কুমিল্লার জাহাপুর জমিদার বাড়ির ধর্মীয় ঐতিহ্যঃ


কুমিল্লার জাহাপুর জমিদার বাড়ির ধর্মীয় ঐতিহ্যঃ
কুমিল্লার জাহাপুর জমিদার বাড়ির ধর্মীয় ঐতিহ্যঃ
কুমিল্লার জাহাপুর জমিদার বাড়ির ধর্মীয় ঐতিহ্যঃ
বিশ্ব শামিত্মর উদ্দেশ্যে ৪৮ প্রহরব্যাপী হরিনামকীর্তন চলছে কুমিল্লার মুরাদনগরের ঐতিহ্যবাহী জাহাপুর জমিদার বাড়িতে। এবছর ৪২ তম বার্ষিক মহোৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। শ্রী শ্রী তারকব্রহ্ম নামযজ্ঞ শিরোনামে জাহাপুর হরিসভার ব্যানারে ১৩৭৮ বাংলা থেকে এখানে প্রতি বছর ফাল্গুন মাসে দিনব্যাপী অনুষঠান হয়। অনুষ্ঠানসূচীতে থাকে-প্রতিদিন সন্ধা টায় শ্রী ভগবৎপাঠ, শ্রী শ্রী গীতা পরায়ন, শুভ অধিবাস কীর্তন, শ্রী শ্রী তারকব্রহ্ম নামযজ্ঞ, নগর কীর্তন,পরিক্রমা, জলকেলী, উৎসব সমাপনও মহাপ্রসাদ বিতরন। এতে বহু দূর-দূরান্তা থেকে হাজার-হাজার ভক্ত অংশগ্রহণ করেন। ধর্মীয় গ্রন্থে উলেস্নখ রয়েছে, নাম-সংকীর্তন প্রচারের সুবিধার জন্যই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। সন্ন্যাস গ্রহণের পর পুরীধামে অবস্থানকালে তিনি ছয় বছর দক্ষিণ ভারত আশেপাশে বিভিন্ন অঞ্চল পদব্রজে পরিভ্রমণ করেন। সে সময় তাঁর দর্শনে তাঁর শ্রীমুখ থেকে নাম-সংকীর্তন শ্রবণ করে কত পাপীতাপী, নাস্তিক, শূন্যবাদী, নিরীশ্বরবাদী প্রখ্যাত মায়াবাদীরা শুদ্ধ ভগবৎ-ভক্তি লাভ করে তাঁর কৃপাভাজন হযয়ে মহাভাগবতে পরিণত হন। তৎকালীন দুই মায়াবাদী সন্ন্যাসী-কাশীর প্রকাশানন্দ সরস্বতী জগন্নাথ পুরীর সার্বভৌম ভট্টাচার্য মহাপ্রভুর কাছে শাস্ত্রযুক্তিতে পরাসত্ম হয়ে তাঁর পাদপদ্মে আত্ম-সমর্পণ করেন। মহাপ্রভু সার্বভৌমের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে ষড়ভুজ রূপ দর্শন করান। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু দক্ষিণ ভারতের গোদাবরী নদীর তীরে তদানীন্তনকালে মাদ্রাজের রাজ্যপাল রায় রামানন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকেসাধ্যবর্ণন করতে বললে, তিনি বর্ণাশ্রম-ধর্ম, জ্ঞানমিশ্রা ভক্তি থেকে শুদ্ধ দাস, প্রেম এবং পরিশেষে কামত্মাভাবগত প্রেমকে সাধ্যসার বলে নিরূপণ করলেন। পরে মহাপ্রভুর ইচ্ছায় রামানন্দ রায় কৃষ্ণের স্বরূপ, রাধার স্বরূপ, রসতত্ত্ব প্রেমতত্ত্ব বর্ণনা করলেন। তখন মহাপ্রভু সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে রসরাজ শ্রীকৃষ্ণ মহাভাব রাধার রূপ দর্শন দান করলেন
পূর্ণিমাতে চন্দ্রগ্রহণ সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যে পূর্ণিমা তিথিটিকে অবলম্বন করে শ্রীধাম মায়াপুরে অবতরণ করেছিলেন সেই দিনটি ছিল চন্দ্রগ্রহণ। এই চন্দ্রগ্রহণটি প্রকৃতির নিয়মের অধীনে হয়নি, ভগবানের বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এবং ভগবানের ইচ্ছায় এই চন্দ্রগ্রহণটি হযয়েছিল। চন্দ্রগ্রহণের পর লক্ষ লক্ষ নবদ্বীপবাসী মায়াপুর-নবদ্বীপ গঙ্গার ঘাটেহরি’ ‘হরিধ্বনি সহকারে গঙ্গায় স্নান করেছিলেন। সব রকম লোকের মুখে হরিনাম কীর্তন হচ্ছিল। যার মুখে কোনওদিন হরিনাম শোনা যায়নি সেও হরিনাম করছিল। এভাবেই সংকীর্তনমুখে মহাপ্রভু আবির্ভূত হয়েছিলেন কলিযুগের যুগধর্ম নাম-সংকীর্তন প্রচার করবার জন্য। জাহাপুর হরিসভা বিশ্বাস করে‘‘ যিনি আত্মাতেই সুখ অনুভব করেন, যিনি আত্মাতেই ক্রীড়াযুক্ত এবং আত্মজ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত, তিনিই যোগী এবং তিনিই ব্রহ্ম নির্বান লাভ করেন। ’’এখানে প্রায় প্রতি বছর নাম সুধা পরিবেশনে অংশ গ্রহণ করে বাব লোকনাত সম্রদায়, শ্রীকৃষণ সম্প্রদায়, শ্রী শ্রী নব বিমল কৃষণ সম্রদায়, শ্রী নব দিগন্ত সম্রদায়, নব শ্যী গুরু সম্প্রদায় , ঠাকুর সম্রদায়।হরিসভা যাদের বিশেষভাবে স্মরণ করে তাদের মধ্যে -চন্দ্র কুমার রায়, জোতিষ চন্দ্র রায়, নবদ্বীপ চন্দ্র দাস,অবিনাশ চন্দ্র নাথ, হরিমোহন ঘোষ, নবীন চন্দ্র দেবনাথ, ডাঃ মনিনদ্র চন্দ্র রায়, হরিপদ সাহা, মাখন চন্দ্র, রনবীর রায় চৌধুরী প্রমুখ। তারা আরো বিশ্বাস করেন-সত্যযুগে ধ্যান করে যে ফল লাভ করা যায় ত্রেতাযুগে যজ্ঞ সম্পাদন করে যে ফল লাভ করা যায়, দ্বাপর যুগে অর্চন করে যে ফল লাভ করা যায়- সেই একই ফল লাভ করা যায় কলিযুগে শুধুমাত্র কৃষ্ণনাম কীর্তন করে।‘‘কলিযুগে একমাত্র ধর্ম হচ্ছে হরিনাম কীর্তন করা, হরিনাম কীর্তন করা, হরিনাম কীর্তন করা। ছাড়া অন্য কোনও পন্থা নেই, অন্য কোন পন্থা নেই, অন্য কোনও পন্থা নেই।’’ ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, মন্মনা ভব- ‘আমাকে স্মরণ কর’, মামেকং শরণং ব্রজ- ‘একমাত্র আমার শরণাগত হও।’’

