বাজেটে কৃষি খাতে পর্যাপ্ত ভর্তুকি চাই
মমিনুল ইসলাম মোল্লাপ্রতি বছর জুন মাসে জাতীয় বাজেট পেশ করা হয়। এ বাজেটেরে দিকে কৃষক সমাজ তাকিয়ে থাকেন। এ বাজেটে পর্যাপ্ত ভর্তুকিসহ উপযুক্ত নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। বর্তমানে কৃষকরা ধান, পাট ,আলুসহ বিভিন্ন ফসলে পুঁজি উঠাতে হিমশিম খাচ্ছেন। তাই পর্যাপ্ত ফসল ফলানোর সুযোগ দিয়ে এ ফসল বিক্রি করে তারা যেন সচ্ছলভাবে চলতে পারেন সে ব্যাপারে বাজেটে দিক নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে জানা যায় এবারের বাজেটে সার্বিক ভর্তুকি ২০ শতাংশ কমিয়ে আনা হবে। এতে কৃষি খাতও অন্তর্ভুক্ত। এবাজেটে ভর্তুকি খাতে সম্বাব্য ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ২৬ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থ বছরের চেয়ে যা ১০ হাজার কোটি টাকা কম। বিদ্যুৎ ও কৃষি কাতে ভর্তুকি কমে যাওয়ায় কৃষি উপকরণ ও বিদ্যুৎ চালিত সব কিছুর দাম বৃদ্ধি পাবে। ফলে এদেশের কৃষক ও গরীব জনসাধারণ বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কৃষি প্রধান দেশ বাংলাদেশ। এখানে কৃষিকে অবহেলা করার কোন সুযোগ নেই। কৃষি এখনও মোট জাতীয় উৎপাদনে একক বৃহত্তম খাত হিসেবে সর্বাধিক অবদান রয়েছে। আবাদযোগ্য ভূমির পরিমান যাতে কমে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনীয় মূলধনের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষি পন্যের উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত করতে হবে। দ্রæত পচনশীল দ্রব্য স্টোরেজের ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমান সরকার গত মেয়াদের শুরুতে কৃষকদেরকে কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড দেয়া হয়েছিল। এটি অনুসরণ করে ভারতসহ আন্য দেশ তা চালু করে। বাংলাদেশের কৃষকরাও ব্যাপারটি পছন্দ করেছিল। এছাড়া এ সরকার ৩৫টি জেলায় ২৫ শতাংশ ভর্তুকিতে ট্রাক্টও, পাওয়ার টিলার, হারভেস্টারসহ বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হলে তা কৃষকদের মধ্যে সুফল বয়ে আনে। র্বতমানে বোরোতে সেচের পানি দেয়ার জন্য বিদ্যুৎ খাতে ২০ % সাবসিডি দেয়া হয় । কিন্তু এ সাবসিডির সুবিধা কৃষকরা পান না বলে অভিযোগ রয়েছে। এ সুবিধা সেচ যন্ত্রের মালিকরাই পেয়ে থাকেন। কৃষকদের হাতে ভর্তুকির টাকা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। পন্য বিক্রির মৌসুমে কৃষকরা যাতে ন্যায্যমূল্য পায় সেজন্য কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করা যেতে পারে। শুধু ফসল ক্রয়ের মৌসুমের জন্য এই ক্যাম্প করা হবে। কৃষক তার উৎপাদিত পন্য এখানে নিয়ে আসবে এবং সরকারি লোকজন তা ক্রয় করবে। এভাবে কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা যেতে পারে। অর্থমন্ত্রী একবার বাজেটে বক্তৃতায় বলেছিলেন কৃষকদের নিকট থেকে ফসল কিনে রাখার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে ৩৫/৪০ টি গোলাঘর জাতীয় কিছু একটা করবে। আমরা এখনও তার বাস্তবায়নের দেখছিনা।
