কুটির শিল্পের প্রতি দৃষ্টি দেয় প্রয়োজন

কুটির শিল্পের প্রতি দৃষ্টি দেয় প্রয়োজন

মমিনুল ইসলাম মোল্লা

এক সময় গ্রাম বাংলার প্রায় প্রতিটি ঘরই কুটির শিল্পে পরিনত হয়েছিল। বাঁশ, বেত, মুর্তা, পাট, কাপড়, তালপাতা, নারকেল পাতা, ও সুতার মাধ্যমে নানা রকমের জিনিস তৈরি হতো।  ১০ জন শ্রমিক রয়েছে এমন প্রতিষ্ঠান কুটির শিল্পের অন্তর্গত। জমি ও ঘর বাদ দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের পুঁজি ৫ লাখ টাকার উর্দ্ধে নয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে , আজ থেকে ৫ হাজার বছর আগে হস্ত শিল্পের বিকাশ শুরু হয়। তবে বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশে এর বয়স কম করে হলেও ৩ হাজার বছর।
বিশেষ করে স¤্রাট অশোকের সময় বৌদ্ধমূর্তির ৮৪ হাজার স্টুপাস বানানোর প্রমাণ পাওয়া যায়। সে সময় হস্ত শিল্পের স্বর্ণযুগ ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কুটির শিল্প জরিপ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতি বছর মোট দেশজ উৎপাদন ( জিডিপি) কুটির শিল্পের অবদান ৩১‘হাজার ৫ শ কোটি টাকা। দেশে কুটির শিল্পের সংখ্যা ৮ লাখ ৩০ হাজার ৩০৬টি। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান রয়েছে ২৯ লাখ ৫৩ হাজার মানুষের। শহরের তুলনায় পল্লী এলাকায় কুিটর শিল্পের সংখ্যা বেশি। এক তথ্যে দেখা যায়, ৯৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠান একক মালিকানাধীন আর বাকী ৩ শতাংশ যৌথ মালিকানাধীন। যে কোন প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষা ও জ্ঞানের প্রয়োজন। দক্ষ পরিচালক থাকলে আমাদের কুটির শিল্প আরো এগিয়ে যেতে পারতো। বংলাদেশের কুটির শিল্প পরিচালনাকারীদের মধ্যে ৮৩ % মালিকের শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি , ২% ¯œাতক ও ¯œাতোকোত্তর। এছাড়া ১৫% মালিক রয়েছেন যারা এসএসসি বা এইচএসসি পাশ। দেশের উচ্চ শিক্ষিত তরুণরা যদি এ শিল্পে এগিয়ে আসে তাহলে এ শিল্পের অনেক উন্নতি হতো। ভোক্তাদের চাহিদা পূরণ ও যান্ত্রিক শিল্পজাত দ্রব্যের সাথে প্রতিযোগীতা করে টিকে থাকতে হলে প্রশিক্ষণের কোন বিকল্প নেই। বেসরকারিভাবে এ খাতে প্রশিক্ষণের তেমন কোন ভাল সুযোগ নেই। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিসিক এক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এধরণের প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রশিক্ষণার্থীরা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সুনামের সাথে কাজ করছে। বিসিকের নকশা কেন্দ্রে মোট ১২টি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বিষয়গুলো হলো মৃৎশিল্প, বাটিক প্রিন্ট, পাটজাত শিল্প, বøক প্রিন্ট, চামড়াজাত শিল্প, স্কিনপ্রিন্ট, বাঁশ, বেত, কাপড়ের পুতুল, বুনন, প্যাকেজিং, কাঠেরবøক, এবং ফ্যাশন ডিজাইনিং। এখানে সামান্য অর্থের বিনিময়ে যুবকরা প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করতে পারে। এক কর্মশালায় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান শ্যামসুন্দর সিকদার বলেন- শিল্পনীতির সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার বেনারসি, জামদানী ও নকশি কাথার মতো ঐতিহ্যবাহী  কুটির শিল্পগুলো রক্ষা করতে পারে। 

