গল্পঃ আমেনা
ও তার তিন
সন্তান
মমিনুল ইসলাম
মোল্লা, স্বামীর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার উপার্জণ দিয়ে সংসার চলে না। তাই আমেনাকেও একটি কাজ নিতে হলো । দুই
জনের আয় দিয়ে কোন রকমে তাদের সংসার চলছে । আমেনার
বড় ছেলে জাভেদ পার্শ্ববর্তী আক্কেলপুর জায়গীর থেকে আক্কেলপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে । লেখাপড়ায়
বেশ ভাল হলেও দুষ্টুমিতে তাকে হারানোর মত ছেলে তিন গ্রামেও কেউ নেই ।বিশেষ করে বৈশাখ মাস তার গাছে গাছেই কাটে।
বৈশাখ মাসের শেষ দিন ।চারদিকে পাকা আমের গন্ধ মৌ মৌ করছে ।ছেলে মেয়েরা আম কুড়োনো নিয়ে আনন্দ উল্লাস করছে । তাদের
এ আনন্দে যোগ
দেয়ার জন্য বাড়িতে আসে জাভেদ । জাভেদ
তার বন্ধু কামালকে নিয়ে সাড়া গ্রাম ঘুড়ে বেড়ায় ।ঘুরতে ঘুরতে দুপুর হয়ে যায় ।হঠাৎ তার মনে হলো , ইস্ বন্ধুকে
নিয়েতো আমতলায় যাওয়া হয়নি ।কামালকে নিয়ে এক দৌড়ে জাভেদ চলে গেল পুকুরপাড়ের আম বাগানে ।অনেক দিনের পুরনো বাগান । তার
দাদা সখ করে এ বাগানটি করে
গিয়েছিলেন। বাগানে
ঢুকেই জাভেদ লম্বু আম গাছটিতে উঠতে উদ্যত হলো ।
কামাল- গাছে উঠবিনা জাভেদ ।
জাভেদ-কেন উঠবোনা ?
কামাল- আমার কেন জানি ভয় লাগছে ।তুই আমার সামনে উঠ ।দুজনে নিজের হাতে পাকা পাকা আম পেড়ে গাছে বসে বসে টিপে টিপে খাব । কি
মজা হবে তাই না ?
কামালঃ
দুপর বেলা গাছে চড়তে বাবা নিষেধ করেছেন ।তুইও উঠিসনা ভাই ।পাকা পাকা আমগুলো সব মগ ডালে, ওখান থেকে পড়ে গেলে ০-০-০-। আর ভাবতে পারে না কামাল ।
জাভেদ-আরে এত ডরাইলে কি চলে ? ঠিক আছে
বন্ধু, তুমি নিচে থেকে শান্ত ছেলের মতো বসে থাক। বলতে বলতে মিষ্টি আম গাছে উঠতে লাগলো জাভেদ ।
কাঁঠবিড়ালীর মতো লাফিয়ে
লাফিয়ে একেবারে
মগঢালে চলে
গেল জাভেদ। চিকন ডালের বড় আমটি পেড়ে বন্ধুকে বলল কেস ধরতো দোস্ত। কামাল ধরতে না পারায় সেটি ময়লার মধ্যে গিয়ে পড়ল। ট্রাইজারে ঘষা দিয়ে খেতে খেতে বন্ধুর প্রশংসা করলো। আরেকটি আম দেয়ার জন্য গাছের এদিক সেদিক ওকি দিতে লাগল জাভেদ । পেয়েছি
পেয়েছি বলে চিৎকার করতে লাগল।
কামাল- কি পেয়েছিস ?
জাভদ - একটি বড় পাকা আম। পেকে
এমন হলুদ হয়েছে যে মুখে না দিতেই গলে যাবে।
কামাল- এটা যে একেবারে শেষ প্রান্তে ।এত রিস্ক নিয়ে যাবি না ভাই ।ডাল ভেঙ্গে পড়ে গেলে সর্বনাশ হবে। আমার ভয় হয় , তুই নেমে
আয় ভাই!
