গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে হবে---------- মমিনুল ইসলাম মোল্লা

গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে হবে
মমিনুল ইসলাম মোল্লা

গার্মেন্টস কর্মীদের বেতন-ভাতা ও কারখানার কর্মপরিবেশ নিয়ে পোশাক রপ্তানি কারক দেশগুলোতে ব্যাপক সমালোচনার প্রেক্ষাপটে সরকার মজুরি বোর্ড গঠন করেছে। বস্ত্রমন্ত্রী আঃ লতিফ সিদ্দিকী  বলেন, এই মজুরি বোর্ড ১ মে থেকে কার্যকর বলে ধরা হবে।  বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন যে কোন দেশের তুলনায় খুবই কম। তারা দিন-রাত হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর ভালভাবে ৩ বেলা খেতে পারে না। অতিরিক্ত সময়ের কাজকে তারা
“ওভারটাইম  ” বলে। ওভরটাইমের পয়সাও তাদেরকে নিয়মানুযায়ী দেয়া হয় না। ফলে শ্রমিকরা  রাস্তায় আন্দোলন করে। সম্প্রতি “ আল হামরা ”  এবং  “ আমাজান ” নামের দুটি গার্মেন্টস এর কর্মীরা রাজপথে আন্দোলন করে। বেতন না দেয়ার অজুহাত হিসেবে মালিক পক্ষ  বলেন- বিশ্ব বাজার মন্দা, অর্থনৈতিক মন্দা, রাজনেতিক অস্থিতিশীলতা ইত্যাদি,ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে ১ মাসের টাকা হাতে রাখতে পারলে  তা  খাটিয়ে অধিক লাভ করা যায়।  
গার্মেন্টস শিল্পের শুরুতে শ্রমিকদের মজুরি ছিল ২৫০/৩০০ টাকা। তিন দশক পর বহু আন্দোলনের পর বর্তমানে একজন শ্রমিক বেতন পাচ্ছেন ৩০০০টাকা। ২০০৬ সালে নূন্যতম মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা হয়। তবে এ কাঠামো অনুযায়ী মাত্র ২০ % শ্রমিক ন্যায্য মজুরি পায়। তারা ৯৩০ টাকার পরিবর্তে পেয়েছেন ১৬৬২ টাকা। গার্মেন্টস শ্রমিকদেরকে মালিকেরা গৃহপালিত পশু কিংবা ভৃত্যেও মতো মনে করে। তারা তাদেরকে শুধুমাত্র বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। তাদেও জীবনে আরাম-আয়েশের কোন প্রয়োজন নেই। মালিকদেও স্বার্থে তারা খাবে , শক্তি অর্জণ করবে এবং কারখানায় কাজ করবে। একজন মালিক প্রতি মাসে এস্ট্রেতে যে পরিমাণ টাকা টাকা গুঁজে দেন সে পরিমাণ টাকা শ্রমিকদের দিতেই তারা বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নেন। শ্রমিকরা এ কটি টাকা দিয়েই চলতে হয়। তারা এখান থেকেই বাড়িতে বৃদ্ধ দরিদ্র বাবা মাকে টাকা পাঠায়। ঢাকায় ঘর ভাড়া দেয়, নিজের জামা কাপড় কেনে এবং খাবার কিনে খায়। এ টাকা পেতে দেরি হলে তাকে বাসা থেকে বের করে দেয়া হয়, না খেয়ে থাকতে হয়, এমনকি পিতা-মাতাকেও না খেয়ে থাকতে হয়।
