মুক্তিযুদ্ধে মুরাদনগর – প্রতিরোধ যুদ্ধের পটভূমি
মমিনুল ইসলাম মোল্লা:
উপজেলার নাম (জেলার নাম সহ)ঃ
কুমিল্লা জেলার সর্ববৃহৎ উপজেলা মুরাদনগর। এটি কুমল্লা
জেলা সদর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে
অবস্থিত। এ উপজেলার
আয়তন ৩৩৯ বর্গ কিলোমিটার। এ উপজেলার উত্তরে নবীনগর দক্ষিণে চান্দিনা ও
দেবিদ্ধার পূর্বে দেবিদ্ধার, ব্রাহ্মনপাড়া ও কসবা
পশ্চিমে দাউদকান্দি, হোমনা ও বাঞ্ছারামপুর
উপজেলা। বাংলাদেশের পুরাতন থানাগুলোর মধ্যে মুরাদনগর অন্যতম । ১৮৫৮ সালে এ থানা সৃষ্টি হয়। মুক্তিযুদ্ধে এ থানার
রয়েছে গৌরবজনক ভূমিকা। যুদ্ধকালীন সময়ে কুমিল্লা ২ নং সেক্টর কে ফোর্সের আওতাধীন ছিল।
উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের
পটভূমি: মুরাদনগর উপজেলায় কয়েকটি প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ১৮৩৭ সালে কুমিল্লা
জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। কুমিল্লার দ্বিতীয় হাই স্কুল মুরাদনর ডি আর হাই স্কুল। এটি
১৮৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া ১৮৮৫ সালে বাঙ্গরা উমালোচন উচ্চ বিদ্যালয় এবং ১৯১৪
সালে জাহাাপুর কমলাকান্ত একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠার
পর ১৯৪১ সালে শ্রীকাইল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দেলনে শ্রীকাইল কলেজসহ
বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া বায়ান্ন
পরবর্তী বিভিন্ন আন্দোলনে মুরাদনগরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা বিশেষ
ভূমিকা পালন করে। কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক আমোদ এর ২৭ ফেব্রুয়ারী সংখ্যায় উল্লেখ করা হয়-১৮ ফেব্রুয়ারী
মঙ্গলবার রাজশাহীতে পুলিশের গুলিতে নিহত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের
অধ্যাপক ডক্টর সামসুজ্জোহার বিদেহী আত্মার সম্মানার্থে গৃহীত এক সিদ্ধান্ত বলে পূর্ব
পাকিস্তান কলেজ শিক্ষক সংস্থা ও পূর্ব পাকিস্তান মাধ্যমিক স্কুল সংস্থার নির্দেশে শ্রীকাইল
কলেজ ও মুরাদনগরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৩ দিন ব্যাপী কর্মসূচী পালিত হয়।
২৭ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯: কুমিল্লা
থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক আমোদ পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়- সোমবার নিখিল পাকিস্তান আওয়ামীলীগ
প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান, মুরাদনগরে গণসংযোগ
কালে জনতার উদ্দেশ্য দলীয় প্রার্থী হাজী আবুল হাসেম সাহেবের সমর্থনে ভাষণ দেন।
৭ ডিসেম্বর ৭০: পাকিস্তান
জাতীয় পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে কুমিল্লা ৯ (মুরাদনগর) আসনে নির্বাচিত হন আওয়ামীলীগ
থেকে নির্বাচিত প্রার্থী আলহাজ্ব আবুল হাসেম (১,০৯,৯৪৫) । এছাড়া আব্দুল ওদুদ ,জামাতে ইসলামী (৩৬১৪) হারুন আর রশীদ, মুসলিম লীগ কাইয়ুম (৪৭১৫) এবং আব্দুল করিম,