কুটির শিল্পগুলোর মধ্যে একই ধরণের পণ্য উৎপাদনের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। বিবিএস এর আইএসবি প্রকল্পের পরিচালক কবির উদ্দিন আহম্মদ জানান, শিল্পনীতি ২০১০ এর আলোকে ২০১১ সালে সারা দেশে মোট ১ হাজার ১৭১ টি পিএসইউতে দশ এর কম জনবল বিশিষ্ট কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠানে জরিপ চালিয়ে দেখা যায় ১৫১টি পিএসইউতে একই টাইপের অর্থাৎ একই ধরণের পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেব অনুযায়ী ঢাকা বিভাগে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে আড়াই লাখ, সিলেট বিভাগে ২৮ হাজার, বরিশালে ৫২ হাজার, চট্টগ্রামে ১ লাখ ১৬ হাজার, রাজশাহীতে ১ লাখ ৩০ হাজার ও রংপুরে রয়েছে মাত্র ৩০ হাজার প্রতিষ্ঠান। বিসিকের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ  নিয়ে যে কোন যুবক স্বাবলম্বী হতে পারে। ক্ষুদ্রও কুটির  শিল্প প্রতিষ্ঠায় যে সকল নিয়ম/পদক্ষেপ অনুসরণ করতে হয় সেগুলো হচ্ছেঃ ১. বাংলাদেশে এ শিল্পে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ১০ কোটি টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। ২. শ্রমিক সংখ্যা অনধিক ৫০ জনে রাখতে হবে। ৩. ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হবে। ৪. জনস্বাস্থ্য ও বিদ্যুৎ সরবরাহ কর্তৃপক্ষ থেকে আলাদা আলাদাভাবে ছাড়পত্র সংগ্রহ করতে হবে। ৫. বিসিক শিল্প এলাকায় জমি পাওয়ার জন্য ৫০ টাকা মাসুল প্রদানে আবেদনপত্র সংগ্রহ করতে হবে। 
বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় শিল্পের মধ্যে রয়েছে সিরাজগঞ্জের হাতে তৈরি কাগজ। সিরাজগঞ্জ শহরের ৩ কিলোমিটার দূরে কালিয়াকন্দাপাড়ায়। আলী এরশাদ এ কাগজ কারখানার মালিক। এ কাগজ বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। নীলফামারীর সৈয়দপুরে তৈরি হচ্ছে উন্নতমানের প্রেসার কুকার, ওভেন, ও ফ্রাইপ্যান। ২০০৯ সাল থেকে এখানে উন্নতমানের পেসার কুকার তৈরি হচ্ছে। ভারত, মিয়ানমার ও ভুটানে এগুলো রফতানি হয়। আমেরিকা, ইতালি, জার্মান, ফ্রান্স, ও জাপান থেকে ক্রেতা আসেন মুন্সীগঞ্জের পাতক্ষীর নেয়ার জন্য । প্রতিটি ক্ষিরের ওজন প্রায় আধা কেজি। প্রতিটির কেজির দাম  ১০০ থেকে ১২০ টাকা। এ ক্ষির কলা পাতায় জড়িয়ে থাকে বলে এটি পাতক্ষির নামে পরিচিত। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ শিল্প আরো বিকশিত হবে। যশোরের জামতলার রসগোল্লা দেশে নয় বিদেশেও জনপ্রিয়। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে এর পরিসর আরো বাড়তে পারে। যশোরের শার্শা উপজেলার  রসগোল্লা ৫৫ বছর ধরে তার শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছে। এটি যশোর থেকে ৩৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ১৯৫৫ সালে শেখ সাদেক আলী প্রথম শুরু করেন। প্রতিটি মিষ্টির দাম ১০ টাকা। আমেরিকা , দুবাই, মালয়েশিয়া, সেীদি আরব, ভারত, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ও জাপানের লোকেরা এটি বেশি পছন্দ করেন। শীতকালে আমরা সবাই খেজুরের রস পছšন্দ করি। এ রস মিশিয়ে কোন খাবার তৈরি করলে তার  স্বাদ আরো বেড়ে