সেন্টার ফর আমেরিকান প্রগ্রেস এর গবেষণায় দেখা যায় তৈরি পোশাক রপ্তানীতে শীর্ষ চারটি দেশের যথাক্রমে চীন, ভিয়েতনাম, ও ইন্দোনেশিয়ায় গার্মেন্টস শ্রমিকরা তাদের জীবিকার ৬, ২২, ও ২৯ শতাংশ মেটাতে পারে তাদের আয় দ্বারা।  অন্যদিকে বাংলাদেশের শ্রমিকেরা ১৪ শতাংশ চাহিদা মেটাতেই হাবুডুবু খায় । ফলে প্রতিটি শ্রমিক ওভারটাইম করে। শ্র্রমিকরা মানবেতর জীবন যাপন করছে। বস্তিতে একটি ছোট রুম এর ভাড়া ৩ হাজার টাকা, ৬/৭ টা পরিবার মিলে একটি বাথরুম ব্যবহার করে। ১/২টি টয়লেট থাকে যা সবসময়  অপরিচ্ছন্ন থাকে। রাত ৯/১০ টায় ঘরে ফিরে এসে রান্না-বান্না করে শুতে শুতে রাত ১২ টা বেজে যায়। আবার সকাল ৮টায় কারখানায় পৌঁছতে হয়। ১ মিনিট লেট হলেই হাজিরা বোনাস কেটে নেয়া হয়। তাই ৫ টায় উঠে গোসল ও বাথরুম ও রান্নার জন্য লাইন ধরতে হয় । এভাবে খেয়ে না খেয়ে তারা কোনরকমে বেঁচে আছেন। শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে বেতন বাড়ানোর বিকল্প নেই। 
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের শতকারা ৭৫ ভাগ অসে গার্মেন্টস শিল্প থেকে। অন্য  যে কোন দেশের চেয়ে বাংলাদেশের শ্রমিকদের বেতন কম ।  প্রতিবেশী দেশ ভারতের মজুরি প্রতি ঘন্টায় ৫৫ থেকে ৫৮ সেন্ট, অর্থাৎ ৩৯ টাকা থেকে ৪৮ টাকা। অন্যদিকে বাংলাদেশের শ্রমিকের মজুরি মাত্র ১৪ টাকা ৪২ পয়সা। শ্রম মন্ত্রনালয়ের সচিব মিকাইল শিফার বলেন, গার্মেন্টস শিল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ( আইএলও ) প্রস্তাবিত ২০০ কলকারখানায় পরিদর্শক নিয়োগ দেয়া হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৮০টি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান সমন্বিতভাবে দেশের পোশাক শিল্পের উন্নয়নে কাজ করে। প্রতি মাসের ১০ তারিখের মধ্যে বেতন-বাতা পরিশোধ না করলে শ্রম আইনে গার্মেন্টস মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে শ্রম বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের সচিব হুশিয়ারী উচ্চারণ করেন। এছাড়া পাশাপাশি দুটি কোম্পানীতে ওভারটাইম বা লাঞ্চভাতায় অনিয়ম দেখা যায়। কেউ দিচ্ছে ১৫ টাকা আবার কেউ দিচ্ছে ২৫ টাকা। এগুলো যাতে না করা হয় সেদিকে সরকার সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। 
বিজিএমই এর হিসেবে দেশে গার্মেন্টস এর সংখ্যা ৫ হাজার ৬ শ,  তাতে শ্রমিক প্রায় ৪০ লক্ষ । তাদের শতকরা ৮০ ভাগই হচ্ছে নারী শ্রমিক।কেউ কেউ বলেন,  লাভের জন্যই গার্মেন্টস মালিকেরা ব্যবসা করেন, কোটি কোটি টাকা ইনভেস্ট করেন। তাই বলে  শ্রমিকদেও রক্ত চুষে নেয়া সমর্থনযোগ্য  হতে পারে না। আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের গার্মেন্টস মালিকদের মুনাফার হার ৪৩.১০ শতাংশ, কম্বোডিয়ার ৩১ শতাংশ ভারতে ১১.৮ শতাংশ , ইন্দোনেশিয়ায় ১০ শতাংশ, ভিয়েতনামে ৬.৫ শতাংশ, নেপালে ৪.৪ শতাংশ এবং চীনে ৩.