জিডিপিতে কৃষির অবদান বৃদ্ধিতে কৃষি প্রণোদনা চাই/

জিডিপিতে কৃষির অবদান বৃদ্ধিতে কৃষি প্রণোদনা চাই/

 পেশা পরিবর্তনরোধে জমির মালিকদের কৃষি মাঠে ফিরিয়ে নিতে পদক্ষেপ চাই
মমিনুল ইসলাম মোল­া

বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ।  কৃষকরাই এদেশের  কৃষিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। তার া মাথার  ঘাম পায়ে ফেলে আমাদের  জন্য খাদ্য জোগাচ্ছেন। তারাই প্রকৃত দেশপ্রেমিক। কি বন্যা,  কি খরা,  কোন প্রকার  প্রতিবন্ধকতাই তাদের কে আটকাতে পারে  না। কিন্তু হাড়ভাঙ্গা খাটুনির  মাধ্যমে যে সোনার  ফসল তার া ঘরে  তোলেন তা তার  তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন মহাজন কিংবা প্রাতিষিাঠানিক ব্যাংকের কোষাগারে। একদিকে জমির  পরিমান কমে যাওয়া অন্যদিকে উৎপাদনের  উপকরণের  মূল্য বেড়ে যাওয়ায় তারা দিশেহারা । কৃষি কাজ করে  প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে না পারায় জমির  মালিকগণ কৃষি ছেড়ে অন্য পেশা ধরতে বাধ্য হচ্ছেন। জিডিপিতে  তাদের  অংশগ্রহণ কমছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছেন, মোট দেশজ উৎপাদনে ( জিডিপি) অন্যান্য খাতের  তুলনায় কৃষির  অবদান কমছে। এর  প্রধান কারণ কৃষকদের  মধ্যে জ্ঞানের  সীমাবদ্ধতা। প্রতিনিয়ত পরিবর্তীত জলবায়ুর  সঙ্গে আমাদের  কৃষকদের  মানিয়ে নিতে যে জ্ঞান দরকার  তা আামাদের  নেই। ফলে আমরা কৃষিতে সর্বোচ্চ সফলতা অর্জণ করতে পারছিনা। ”উন্নয়ন অšে¦ষণের  মাসিক “ বাংলাদেশ র্অথনৈতিক পর্যালোচনা ” প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কৃষি খাতে ২০০৯-২০১০ অর্থ বছরে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধির  হার  কমার  ধারা অব্যহত  রয়েছে। এ দুই খাতের  প্রবৃদ্ধির  ক্রমহ্রাসমান তা দেশের  জিডিপি বৃদ্ধির  হারকে সঙ্কুচিত করেছে। ২০০৯-২০১০ অর্থ বছরে  ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ থেকে কমে ২০১০-১১, ২০১১-১২, ২০১২-১৩ অর্থ বছরে  যথাক্রমে ৫ দশমিক ১৩, ৩ দশমিক১১ এবং ২ দশমিক ১৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যথোপযুক্ত নীতিগত পদক্ষেপের  অভাব, জমির  ক্রমাগত হ্রাস, নতুন প্রযুক্তির  উদ্ভাবন ও  বিতরণের  প্রকটতা এবং কৃষিতে যথাযথ গবেষণা ও  প্রশিক্ষণের  অপর্যাপ্ততা কৃষি খাতের  প্রবৃদ্ধিকে কমিয়ে দিচ্ছে। পরি সংখ্যান ব্যুরোর  হিসেব অনুযায়ী জিডিপিতে কৃষির  অবদান ২০ শতাংশ থেকে নেমে ১৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এক পরিসংখানে দেখা যায়, বাংলাদেশে মোট জমির  পরিমান ৩ কোটি ৩৮ লাক ৩৪ হাজার  একর । এর  মধ্যে আবাদযোগ্য ২ কোটি ১ লাখ ৫৭ হাজার  একর । মাথাপীছু আবাদি জমির  পরিমান ০.২৮ একর । ডেসিমেলের হিসেবে ১.৫০ একর । প্রতি বছর  ১০০ ভাগের  ১ ভাগ জমি কমছে। বাংলাদেশে ১ কোটি ৭৬ লাখ ৮০৪ টি কৃষক পরিবার  রয়েছে। বাংলাদেশের  অর্থনীতির  কাঠামোগত পরিবর্তনের  কারণে জিডিপিতে কৃষির  অবদান কমছে। উচ্চ মজুরি  ও  জীবন ঘনিষ্ঠ কারণে গ্রামীণ জনগোঠী শহরে  ও  দেশের  বাইরে  চলে যাচ্ছে। গ্রামে খামারের  সংখ্যা বাড়লেও  আকারে  ছোট হচ্ছে। এ পরিবর্তনেগুলো অন্য দেশেও  অবশ্য হচ্ছে। প্রয়োজনে ঔসব দেশের  কৃষি বিশেষঙ্ঞদের   সাথে আমাদের  দেশের  সমস্যাগুলো শেয়ার  করা যেতে পারে । এতে সমাধানের  একটি পথ বেড়িয়ে আসতে পারে । 

