মহিলাদের সেলাই কাজে বিপ্লব ঘটিয়েছেন আমিরুন নেছা

বিভাগ-নারী
মমিনুল ইসলাম মোল্লা
৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়েই বিয়ে হয়ে যায় কুমিল্লার দেবিদ্বারের আমিরুনের ।অল্প কিছুকাল পরেই জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে ব্যবসা শেষে বাড়ি যাওয়ার পথে ঘাতকের হাতে নিহত হয় স্বামী ময়নাল হোসেন। ঋণগ্রস্ত স্বামীর ঋণ পরিশোধ, সন্তানদের ভরন-পোষন, লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করার কী উপায়? ভেবে বার বার মুর্ছা যেতে লাগলেন আমিরুন। প্রতিবেশী মহিলারা পরামর্শ দিল বাবার বাড়ি শাকতলায় (একই উপজেলায়) গিয়ে আশ্রয় নিতে। কারও পরামর্শই তার মনঃপুত হলো না। তিনি মনে মনে শপথ নিলেন শ্বশুর বাড়িতে (ইকরানগরী, দেবিদ্ধার) থেকেই নতুন জীবন শুরু করবেন। স্বামীর রেখে যাওয়া সেলাই মেশিনের চাকা ঘুড়িয়েই ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে চেষ্টা করলেন। ছোট ছোট বাচ্চাদের প্যান্ট-শার্ট বানিয়ে বাড়ি-বাড়ি ঘুরে বিক্রি করলেন। তারপর স্থায়ী দোকান নিলেন, প্রশিক্ষক হিসেবে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছেন। এপর্যন্ত বিভিন্ন উপজেলার ৫/৬শ মহিলা তার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
আমিরুনের ভাগ্য পরিবর্তনে উপজেল সমাজসেবা অফিসের অবদান রয়েছে। জীবিকার তাগিদে যখন বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাপড় বিক্রি করতেন তখন বর্ষাকালে বিশেষ সমস্যা হতো। তখন বিক্রি কম হওয়ায় ছেলে মেেয় নিয়ে মাঝে মাঝে উপবাস থাকতে হতো। এমনই দুঃসময়ে পরিচয় হয় সমাজকল্যাণ অফিসের ( দেবিদ্ধার) ফরিদা ও রওশন আরা আপার সাথে। তারা তাকে সাপ্তাহিক ৫ টাকার সমিতিতে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন এছাড়া আমিরুনের বাচ্চাদের কুমিল্লা ও চাঁদপুরের বিভিন্ন এতিমখানায় ভর্তি করে দেন। এসয় সমাজসেবা অফিস থেকে ১২ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তিনি ৩০ শতক জমি বন্ধক রাখেন। ১৯৯৮ সালে তিনি দেবিদ্ধার সদরের কলেজ রোডে (রাস্তার পাশে) এক শতক জমি কিনেন ১লাখ ৪০ হাজার টাকা দিয়ে। ২০০১ সালে ৫ তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে দোতলার কাজ শেষ করেন। দোকানে কাপড় উঠানোর জন্য তিনি বেসরকারি সাহায্য সংস্থা ব্রাক থেকে প্রথমে ২০ হাজার টাকা ঋণ নেন, সঠিক সময়ে ঋণের কিস্তি শোধ করায় সংস্থার সদস্যগণ তার প্রতি সন্তুষ্ট হন। পরবর্তীতে আমিরুনকে ৫০ হাজার ও পরে ১ লাখ টাকা ঋণ দেন। আমিরুন কোন সময় কিস্তির খেলাপ করেন না। ফলে ঋণদানকারী সংস্থাগুলো সহজ শর্তে তাকে ঋণ প্রদান করে। এছাড়া সমাজসেবা অফিস তাকে একটা সেলই মেশিন দেয়। স্বামী থেকে প্রাপ্ত সেলাই মেশিনটির সাথে সাথে এটি দিয়ে তিনি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। জামা-কাপড় বানানোর পাশাপাশি প্রতিদিন কিছু কিছু মহিলাকে প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। আমিরুন বলেন-আমি মাত্র ৩০০ টাকায় প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করি। এখন প্রতি ব্যাচে ৪জন করে প্রতিদিন ৩টি ব্যাচ শেষ করি, তারা আমাকে ৩ মাসে ২হাজার টাকা দেয়। দোকানের অর্ডারি কাজ ও প্রশিক্ষণ কাজে সবসময় তাকে সহযোগীতা করে তার পুত্রবধু শিল্পী আক্তার। এছাড়া আরো সহযোগীতা করে আকলিমা আক্তার ও সাহেনা বেগম। প্রশিক্ষণরত ছাত্রী শিরিনা ও সোহেলী জানায়-আপা প্রথমে আমাদেরকে কাগজে ড্রয়িং শেখান, তারপর পত্রিকা বা পুরাতন কাপড়ে কাটা শেখান তারপর সেগুলো সেলাই