জাভেদঃ
তুই এসব নিয়ে চিন্তা করিস না। ভাল কিছু পেতে কিছুটা রিস্ক নিতে হয় ।আম নেয়ার জন্য রেডি ? জাভেদ বহু আকাঙ্খিত আমটি নেয়ার জন্য মগ ডালে উঠতে লাগলো । একবার
মাটির দিকে তাকিয়ে কিছুটা দমে গেল। আবার দু কদম এগিয়ে গেল। এর চেয়ে চিকন ডালে ও সে বহু
বার উঠেছে ।এছাড়া এধরণের আম সাধারণত পাওয়া যায় না । জাভেদ
আমটা আনার জন্য হাত বাড়াতেই পা ফসকে পড়ে গেল মাটিতে ।জাভেদ গাছ থেকে মাটিতে পড়ে যাওয়ায় কামাল কি করবে বুঝে উঠতে পারল না। বাগান থেকে একটু দূরে গিয়ে দেখল কেউ আছে কি না ?
কামালঃ
কে আছেন আমাকে একটু সাহায্য করুন ।আমাকে সাহায্য করুন ।
কান্নার
আওয়াজ শুনে একজন কৃষক এগিয়ে এলো ।কি হয়েছে ডাকছো কেন ?
কামালঃ
এই কে আছেন ? একটু এদিকে আসেন।আমাকে একটু সাহায্য করুন । আমাকে
সাহায্য করুন ।একজন বৃদ্ধ দৌড়ে এসে বল্ল-কি হয়েছে
ডাকছো কেন ?
জাভেদ
গাছ থেকে পড়ে গেছে। আপনারা একটু সাহায্য করুন ।হাশেম, কাশেস, জসিম তোরা তাড়াতাড়ি আয় মাস্টার সাহেবের ছেলে গাছ খেকে পড়ে গিয়েছে ।কামাল তাদের চেষ্টায় জাভেদের প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পাদন করল। তারপর অবস্থা বেগতিক দেখে তারা তাকে ধরে নিয়ে গেল হাসপাতালে । হাসপাতালের
ডাক্তারগণ তাকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করলেন ।তাড়াতাড়ি বিশেষ এম্বুলেন্স ডেকে তাকে কুমিল্লা নেয়া হলো।
জাভেদেরে বাবা বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে এসে ।আমেনার কাছে সবকিছু শুনে তিনি কালবিলম্ব না করে হাসপাতালে গেলেন ।জাভেদ অসুস্থ, ওদিকে জাভেদের বাবাও বাড়িতে নেই ।তাই আমেনা অফিসে গেলেন না। ছেলের কথা ভেবে সে অস্থির হয়ে গেলে। তিনি বার বার উঠানের দিকে তাকাতে লাগলেন ।দেখতে দেখতেই জাভেদের বাবা এসে গেলেন ।
আমেনাঃ
কি হয়েছেগো আমার জাভেদের ? আর ভেবোনা, আল্লার রহমতে এখন ভাল ।
আমেনাঃ
জাভেদেরে পাটা কি ভেঙ্গে গিয়েছে ?
