারে ৪৫১ টি মসজিদ ৯টি মাজার ও ২৭টি মন্দির রয়েছে।
দেবিদ্বারের কৃষিঃ কৃষি প্রধান দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের কৃষি প্রধান ৮টি জেলার মধ্যে কুমিল্লার স্থান অন্যতম। আর কুমিল্লার ১৫টি উপজেলার মধ্যে দেবিদ্বার প্রথম। দেবিদ্বারের ৫৩.৬৮% লোক কৃষির উপর নির্ভরশীল। চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ১৬১৭৯.৬৮ হেক্টর, এক ফসলী ৩.৭৫%, দুফসলী ৪১.২৭% এবং তিন ফসলী ৫৪.৯৮%। এর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, তিন ফসলী জমির পরিমান কুমিল্লার অন্যান্য উপজেলার তুলনায় সবচেয়ে বেশী। তাই এখানে সবচেয়ে বেশী পরিমানে ধান, পাট ও আলু উৎপাদিত হয়।
কুমিল্লার কোতোয়ালী উপজেলায় পরই আধুনিক কৃষি প্রযুক্তিতে দেবিদ্বারের স্থান। আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য উপজেলার মহব্বত আলী ১৯৬৫ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন।
আমাদের প্রধান খাদ্য ভাত হলেও ধান উৎপাদনের মাধ্যমে আমরা খাদ্য সঙ্কট মোকাবেলা করতে পারিনা। তাই বর্তমানে সারাদেশে ধান বা ভাতের বিকল্প হিসেবে আলু ও ভ‚ট্টার উপর আমরা নির্ভরশীল। দেবিদ্বারবাসী আলু চাষে অনেক আগেই সাফল্য সাভ করেছে। কয়েক বছর ধরে, দেবিদ্বারে ভ‚ট্টার বাম্পার ফলন হচ্ছে।
অতীত ঐতিহ্যঃ কুমিল্লার ময়নামতির বৌদ্ধ বিহার কুমিল্লার ঐতিহ্য। ঐতিহাসিকদের মতে আজ থেকে প্রায় বারশ বছর আগে এখানে বৌদ্ধ রাজাদের নিবাস ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানকে ময়নামতিতে প্রাপ্ত একটি ট্যারাকোটা উপহার দিয়ে প্রমান করেছিলেন। আমাদের দেশের সভ্যতার ইতিহাস কতটা পুরানো।
কিন্তু দেবিদ্বারের গুনাইঘরের ইতিহাস আরও পুরনো। ১৯৩০ সালে উপজেলার গুনাইঘর থেকে একটি তা¤œলিপি আবিষ্কৃত হয়। তা¤œ লিপি অনুযায়ী এখানে ৫০৭ খৃষ্টাব্দে “আশ্রম বিহার” নির্মিত হয়। এর পূর্বেই নির্মিত হয়েছিল রাজবিহার। আর রাজবিহার নির্মাণ করেছিলেন মহারাজা বৈন্যগুপ্ত। অনুসন্ধানে আরো জানা যায়- এখানে কামদেবের নামে একটি শিবমন্দিরও ছিল। কিন্তু এখন এসবের কিছুই নেই। এসব-ই স্থানীয় অধিবাসীদের স্মৃতি। জাতীয় ইতিহাসেও দেবিদ্বারের হারিয়ে যাওয়া দু হাজার বছরের পুরাকীর্তির ইতিহাস সঠিকভাবে স্থান পায়নি।
দেবিদ্বারের খদ্দরঃ কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী পোশাক খদ্দর। জানা যায়- তাঁতীরা উৎপাদন বাড়ানোর জন্য পায়ে চালিত তাঁতের প্যাডেলের নিচে মাটিতে গর্ত করতো। এই গর্ত বা খাঁদ থেকে যে কাপড় উৎপন্ন হতো সে কাপড়ই খাদি। এভঅবেই খাঁদির নামকরণ হয়। মহাতমা গান্ধীর অনুপ্রেরণায় কুমিল্লার অভয় আশ্রমকে কেন্দ্র করে থাদি শিল্প গড়ে উঠলো এ কাপড় চান্দিনা ও দেবিদ্বারের বিভিন্ন গ্রামে তৈরী হতো।