অর্থমন্ত্রী বলেন, “ প্রতিনিয়ত জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু আমাদের  কৃষক আগের  অর্জিত জ্ঞানই কৃষিতে প্রয়োগ করছেন। এতে তাদের  মধ্যে নলেজ গ্যাপ থেকে যাচ্ছে। এ গ্যাপ দূর  করার  জন্য নানা ধরণের  সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে আমরা কৃষিতে অনেক সফলতা অর্জণ করতে পারব। কারণ আমাদের  দেশের  কৃষক ওয়ার্ল্ডক্লাশ। ” কৃষি পণ্যের  যথাযথ বাজার  ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে না পারা এবং উৎপাদিত পণ্যের  ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হওয়াই এর  অন্যতম কারণ। কৃষি খাতে জিডিপির  অবদান কমে যাবার  কারণ জানতে চাইলে ঢাকা চেম্বার  অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্টির  ( ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি সবুর  খান জানান, রিয়েল এস্টেট কোম্পানী ও  নদী ভাঙ্গনের  ফলে প্রতিবছর ই আাবাদি জমির  পরিমান কমে যাচ্ছে। কৃষি উপকরণগুলোর  দাম প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। ফলে উৎপাদন খরচ স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু কৃষক সে অনুযায়ী ফসলের  মূল্য পাচ্ছে না। কৃষক যখন কোন পণ্য গড়ে  তোলে তখন এগুলো রাখার  ক্ষেত্রে সমস্যা ভোগ করে ।  এক্ষেত্রে সকল কৃষকের  জন্য সরকারিভাবে গুদামের  সুবধিা দিতে হবে। পুরাতন গুদামগুলো সংস্কারের  ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমানে কৃষিতে যন্ত্রের  ব্যবহার  বাড়ছে। শুধুমাত্র জমি চাষই নয়, রোপন, বপণ, মাড়াই, ধান কাটা, ধান থেকে চাল বের  করা ইত্যাদি কাজে যন্ত্র ব্যবহার  করা হয়। এসব যন্ত্রের  দাম বাড়ায় কৃষকরা অতিরিক্ত চার্জ দিতে হচ্ছে। তাই বিদেশ থেকে আসা যন্ত্রগুলোর  শুল্ক কমাতে হবে এবং দেশীয়ভাবে  যন্ত্রগুলো উৎপাদন করা যায় কিনা সে ব্যাপারে  সরকারিভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। জলবায়ু পরির্বতনের  প্রভাব মোকাবেলা কর া কৃষকদের  জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তনে কৃষকের  ফসল নষ্ট হয়। বাজেটে এজন্য বরাদ্দ রাখতে হবে। পাশাপাশি ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাডাপ্টেশন ইনস্টিটিউশন ” প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে । তাই প্রযুক্তি উদ্ভাবনে উৎপাদনশীলতার  দিকেই বেশি জোর  দেয়া উচিৎ। মধ্যসত্বভোগীরা কৃষকের  রক্ত চুষে খাচ্ছে। কৃষক যে দামে তার  ফসল মাঠে বিক্রি করে  ভোক্তারা তার  দ্বিগূণ বা ৩গূণ দামে কিনে নিচ্ছে। কৃষকরা যাতে ন্যায্যমূল্য পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কৃষি অলাভজনক হওয়ায় কৃষি খাতে কর্মসংস্থান কমছে। একজন কৃষকের দাদা কৃষি কাজ করেছেন, বাবা কৃষি কাজ করেছেন