করতে দেন ,কাগজে সঠিকভাবে সেলাই করতে পারলে তারপর তাকে মেশিনে বসে কাপড় সেলাই করতে দেয়া হয়। সালোয়ার , কামিজ বানাতে আসা দেবিদ্বার মহিলা কলেজের ছাত্রী রেশমা ও যুথী জানায়, দোকানে পুরুষ টেইলারের কাছে কাপড় বানাতে গেলে মাপ নেয়ার সময় বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। এছাড়া আমাদের ইচ্ছেমত বানিয়ে দেয় না। চাচি আমাদের মনের মতো করে জামা-কাপড় বানিয়ে দেয়। এছাড়া শুনেছি উনি নাকি দেবিদ্ধারের প্রথম মহিলা টেইলার। ওনার কাজের দক্ষতাও ভালো। আমিরুন্নেছার নেতৃত্তে সেলাই কাজে মহিলাদের একটি নিরব বিপ্লব চলছে,  এখন দেবিদ্ধারের প্রতিটি গ্রামে গ্রামে মহিলা দর্জি বিরাজ করছে। সূত্র জানায়, গুনাইঘরে ৫০ জন, ছোট আলমপুরে-২০জন, হোসেনপুরে-১০জন, খলিলপুরে-১০ জন, বনকুটে-১০ জন, এলাহাবাদে-৫ জন, জাফরগঞ্জে-৫ জন এবং নুরপুরে -৫ জন মহিলা দর্জি কাজ করছে। এসব দর্জির মধ্যে রয়েছে স্কুল-কলেজের ছাত্রী, গৃহীনী, চাকুরিজীবি ও গৃহবধু।  এসব টেইলারের অধিকাংশই আমিরুন্নেছার নিকট অথবা তার ছাত্রীদের নিকট থেকে শিখেছে।
তিনি শুধু নিজের দোকানে বসেই প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন না। সমাজসেবা অফিসের উদ্দ্যোগে আয়োজিত বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে এবং বিভিন্ন এনজিওর সেলাই প্রশিক্ষণ কোর্সে তিনি সিনিয়র প্রশিক্ষক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া ২০০৯ সালে ইউনিসেফের সহযোগিতায় চান্দিনার একটি গুচ্ছ গ্রামে আয়োজিত প্রাশক্ষণ কার্যক্রমে তিনি ২ মাস সেলাই কাজের প্রশিক্ষণ দেন। প্রশিক্ষণের সাথে জড়িত কোন স্মৃতি আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন-কয়েকবছর আগে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের আমন্ত্রণে উপজেলা অফিসার্স ক্লাবে অফিসারদের স্ত্রীদের প্রশিক্ষণ দেন । প্রশিক্ষণের শেষ দিনে সবাই তাকে উপহার দিয়ে সম্মানিত করেন।
আমিরুন্নেসার স্বামী মারা যাওয়ার সময় সবগুলো ছেলে-মেয়েই ছোট ছোট ছিল। বর্তমানে বড় ছেলে অনার্স পাস করে সৌদি আরবে কর্মরত আছে, ছোট ছেলে মোবারক হোসেন খান সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের ৩য় বর্ষের ছাত্র। শুধুমাত্র সেলাই মেশিনের আয় দিয়েই ছেলেদের লেখাপড়া করানোর পাশাপাশি ৪ মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। মেয়েরাও সবাই শিক্ষিতা (আই এ/বিএ পাস)। সবগুলো মেয়ে ই সেলাই কাজে পারদর্শী। সবাই তাদের স্বামীর বাড়িতে সেলাই কাজ করে বাড়তি টাকা আয় করছে। তার নিকট সেলাই কাজ শিখে বর্তমানে ছোট আলমপুরের বিউটি, ফতেহাবাদের শিউলি, ওয়াহেদপুরের মনোয়ারা, চৌদ্দগ্রামের রুমা, দুয়ারিয়ার শাহিদা, গুনাাইঘরের আয়েশা, ইকরানগরীর মায়মুনা নিজ নিজ গ্রামে অথবা শ্বশুর বাড়িতে স্বাবলম্বী হয়েছে বলে জানা গেছে। এব্যবসায় আপনার মাসিক ইনকাম কত? জিজ্ঞেস করতেই ৪৫ বছর বয়স্ক আমিরুন নেছা ঘোমটা টেনে বলেন-আয় বেশি নয় ছেলের মেডিকেল পড়ার খরচ, সংসার চালানোর খরচ বাদে প্রতি মাসে গ্রামীণ ব্যাংক, ব্রাক,ও সিসডিএ এর ৫০ হাজার টাকা কিস্তি শোধ করার পর সামান্য কিছু ব্যাংকে জমা থাকে। তিনি মনে করেন, যে কোন মহিলা সেলাই মেশিনের কাজ শিখে স্বাবলম্বী হতে পারে। এতে আর্থিক স্বচ্ছলতার পাশাপাশি সংসারে নারীদের মর্যাদাও বাড়ে।
লেখকঃ মমিনুল ইসলাম মোল্লা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের  প্রভাষক ও সাংবাদিক, কুমিল্লা। বিভাগ - নারী
প্রকাশের সময়-01/02/2013


শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.