কীর্তন উপলক্ষে আসা লোকজন প্রয়াত জমিদারদের সমাধিস্থল পরিদর্শন করেন। বাড়ির বাইরের অংশে সমাধিস্থলটি অবস্থিত। এখানেই প্রতাপশালী জনদরদি জমিদারগণ ঘুমিয়ে রয়েছেন।এখানে একটি চিতাও রয়েছে। চিতার পাশেই কমলাকামেত্মর সমাধি। বিশিষ্ট জমিদার চন্দ্র কুমার রায়, (১৯৭৩) অশ্বিনী কুমার রায় (১৯৭৫) মুত্যু বরণ করলে এখানে তাদেও দাহ করা হয়। কীর্তনে আসা রহিমপুরের শ্রী  নারায়ন চন্দ্র বলেন-‘‘হরিনাম কীর্তন করলে এক দিব্য আনন্দের আস্বাদন লাভ করা যায়, তাতে আত্মা প্রসন্ন হয় এটি বাস্তব প্রমাণ , কোন অন্ধবিশ্বাস নয় যিনি হরিনাম করবেন, তিনিই তা উপলব্ধি করতে পারবেন দিব্য আনন্দ লাভ করার জন্য কোনও কিছুর প্রয়োজন হয় না, শুধু প্রয়োজন বিশ্বাসের সঙ্গে হরিনাম কীর্তন করা ’’ এলাহাবদের হারাধন গোস্বামী বলেন-হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে /হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ।।
আত্মা প্রসন্ন না হলে, তথাকথিত ইন্দ্রিয়লব্ধ সুখের দ্বারা জগতের কোনও মানুষ প্রকৃত শামিত্ম লাভ করতে পারে না সে সম্বন্ধে ভাগবতে বলেছে
বৈ পুংসাং পরো ধর্মো যতো ভক্তিরধোক্ষজে অহৈতুক্যপ্রতিহতা যয়াত্মা সুপ্রসীদতি ।। (ভাগবত //)
অনসন্ধানে জানা যায় জহাপুরের জমিদারগণ সকলেই ধর্মভীরু ছিলেন। তাদের মধ্যে শ্রী অনিল কুমার রায়ের সুযোগ্য পুত্র স্বর্গীয় রণবীর রায় চৌধুরি জাহাপুরকে বিশাল ধর্মীয় তীর্থক্ষেত্রে পরিণত করেছেন। আধুনিক কারুকার্যে স্থাপিত জগন্নাথ দেবের মন্দিরে যথারিতি ধর্মীয় উৎসব চলছে। প্রতিদিন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে মুখরিত হয় মন্দির প্রাঙ্গন। মন্দিরের আভ্যন্তরে প্রায় হাজার লোক বসতে পারে। সামনে রয়েছে বিশাল পুকুর। প্রায় একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত জমিদার বাড়িটটি এখনও তাদেও অতীত ঐতিগহ্য বজায় রেখেছে্
জমিদারদের ১২ তম বংশধর প্রফেসর অঞ্জন কুমার রায় বলেন-অনধিক পঞ্চ শতাব্দিকাল পূর্বে শ্রী শ্রী গৌরাঙ্গ মহাপ্রভূ ধরাধমে অবতীর্ণ হইয়া ধ্বংসমূখী মানব সমাজের ঘরে ঘরে যে মহানাম বিলআইয়া জগৎকে পেৎমর বন্যায় আপস্নুত করতঃ জীবমুক্তির পথের সন্ধান দান করিয়াছেন সমাজের এই ঘোর দুর্দিনে জগতের মহাকল্যান কামনায় প্রতি বছর ৬দিনব্যাপি ধমীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া এখানে রথযাত্রা, দুর্গাপূজাসহ অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো আন্তরিকতার সাথে উদযাপিত হয়
লেখক: মমিনুল ইসলাম মোল্লা,প্রভাষক, ক্যাম্পেনার সিডিএলজি এবং সহকারী সম্পাদক , (দৃষ্টান্ত ডট কম), কুমিল্লা,প্রকাশঃ15/02/2015






শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.