১৯২৬-২৭ সালে একটি ৮ হাত লম্বা ধুতি যেখান বিক্রি হতো মাত্র পাঁচ শিকা দামে। সে সময় কুমিল্লা অভয় আশ্রম প্রায় ৯ লাখ টাকা মূল্যের খাদি কাপড় বিক্রি করেছিল। তখন দেবিদ্বারের বরকামতা, ভালী, মোহনপুর, সাইতলাসহ বিভিন্ন গ্রামে এ কাপড় তৈরী হতো।
দেবিদ্বারের বরকামতায় তৈরী খাদি কাপড় ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে বিশেষভাবে সমাদৃত। এখনও উক্ত গ্রামের শ্রী নিবাস ২টি, মতিলাল দেবনাথ ১টি, রনিজিত দেবনাথ ৭টি ভ‚বন দেবনাথ ১টি ও চিন্তাহরণ ২টি তাঁত পরিচালনা করে দেবিদ্বারের এতিহ্য ধরে রেখেছেন। এছাড়া দেবিদ্বারের হাবিবুর রহমান জুট মিল, শাহদাত জুটমিল পাটের তৈরী দ্রব্যাদির চাহিদা পূরণ করছে।
বাংলা পিডিয়ায় প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী কুমিল্লা সদর উপজেলা বা কুমিল্লা শহর, ব্যাতীত উপজেলাগুলোর মধ্যে শিক্ষার হারের দিক থেকে দেবিদ্বার প্রথম। দেবিদ্বারের শিক্ষার হার ৩৫.১%, লাকসামে ৩৪.৪% এবং বুড়িচং থানায় এ হার ৩৪.৩%। এ ছাড়া পৌরসভা হিসেবেও দেবিদ্বারে শিক্ষার হার ৫৬.৯%। যেখানে কুমিল্লায় সদরে এ হার ৫৫%।
দেবিদ্বারের পাঠশালাগুলোর মধ্যে এলাহাবাদের রজনী ঠাকুরের পাঠশালা, উচ্চ বিদ্যালয়ের মধ্যে ফুলতলী উচ্চ বিদ্যালয় এবং কলেজগুলোর মধ্যে দেবিদ্বার এস.এ. সরকারি কলেজ অন্যতম এগুলো দেবিদ্বারে শিক্ষার আলো জ্বালাতে সাহায্যে করেছে। বর্তমানে দেবিদ্বারে কলেঝ ৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৪৩টি মাদ্রসা ২৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১২০টি বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ৩৭টি, স্বল্পব্যায়ী স্কুল ১৮টি এবং স্যাটেলাইট স্কুল রয়েছে ১৭টি।
কুমিল্লা জেলার মধ্যে ১৮৫৮ সালে মুরাদনগর ও দাউদকান্দি থানা সৃষ্টির পরই ১৯১৫ সালে দেবিদ্বার থানা সৃষ্টি হয়। বর্তমানে দেবিদ্বার সদর ইউনিয়নটি পৌরসভা হিসেবে পরিচিত। এখানে ১টি সরকারি কলেঝ ১টি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ৫টি হাই স্কুল ও ১টি ফাজিল মাদ্রসা, ২টি পার্ক ও ১টি গন পাঠাগার রয়েছে। এ ছাড়া ১টি স্বাধীনতা সৌধ ও ১টি খেলার মাঠ আছে। দেবিদ্বারে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি হওয়ায় বিভিন্ন এলাকার জনসাধারণষ নিরাপদ আশ্রয়স্থান হিসেবে এ দেবিদ্বার সদরে বাড়ি কিনেন কিংবা ভাড়া থেকে দেবিদ্বারকে আরো পৌরবার্ধিত করছে।


শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.