২০১২-১৩ অর্থ বছরের সংশোধিত বাজেটে ১২ হাজার কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়। কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে ২০১২-১৩ অর্থ বছরে সরকার অভ্যন্তরীন বাজার থেকে ১৫ লাক মেট্রিক টন চাল এবং দেড় লাখ মেট্রিক টন গম সংগ্রহ করে। এসময় ৪৩ কোটি টাকা ব্যয়ে তিন লাখ ৩২ হাজার ৫০০ জন কৃষককে উচ্চ ফলনশীল আউশ এবং বোনা আউশ ( নেরিকা ) চাষের জন্য বিনা মূল্যে বীজ ও সার সরবাহ করা হয়। ফলে সে বছর দেশে প্রচুর পরিমানে ধান উৎপাদিত হয়। গত বছর বাজেট পেশের পর ৮ জুন দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুযায়ী জানা যায়, তখন কৃষি ভর্তুকির পরিমান ৯ হাজার কোটি টাকা করায় অথনীতিবিদগন তার সমালোচনা করেন। কেননা বিদেশ থেকে সার আনতেই খরচ হয়ে যায় ৮ হাজার ৩শ কোটি টাকা। তাছাড়া এ ভর্তুকীর পরিমান ছিল আগের বছরের ভর্তুকীর পরিমানের ১১ দশমিক ৯৫ শতাংশ কম। ২০১৩-১৪ সালের বাজেটে অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন মিলে কৃষি মন্ত্রনালয়ের জন্য ১২ হাজার ২৭৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়। ২০১২-১৩ অর্থ বছরের তুলনায় কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষমাত্রা ১৪ হাজার ১৩০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা করা হয়। এক পরিসংখানে দেখা যায়, ১৯৯৫-১৯৯৬ অর্থ বছরে দুধ ও দুºজাত দ্রব্য ২১৩৯, চিনি-৪৪৯, চাউল ১০৫৬৬, গম ৭০০৬, তুলা ৬৩২২ মিলিয়ন টাকা, ১৯৯৬-৯৭ এ দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য ২৯০৪, চিনি ২৬০৬, চাউল ১৭৫১, গম ৮৮২৪, তুলা ৮২৮৬, ১৯৯৭-৯৮ এ দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য ২৫৬৪, চিনি ২০১৭, চাউল ১১১৮২, গম ৮৮২৬, তুলা ১০৭৮৪, ১৯৯৮-৯৯ দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য ২৮০৮, চিনি ২০০২, চাউল ২৫৭৫৮ গম ১৭২০৪, তুলা ১২৩১৫ এছাড়া ১৯৯৯-২০০০ সালে দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য ৪০৬৮, চিনি ১৬০৭, চাউল ৩৩৬৬, গম ১২৫৩১, এবং তুলা ১৪৮৫২ বাবদ মিলিয়ন টাকা আমদানী করা হয়। তথ্য সূত্রঃ ফরেন ট্রেড স্ট্যটেস্টিক্স অব বাংলাদেশ ১৯৯৯-২০০০ ভলিউম-২।পরিসংখ্যানে দেখা যায় ১৯৯৫-৯৬ থেকে ১৯৯৯-২০০০ এই পাঁচ বছর সময়কালের মধ্যে প্রধান খাদ্যপন্য চালের আমদানি উল্লেখযোগ্য পরিমানে হ্রাস পেলেও দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য , চিনি, গম, তুলা, সার ও ভোচ্য তেলের আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুলের চেয়েও বেশি। এই পরিসংখ্যান থেকে আরেকটি বিষয় অত্যন্ত বাস্তবভাবে অনুধাবন করা যায় যে দেশে কৃষির অগ্রগতির বিষয়টি এখনো পর্যন্ত একটি সুষম উন্নয়নের ভিত্তি ভূমির উপর দাঁড়াতে পারেনি। দেশের প্রধান আমদানি পণ্যের মোট আমদানী ব্যয় একই সময়ে আমদানীকৃত প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি, ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জামোদির মোট ব্যয়ের পরিমানকে ছাড়িয়ে যায়। আর এ ব্যয় দেশের প্রধান রফতানি দ্রব্য তৈরি পোশাকের চেয়ে ও বেশি।