ন্যাপ (ওয়ালী) (১,৪৬৬) ভোট পান।
১৭ ডিসেম্বর ৭০: প্রাদেশিক
নির্বাচন হয়। কুমিল্লা ১০ মুরাদনগর আসনে আওয়ামীনীগ থেকে পাশ করেন মো: হাশেম ৪৩০৪৫,
মোবারক আলী সরকার (মুসলিম
লীগ কাইয়ুম) ২৭৩০, কাজী আ: কাসেম,
মুসলিম লীগ কাউন্সিল ২৩০৯,
আবুল ফজল খন্দকার পিডিপি ৩৩৫
ভোট পান।
উপজেলায় পাক বাহিনীর
অনুপ্রবেশ ও ক্যাম্প স্থাপন: এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি পাক বাহিনী প্রথম ক্যাম্প স্থাপন করে। কোম্পানীগঞ্জ
সহ গোমতী নদীর দক্ষিণ তীরে সরকারি খাদ্য গোডাউনে। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে পাশবিক
নির্যাতন করা হয়। ব্রিজের উপর মুক্তিযোদ্ধাদের দাঁড় করিয়ে গুলি করে গোমতী নদীতে লাশ
ফেলে দেয়া হতো। এ লাশ ভাসতে ভাসতে চলে যেতো মেঘনা নদীতে। এছাড়া গোমতী নদী দিয়ে কুমিল্লা
ক্যান্টেম্যান্ট থেকে আর্মীরা ছোট ছোট লঞ্চযোগে এসে মুরাদনগরের বিভিন্ন গ্রামে আক্রমন
করতো। জলবেষ্টিত মুরাদনগরের অন্যান্য নদী আর্চি, নৈলা, ও বুড়ি যুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনার সাথে জড়িত।
১৮ আগষ্ট পাক- সেনাদের ৩ টি দল মুরাদনগর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে হোমনা যাবার পথে মুক্তিযোদ্ধারা
২টি নৌকায় এমবুশ করলে নৌকা দুটি ডুবে যায়। এতে একজন ক্যাপ্টেনসহ ২৯ জন পাকসেনা ও ৫
জন রাজাকার নিহত হয়। এছাড়া মুরাদগরের উত্তরাংশে অবস্থিত “ অদের খাল
”দিয়ে পাশ্বর্বর্তী
থানা কসবা থেকে নৌকাযোগে এসে গ্রামবাসীদের উপর অতর্কিত আক্রমন চালাত। তাছাড়া মুরাদনগরের
আন্দিকোট ইউনিয়নের গাঙ্গেরকোট গ্রামের রনজিত সাহার বাড়িতে নভেম্বরের প্রথম দিকে পাক
বাহিনী ক্যম্প স্থাপন করে। ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা এখানে অবস্থান করে। আত্মসমর্পনের
ব্যাপারটি নিশ্চিত হলে কুটি হয়ে কুমিল্লা সিলেট
রোডে দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধারা
তাদেরকে আক্রমন করে। তখন ২০/২৫ জনের প্লাটুনটির বেশ কয়েকজন মারা যায়। অন্যরা পালিয়ে
যেতে সক্ষম হয়। ৩১ অক্টোবর চাপিতলা ইউনিয়নের
চাপিতলা অজিফা খাতুন উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি অস্থায়ী
ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। মুরাদনগর সদরে পাক সেনাদের ক্যাম্প ছিল মুরাদনগর সরকারি
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
রাজাকার/ আলবদর/ আল
শামস
মুরাদনগরে রাজাকারদের
প্রকাশ্য তৎপরতা কম ছিল। তবে পর্দার আড়ালে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে পাক বাহিনীর
কাছে তথ্য দিত। ২৬ আগষ্ট ৭১ সাপ্তাহিক আমোদ পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়- অতিরিক্ত ডেপুটি
কমিশনার (রাজস্ব) ১৭ আগষ্ট রাজস্ব সংক্রান্ত ব্যাপারে সদর উত্তর মহকুমা হাকিমকে সঙ্গে