বাবঃ
না মচকে গিয়েছিল ।এখন ভাল হয়ে গেছে।
আমেনাঃ
আমার জাভেদ কবে আসবে গো !“
বাবঃ
কিছুদিনের মধ্যে চলে আসবে ।
সাত
দিন হয়ে গেল জাভেদ এখন অনেকটা সুস্থ ।আগামীদিন সকালে তাকে রিলিজ দেয়া হবে ।রিলিজ নিয়ে জাভেদ বাড়িতে রওয়ানা হলো। ওদিকে মা ভোর থেকেই জাভেদেরে আগমণ প্রতীক্ষায় উঠানের কোনে বসে আছেন ।
জাভেদ
তুই এসেছিস বলেই- আমেনা জাভেদকে বুকে জড়িয়ে ধরল ।মা এবং ছেলে দুজনের চোখেই পানি এসে গেল।
জাভেদঃ
মা তুমি আর চিন্তা করো না ।আমি ভাল হয়ে গেছি ।
আমেনাঃ
আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ ।কাপড় পাল্টিয়ে খেতে আস ।জাভেদ অনেকদিন পর মায়ের সাথে খেতে বসল ।হাসপাতালের নরম রুটি ছিল তার প্রধান খাদ্য ।আজ বুঝতে পারে মায়ের হাতে খাওয়ার স্বাদই আলাদা ।জাভেদের ছোট ভাই কবির এতক্ষণ নিরবে ভাইয়ের কথা শুনছিল ।জাভেদ যখন খেয়ে দেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল তখন কবির গিয়ে হাজির হলো ।
জাভেদঃ
কিরে এমন ঘুর ঘুর করছিস কেন ? তোর লেকাপড়া
নেই ?
কবিরঃ
ভাইয়া তুমি অনেকদিন পর বাড়ি এলে তাই তোমাকে দেখতে এলাম ।
জাভেদঃ
ও , তাই বুঝি ?
কবিরঃ
ভাইয়া তুমি এসি গাড়িতে উঠেছ ?
জাভেদঃ
হ্যা, উঠেছি ।
কবিরঃ
এসি গাড়িতে খুব আরাম তাই না ?
জাভেদঃ
তুই একদিন উঠে দেখিস ।গরমের দিনে অনেক শান্তি মনে হবে ।
কবিরঃ
হ্যা ভাইয়া ,আমি এসি গাড়িতে উঠব ।তোমার মতো গাছ থেকে পড়ে হলেও----( মনে মনে )ভাইয়ের কাছ
থেকে চলে আসে কবির ।
কবির
ভেবে পায়না কিভাবে তার সাধ মেটানো যায় সে অনেক ভেবে ও ঠিক করতে
পারল না কি করা যায়। এই সেই আম গাছ যাতে উঠে ভাইয়া গাড়িতে চড়েছিল
আমি
সেটাতেই উঠব ।ভাইয়া যে আমটি পারতে পারেনি সেটাতেই
উঠব ।কবির আনমনে কথাগুলো বলতে লাগল ।তারপর একলাফে সেই গাছটিতে উঠে গেল কবির ।অন্য কোন আমের প্রতি নজর না দিয়ে পুকুরে উপর হেলানো ডালটিতে ।আমটি নেয়ার জন্য হাত বাড়াতেই ডাল ভেঙ্গে পড়ে গেল মাটিতে ।মা০-গো০- বলে সজোড়ে
চিৎকার দিল কবির ।
জাভেদের
মা আমেনা তার ছোট ছেলেটাকে নিঢয়
গোসল
করছিল । হঠাৎ কবিরের চিৎকার শুনে দৌড়ে গেলেন আম বাগানে ।সেখানে গিয়ে দেখলেন কবির আর এ জগতে নেই
।সে এতক্ষণে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে পড়পারে ।আমেনা কবিরকে ধরে হাই মাউ করে কাদতে লাগল ।কবিরের মৃত্যূর জন্য জাভেদ দায়ী ।জাভেদ তাকে এসি গাড়িতে উঠার লোভ দেখিয়েছে ।তাই জাভেদকে শাস্তি দেয়ার জন্য লাঠি
খুঁজতে লাগলো। জাভেদ মায়ের ভয়ে পাশের ঝোপে গিয়ে পালাল । ঝোপের
পাশে কি যেন নড়ে উঠলো ।সেদিকে চোখ পড়তেই জাভেদ আতকে উঠলো । মস্ত
বড় সাপ । জাভেদ