এক পরিসংখানে দেখা যায় , ২০০৬-০৭ অর্থ বছরে কৃষিতে ভর্তুকি ছিল ১ হাজার ৩০০ কোটি, ০৫-০৬ অর্থ বছরে ১ হাজার ২০০ কোটি, ০৪-০৫ অর্থ বছরে ৬০০ কোটি টাকা, ০৩-০৪ অর্থ বছরে ৩০০ কোটি টাকা ০২-০৩ অর্থ বছরে ছিল ২০০ কোটি টাকা ০১-০২ অর্থ বছওে ছিল ১০০ কোটি টাকা। কৃষিকে স্বয়ংসম্পুর্ণ কররতে হলে উন্নত জাতের বীজের ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে কৃষি গবেষণা ও শস্য বহুমুখীকরণের কোন বিকল্প নেই। দেশীয় জমিতে ব্রী-৪৭ জাতের ধান সহজলভ্যে করতে হবে যাতে তারা সহজেই তা পেতে পারে। কৃষকদের নিকট থেকে সংগৃহীত চাল ও ধান রাখার জন্য গুদামের বিকল্প নেই। খাদ্য গুদামের বর্তমান ১৬ লাখ মেট্রিক টন ধারণক্ষমতা থেকে বাড়িয়ে ২০১৫ সালের মধ্যে প্রায় ২০ লাখ মেট্রিক টনে উত্তীর্ণ করার লক্ষমাত্র নেয়া হয়েছে। শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন- সরকার খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে কৃষি খাতে ভর্তুকির বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। বর্তমানে প্রতি কেজি ইউরিয়ায় ২৪, টিএসপিতে ১৮, ডিএপিতে ১৮ এমপিও তে ২৫ টাকা কওে ভর্তূকি দেয়া হচ্ছে। উন্নত দেশগুলো তাদেও কৃষিকে রক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রকার ভর্তুকি উচ্চ শুল্ক হার, আমদানি কোটাসহ একগুচ্ছ রক্ষণশীল পদক্ষেপকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। এ ভর্তুকি ব্যবহৃত হচ্ছে গম, ময়দা, পনির, মাখন, পোল্ট্রি, এবং গবাদি পশুর মাংস রপ্তানিতে। সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে নরওয়েতে, এখানে গড় ভর্তুকি ৭৭, এছাড়া ফিনল্যান্ড ৭১, জাপান ৬৬, সুইডেন ৫৯, কানাডা ৪৫, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৩০, আর কৃষি প্রধান বাংলাদেশে ভর্তুকির পরিমান মাত্র ৩.১৬ শতাংশ ; তাও আবার বছর বছর কমানো হয়। এব্যাপারে জাতিসংঘ কৃষি ও খাদ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চীন, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ কৃষিতে প্রচুর ভর্তুকি দিয়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ণ হয়েছে। সে পথে আমাদেরও এগুনো উচিত। উন্নত দেশগুলোর অব্যাহত ভর্তুকি এবং উদ্বৃত্ত কৃষিজাতপন্য আমাদের মতো দেশগুলোর বাজারে অবারিতভাবে ডাম্পিংকে মোকাবিলা করার কার্যকর কৌশল উদ্ভাবন করা অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজন। উন্নত দেশগুলোর আগ্রামী নীতির মোকাবেলা এবং নিজেদের কৃষি সুরক্ষার স্বার্থকে সমুন্নত রাখােেত হলে আমাদের দেশেও প্রতি বছর পর্যাপ্ত পরিমানে কৃষি ভর্তুকি বহাল রাখতে হবে। লেখকঃ মমিনুল ইসলাম মোল্লা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক ও সাংবাদিক, কুমিল্লা