নিয়ে মুরাদনগরের বিভিন্ন স্থানে শান্তি কমিটির লোকদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। রাজাকারগন
তার সাথে সাক্ষাৎ করে সরকারকে পূর্ণ সহযোগীতার
আশ্বাস দেন। মুরাদনগরের উল্লেখযোগ্য রাজাকারদের মধ্যে আ: জব্বার (ইউসুফনগর)
মরহুম মাজেদুল ইসলাম ভূইয়া, মরহুম মর্তুজ আলী
ভূইয়া, মরহুম আব্দুল হালিম
(চাপিতলা) অন্যতম। মুক্তিযোদ্ধারা জানান, যুদ্ধের শুরুতেই উপজেলা পর্যায়ে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। তারা সার্বক্ষণিকভাবে
পাকিস্তান সরকারের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতো। পর্যায়ক্রমে তারা মুরাদনগরের প্রতিটি ইউনিয়নে
তাদের কমিটি গঠন করে। যুদ্ধের প্রথম দিকে পাকসেনারা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে কুমিল্লা
সিলেট রোডে মুরাদনগরের বিভিন্ন রাস্তায় টহল দিত। ক্রমেই তারা ঘন ঘন এলাকায় আসাতে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে যোগাযোগ করে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যপারে
তথ্য দেযা ছাড়াও তাদের সন্ধানে বের হতো । তাদেরকে না পেলে তাদের পরিবারের
উপর নির্যাতন চালাতো। কোম্পানীগঞ্জে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন ছাড়াও উপজেলার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ন
স্থানে সেনাবাহিনী মিলিশিয়া ক্যাম্প স্থাপন করে। তাদের সাহস ও সহযোগিতায় রাজাকাররা
যুদ্ধের উদ্দেশ্যে ট্রেনিং করতে যাওয়া তরুণদের পরিবারের লোকদের উপর নির্যাতন চালাতে
থাকে। ইউনিয়নগুলোতে রাজাকার কমান্ডাররা তাদের দলবলসহ বাড়িতে গিয়ে প্রথমে লুটপাট করতো।
তারপর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিত এবং গরু ছাগল নিয়ে আসতো। বিশেষ করে হিন্দু অধুষিত এলাকাগুলোতে
তারা আক্রমন চালায়। ফলে বেশিরভাগ হিন্দু জীবন বাঁচাতে কপর্দকহীনভাবে শরনার্থী হিসেবে
ভারতে গমন করে। প্রথম কয়েক মাসের মধ্যেই মূলত হিন্দু এলাকাগুলো ফাঁকা হয়ে যায়। বিশেষ
করে উচ্চ বংশীয় ধনী হিন্দু পরিবারগুলোতে হামলা চালায়। তাদের নিকট থেকে চাঁদা আদায় করে
এবং লুটপাট অব্যহত রাখে।
রেফারেন্সঃ ১. বংলাদেশের
মুক্তিযুদ্ধ ( দ্বিতীয় খন্ড)প্রকাশক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এরিয়া সদর দপ্তর কুমিল্লা
, ২০০৮সাল ২. একাত্তরের কন্যা জায়া-জননীরা মেজর কামরুল
হাসান ভূইয়া সেন্টার ফর বাংলাদেশ লিবারেশন স্টাডিজ, ফেব্রুয়ারি ২০১০, ঢাকা ৩. ৩৬ বছরেও মুরাদনগরে স্মৃতি সৌধ নির্মিত হয়নি- সাপ্তাহিক আমোদ কুমিল্লা, ১৩ ডিসেম্বর ২০০৭, ৪. টোকা ডায়েরীর পাতা থেকে , ড. জয়নাল আবেদিন ২০১৪,অ্যাডন পাবলিকেশন ৫. দি ভিশন অব ডিজিটাল বাংলাদেশ
২০০৮,ঢাকা ৬. আমার দেশ ২০০৭,বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ,এশিয়াটিক সোসাইটি,ঢাকা।
লেখকঃ মমিনুল ইসলাম
মোল্লা,মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, কলেজ শিক্ষক ও সাংবাদিক,কুমিল্লা 01711713257