বাচাও বাচাও বলে চিৎকার করতে লাগলো ।
জাভেদ
সাপ সাপ বলে চিৎকার করতে লাগলো ।একজন পথিক তার আর্ত চিৎকারে এগিয়ে আ সলো ।জাভেদ উল্টোদিকে প্রাণপনে দৌঢ় দিল। কিন্তু সাপ দ্রুতগতিতে তার কাছে চলে আসলো। তাকে ধংশন করে পলিয়ে গেলো। পথিকটি জাভেদকে বাড়িতে নিয়ে গেলো। পাশের গ্রাম থেকে বড় বড় ওঝা আনা হলো। বহ ঝাড়-ফুক, মন্ত্র-তন্ত্র করা
হলো । কিন্তু
কিছুতেই বিষ নামানো গেলো না। সবকিছুকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে সে পড়পারে পাড়ি জমাল ।আমেনা জাভেদ ও কবিরের লাশ
উঠানে রেখে কাদতে লাগলো ।তার চিৎকারে এলাকাবাসী মাস্টার সাহেবের বাড়িতে এসে জড়ো হলো। সবাই আমেনাকে শান্তনা দিতে লাগলো ।হঠাৎ তার ছোট ছেলে অপুর কথা মনে পড়লো ।সে এক দৌড়ে গেল পুকুর পাড়ে ।সেখানে গিয়ে আমেনার চোখ কপালে উঠলে তার সোনামনি সেখানে নেই ।সবাই পুকুরের চারদিকটা একবার চক্কর দিল ।কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না। জাভেদেরে চাচতো ভাই জামাল কাঁদতে কাঁদতে পুকুরে নামলো, সাথে সাথে আরো তারেক ও হাছান দুজন পুকুরের পানিতে নেমে খোজাখুজি শুরা করলো । কিছুক্ষণ পর অপুকে পাওয়া গেল পুকুরের মাঝখানে ।আমেনা তাকে নিয়ে গেল বাড়িতে ।মাস্টার সাহেব এতক্ষণে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেছেন ।বাড়িতে ঢুকে শুধু কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলেন ।কি ঘটেছে প্রথমে তা বুঝতে পারলেন না। ছোট ছেলেটার অবস্থা খারাপ দেখে দৌড়ে গেলেন ডাক্তারের কাছে ।
মাস্টারঃ
ডাক্তার সাহেব, ডাক্তার সাহেব, তাড়াতাড়ি চলেন ডাক্তারঃ আারে কি হয়েছে আগে বলুন। আমার সর্বনাশ হয়েছে। আপনি তাড়াড়ি চলুন ।আমার দু ছেলে আগেই মারা গেছে এখন ছোট ছেলেটিকে
বাঁচান ।
ডাক্তারঃ এখন হাটের সময়, অনেক রোগী আসবে। আমি কিভাবে যাই
?
ডাক্তারঃ আমি যত টাকা লাগে দেব
, আপনি তাড়াতাড়ি চলুন।
ডাক্তারঃ ঠিক আছে,
চলুন দেখে আসি ।ডাক্তারকে নিয়ে জাভেদের পিতা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরল ।ডাক্তার সাহেব অনেক্ষণ পরীক্ষা -নিরীক্ষা করে দেখলেন শ্বাস আছে কি না ।
মাস্টারঃ কি দেখলেন ? আমার ছেলে বেচে আছে তো ?
ডাক্তারঃ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন ।
মাস্টারঃ তাড়াতাড়ি বলুন আমার আর সহ্য হচ্ছে না।
ডাক্তারঃ সরি।
মাস্টারঃ কি বলেন? আ মার এ ছেলেও মারা গেছে
?
তিনটি ছেলে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে আমি এখন কি নিয়ে বাচবো ? একথা বলে আমেনা বারবার মুর্ছা যেতে লাগলেন ।
লেখকঃ মমিনুল ইসলাম মোল্লা,কবি,
ছোট গল্পকার ও সাংবাদিক ।