মমিনুল ইসলাম মোল্লা।। নজরুল যেদিন দৌলতপুরে আসেন সেদিন তাকে স্থানীয়ভাবে উষ্ণ সংবর্ধনা দেয়া হয় । প্রশাসনিকভাবে নয় দৌলতপুরের খা বাড়ি, মুন্সিবাড়ি সহ আশেপাশের এলাকার স্থানীয় জনসাধারণ কবিকে বরণ করে নেয় । কবিকে থাকতে দেয়া হয় বৈঠকখানায়। আলী আকবর মেমোরিয়াল ট্রাস্টের বিল্ডিংটির পাশেই নজরুলের থাকার ঘর ছিল। ঘরটি ছিল বেশ বড়। ৪৫ হাত দৈর্ঘ্য এবং ১৫ হাত প্রস্থ বিশিষ্ট। তখনকার যুগে মেহমানের জন্য বাহির বাড়িতে আলাদা ঘর থাকতো । খাঁ বাড়িতে তেমনি একটি সুপ্রশস্থ ঘরে কবিকে থাকতে দেয়া হয়। যে ঘরে নজরুল থাকতেন তার পাশেই ছিল একটি বিরাট আম গাছ, বারোটি কামরাঙ্গা গাছ এবং আরো ছোটখাট বিভিন্ন ফলের গাছ যা জায়গাটিকে ফল বাগানে পরিণত করে । এছাড়া সাথে ছিল কামিনী ও কাঁঠাল গাছের সারি । নজরুল খান বাড়ির ছেলে মেয়েদের গান, নাচ ও বাদ্য শিখাতেন। বৈঠক ঘরের পাশে ছিল শান বাঁধানো ঘাট ।পুকুরটি মোটামুটি বড়ই ছিল । ওই সময়ে গ্রামের মেয়েরা এখান থেকে কলসি ভরে দলে দলে এসে পানি নিয়ে যেত । নজরুলের বাল্য সুলভ দুষ্টুমির কারণে তারা সকালবেলা পানি নেয়ার কাজটি সেরে নিতো ।
নজরুল একবার পানিতে নামলে আর উঠতে চাইতেন না। সমবয়সীদের নিয়ে তিনি লাই খেলতেন। এ খেলার নিয়ম অনুযায়ী পানির মধ্যে ডুব দিয়ে অথবা সাঁতার কেটে একজন অন্যজনকে ছুঁয়ে দিতে। ছুঁয়ে দেয়ার মধ্যেই জয়-পরাজয় নির্ভর করত।
আলী আকবর খানের বিধবা বড় বোন এখতারুন্নেসাকে কবি মা বলে ডাকতেন। তিনি নিঃসন্তান হিসাবে খান বাড়িতে বসবাস করতেন। কবি গরমের দিনে দুপুরে পানিতে নামলে অনেকক্ষণ পানিতে ভাসে থাকতেন। দক্ষিণ প্রান্ত থেকে সাবানের ফেনা ভাসিয়ে পকুরের উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত নিয়ে যেতেন। দুপুরে খাবারের সময় হলে খাবার হাতে নিয়ে ডাকতেন-আয় নুরু খেতে আয়। কবি তখন শান্ত ছেলের মতো পুকুর থেকে উঠে বাড়ির ভিতরে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করতেন।
কখনো কখনো ছেলেদের নিয়ে একসঙ্গে সাঁতার কাটতেন। কোনো কোনো সময় বুক সমান পানিতে দাঁড়িয়ে উদাত্ত কণ্ঠে গান গাইতেন । এছাড়া পুকুর পাড়ে অবস্থিত আম গাছের নিচে বসে বাঁশি বাজিয়ে সময় কাটাতেন।খাঁ বাড়ি থেকে একটু দূরে ছিল মুন্সিবাড়ি । সেখানকার জব্বার মুন্সির সাথে নেযাবত আলী খানের মেয়ে আম্বিয়া খানমের বিয়ে ঠিক হয় ১৯২১ সালের ৫ মে। সেখানে পরিচয় হয় এক বালিকার সাথে । তার নাম সৈয়দা খাতুন। নজরুলে নাম পাল্টে রাখলেন নার্গিস। নার্গিস হলো ইরান দেশের একটি ফুল। কবি সেই প্রিয় ফুলের নামে প্রেমিকার নাম রাখলেন নার্গিস। নার্গিসের পিতার নাম আব্দুল খালেক এবং মায়ের নাম আসমতের নেসা। তারপর থেকে নজরুল যখন আম গাছের নিচে শীতল পাটিতে বসে কবিতা গান লিখতেন তখন বিভিন্ন কাজের ছল- ছুতো করে নার্গিস সেখানে হাজির হতেন। এভাবে দুজনের সম্পর্ক আরও গভীর হয়।
নজরুলের জীবনের দৌলতপুর অধ্যায় ছিল একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কবি এখানে এসে গান লিখেছেন ১৬০টি ,কবিতা লিখেছেন ১২০ টি। উল্লেখযোগ্য কবিতা হচ্ছে বেদনা অভিমান, অবেলা , অনাদৃতা, পথিকপ্রিয়া ইত্যাদি। এছাড়া আরও রয়েছে বিধুরা, হার না মানা হার , হারামণি কবিতা।(দ্বিতীয় পর্ব শেষ )।
লেখক: মমিনুল ইসলাম মোল্লা, কবি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও সাংবাদিক , কুমিল্লা। ০১৭১১-৭১৩২৫৭