কিন্তু ছেলে-মেয়েরদের  আমলে জমি কমে যাওয়ায় শুধু কৃষি জমির  আয় দিয়ে তাদের  জিবিকা নির্বাহ হচ্ছেনা। গত ৪ দশক ধরে  শিল্প ও  সেবা খাতের  কম বেশি বিকাশ ঘটায় কৃষি খাতের  নির্ভরশীলতা কমছে। বর্তমানে দেশের  মোট জনসংখ্যার  ৪৮ শতাংশ কৃষির  উপর  র্নিভরশীল। যা ২০০৬ -০৭ সাল পর্যন্ত ছিল ৬০ শতাংশ। তাছাড়া দেশের  কৃষি খাতে কর্মসংস্থানের  হার ও  কমেছে ২০ শতাংশ। অন্যদিকে ভূমিহীনের  সংখ্যাও  বেড়ে দাঁড়িয়েছে দেড় কোটি। অর্থনীতিবিদদের  মতে কৃষির  সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে  কৃষক এগুতে পারে নি। স্বাধীনতার  এত বছর  পর ও  আয় বৈষম্য কমেনি। বিজ্ঞানীরা বলছেন দেশের  ৩০ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার  নীচে বসবাস করে । তাদের  অধিকাংশই কৃষক। আন্তর্জাতিক ধান গবেষনা ইনস্টিটিউটের  ডাইরেক্টর  জেনারেল ডঃ রোনাল্ড পি ক্যানট্রিল তার  এক গবেষণায় উন্নত ও  অনুন্নত কতিপয় দেশের  ধান উৎপাদনের  তুলনামূলক খরচ ( ১৯৯৫) দেখান । এতে দেখা যায় ১ টন  ধান উৎপাদনে বাংলাদেশে খরচ হয় ১৩৮ মার্কিন ডলার । আর  ভিয়েতনামে খরচ হয় ১০০ মার্কিন ডলার , থাইল্যন্ডে খরচ হয় ১২০ ডলার , ফিলিপাইনে খরচ হয় ১৩৮ মার্কিন ডলার । ইন্দেনেশিয়ায় ১১৭ মার্কিন ডলার । আবার  জাপানে একজন কৃষক  ১ টন ধান বিক্রি করে  পান ১৭৩০ ডলার , কোরিয়ার ১ জন কৃষক পান ৯৫৭ ডলার , আর  বাংলাদেশের  একজন কৃষক পান ১৮০ মার্কিন ডলার । কৃষকদের  উৎসাহ দিতে কৃষিপণ্যের  ন্যয্যমূল্য নিশ্চিত করা জরুরি । কৃষক ঠিকমতো দাম না পেলে সরকারের  হস্তক্ষেপ বাড়াতে হবে। উৎপাদন ও  খুচরা পর্যায়ে কৃষিপণ্যের  দামের  বিস্তর  ফারাক কমাতে “ প্রাইস কমিশন” করা যেতে পারে । আমাদের  দেশের  কৃষকরা উত্তরাধিকার  সূত্রে কৃষক। আমাদের  পূর্বপুরুষরা কৃষি কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। তারা জমি চাষের  সময় লাভ-লোকসান হিসেব করতেন না।  কিন্তু বর্তমান যুগের  কৃষককে অনেক কিছু চিন্তা করতে হয়।  জমি দিয়ে যদি জিবিকা নির্বাহ করা না যায় তাহলে সে জমি কৃষক হয় বন্ধক দিয়ে টাকা নিয়ে অন্য কাজে লাগায় অথবা সে জমি চাষাবাদ বহির্ভূত অন্য কোন কাজে লাগায়। ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় “প্রাইস কমিশন ” গঠনের  প্রস্তাব ছিল । এধরণের  কমিশন গঠন করলে তারা মূল্য পর্যবেক্ষণের  মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে । পাশাপশি কৃষি বিপনন অধিদপপ্তরকে  আর ও  বেশি কার্যকর  ভূমিকা নিতে হবে।  লেখকঃ গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের ক্যাম্পেনার, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের  প্রভাষক ও সাংবাদিক, কুমিল্লা।



শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.