২ শতাংশ। শ্রমিকরা বহু সমস্যার মধ্যে কাজ করেন। তাদেরকে সাপ্তাহিক ছুটি দেয়া হয় না, মেডিকেল ছুটি দেয়া হয় না, একদিন অনুপস্থিত থাকলেও বেতন কেটে নেয়া হয়, স্থায়ী ভাবে  নিয়েগ পত্র দিতে গড়িমসি করা হয়, কোন অনিয়মের প্রতিবাদ করলে ছাটাই করা হয়। ফলে পুরনো শ্রমিকদের ঈদ বোনাসসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বাদ যায়, রাত ৮/১০ টা পর্যন্ত কাজ করলেও হাজিরা খাতায় তোলা হয় সন্ধ্যা ৭ টা পর্যন্ত। এছাড়া ছাটাইয়ের সময় বেতন ভাতা পরিশোধ করা হয় না। মাতৃত্বকালীন ছুটি দেয়া হয় না, সন্তান লালন পালনের জন্য ডে কেয়আর সেন্টার নেই, ওভারটাইম মজুরিী দ্বিগুণ করার আইন থাকলেও তা বাস্তবে লক্ষ করা যায় না। মালিকদের ব্যবস্থাপনায থাকায় বেতন বাড়ালে তারা শ্রমিকদের ঘর ভাড়াও বাড়িয়ে দেয়।
বেতন বাড়ানোর পর ২০১০ সালের মতো মালিক পক্ষ যাতে কৌশল বা প্রতারণা না করে সেজন্য শ্রমিকরা দাবী জানান।  সে সময় মজুরি বাড়ানো হলেও প্রকৃত মজুরি কমেছিল। কারো প্রমোশনের পরিবর্তে যাতে ডিমোশন না হয়  যাতে ডিমোশন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।  ২০১০ সালে বেতন নির্ধারণের পর দেখা যায় আগে যিনি ছিলেন সেলাই মেশিন অপারেটর  (গ্রেড ৪) তাকে করা হলো জুনিয়র সেলাই মেশিন অপারেটর  ( গ্রেড-৫ ) কিংবা সহকারী সেলাই মেশিন অপারেটর ( গ্রেড-৬ ) এর ফলে যার বেতন আগে যা ছিল তা থেকে কোথাও কমেছে , আবার কোথাওবা সামান্য বেড়েছে। এবার এ বিষয়টি অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।২০১০ সালে নতুন মজুরি কাঠমো ও পর সরকার দফায় দফায় গ্যাস, বিদ্যুৎ , ও জ্বালানী তেলের মূল্য বৃদ্ধি পওিয়ায় বাড়ি ভাড়া, পরিবহন, ভাড়া, গত আড়াই বছওে দ্বিগুণ হয়েছে। তাই শ্রমিকদের মজুরি সে অনুপাতে বাড়াতে হবে। মালিকপক্ষ মাত্র ৬ শ টাকা বাড়াতে চাচ্ছে যা শ্রমিরা মেনে নিতে নারাজ। তবে তাদের দাবী মোতাবেক ৭/৮ হাজার টাকা করাও হয়তো এই মুহুর্তে সম্বব নয় । বেতন বাড়ানোর ক্ষেত্রে একবারে বাড়ানো সম্ভব না হলে ৫ বছর মেয়াদি একটি বৃদ্ধি পরিকল্পনা নেয়া যেতে পারে। ৬ মাস পর পর তা কার্যকর করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে দ্রব্য সামগ্রী বৃদ্ধির ব্যপারটি খেয়াল রাখতে হবে। এভাবে মেয়াদশেষে তাদেও বেতন ৭/৮ হাজার টাকা করা যেতে পারে। চাকুরি শেষে অবসরবাতা হিসেবে কিছু টাকা দেয়া যেতে পারে। প্রফিডেন্ট ফান্ডের কথাও চিন্তা করা যেতে পারে। বেতনের পাশপাশি শ্রমিকদো সুষ্টু আবাসনের কথাও চিন্তা করা যেতে পারে।  নতুন করে বেতন নির্ধারনের পর বেতন প্রদানে মালিকরা যাতে কোন প্রকার কৌশল বা প্রতারণার আশ্রয় নিতে না পারেন সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। 
লেখকঃ মমিনুল ইসলাম মোল্লা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের  প্রভাষক ও সাংবাদিক,আর্কেইভ থেকে 23/09/2013

শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.