যায়। মাগুড়ার শ্রীপুর উপজেলার কাজলিতে এটিআরপি নামের একটি প্রতিষ্ঠান এ রস বোতলজাত করে পাঠাচ্ছে, আমেরিকা, কানাডা, সৌদি আরব, দুবাই, ও মালয়েশিয়ায়। এটি স্থানীয়ভাবে “কাজলী খেজুর রস” একটু পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তা আরো বিস্তৃতি লাভ করবে। নীলফামারির মাদুর যাচ্ছে কানাডা, ডেনমার্ক, ও সুইডেনে। নীলফামারীর ইটাখোলা, চওড়া, বড়গাছা ও কচুকাটায় এগুলো তৈরি হয়। যশোরের সীতারামপুরের পাখির বাসা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। প্রায় দুশো রকমের পাখির বাসা তৈরি হচ্ছে। এতে বছরে প্রায় ৪০ লাখ টাকা উপার্জিত হচ্ছে। এধরণের বাসা এখন ঢাকা, নরসিংদী, টাঙ্গাইল  তৈরি হচ্ছে। এছাড়া পাবনার ঈশ্বরদীর বেনারসি পল্লীর শাড়ি এখন বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বর্তমান যুগের চাহিদার সাথে মিল রেখে তৈরি করা মৃৎ শিল্পগুলো সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। মাটির হাড়ি –পাতিল তৈরির কেশবপুরের কারিগররাই এখন মাটির টালি বানাচ্ছে। এগুলো শীতপ্রধান দেশে ছাদেও উপর বরফের চাপ ঠেকাতে ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া কুমিল্লার দেবিদ্বারের খদ্দর, মুরাদনগরের সুতার তৈরি দোলনা, হোমনার বাঁশের বাশি, বিদেশে যাচ্ছে। আমাদের দেশের গ্রমীণ অর্থনীতি অনেকাংশে কুটির শিল্পের উন্নয়নের উপর নির্ভরশীল।  স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় কারিগরররা যে বস্তু তৈরি করে তা আমাদের দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশী ক্রেতাদের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছে। এখন শুধু প্রয়োজনীয় পুঁজি ও পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সরকারি প্রচেষ্টার পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংক ও বিভন্ন সংস্থার সাহায্য প্রয়োজন।  “দেশি পণ্য কিনে হও ধন্য ” বলে যে শ্লেগান প্রচলিত রয়েছে তা আমাদেরকে স্বার্থক করতে হবে। বিশিষ্ট চিত্র শিল্পি জয়নুল আবেদীন বলেছিলেন- কত দেশ ঘুরলাম, কত যায়গা দেখলাম, কিন্তু আমার গাঁয়ের ফালানির মায়ের কলো পাতিলের তলার মতো এত সুন্দর কালা আর কোথাও দেখলাম না।” অর্থাৎ আমার দেশের হাতে তৈরি পণ্য চকচকে না হলেও এটিকে আমরা সাধুবাদ জানাতে হবে। এক্ষত্রে আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন করা আবশ্যক। বাইরের মনোহরী পণ্য বা কারখানায় তৈরি পণ্য দেখে আকৃষ্ট না হয়ে কুটির শিল্পজাত পণ্য কিনতে হবে। তবে একথা সত্য যে , বাইরের জিনিসের তুলনায় কুটির শিল্পজাত পণ্য বেশি টেকসই। কুটির শিল্পের প্রতি সবাই নজর দিলে এ শিল্প আরো সম্প্রসারিত হবে। দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা গেলে আমরা প্রচুর পরিমানে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জণ করতে পারবো। 
লেখকঃ মমিনুল ইসলাম মোল্লা,গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের ক্যাম্পেনার, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের  প্রভাষক ও সাংবাদিক, কুমিল্লা। 


শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.