ধানের বাম্পার ফলন ও ন্যায্যমূল্য প্রসঙ্গে
আমরা অনেকেই বলি- কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। এটা মনে হয় শুধুই মুখের কথা। আন্তরিকভাবে আমরা কৃষকদের কল্যাণ কামনা করিনা। তাই বাজারে কৃষি পণ্যের দাম কমলে আমরা খুশি হই। একটু চিন্তা করে দেখিনা ; যে কৃষক সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হাড়-ভাঙ্গা পরিশ্রম করে ফসল ফলায় সে ফসলের ন্যয্য মূল্য পেল কি না ? চালকল মালিক সমিতি ও খাদ্য মন্ত্রনালয়ের সূত্র উল্লেখ কওে প্রথম অঅলো সংবাদ প্রকাশ করেছে ০- একমন ধানের উৎপাদন খরচ ৯৬০ টাকা। এ হিসাবে প্রতিমন ধানে লাভ হওয়ার কথা ৮০ টাকা। তিন মাস রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম কওে মাত্র ৮০ টাকা অতিরিক্ত পাওয়া নেহায়েত কম। প্রকৃতপক্ষে কৃষকের নিজের, স্ত্রী, পুত্র , কিংবা ভাইসহ পরিবারের সকল সদস্যেও শ্রম েিসব করলে উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। প্রান্তিক কৃষক ১০৪০ টাকা পেলেও কোন রকমে মেনে নিতে পারতেন। কিন্তু বাজারের প্রকৃত অবস্থা খুবই করুণ। মধ্যস্বত্বভোগী , ফরিয়া, দালাল, ও তাদেও তৈরি সিন্ডিকেটের কারণে গ্রামের কৃষকরা ৬/৭শ টাকার বেশি পান না। ফলে ধান চাষ কওে কৃষকগণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ধানের দাম কম হলেও একথা সত্য এবার সরকারের অঅন্তরিকতা ও অনুক’ল কৃষি মৌসুমের কারণে এবার বাংলাদেশে কৃষিতে বাম্পার ফলন হয়েছে। এতদিন ব্যবসায়ীরা বলেছিলেন-সরকার মওসুমের শুরুতে ধানের ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করলে ব্যবসায়ীরা সে অনুপাতে ধান কেনা শুরু করবেন। আর ব্যবসায়ীরা কেনা শুরু করলে ধানের দাম অনায়াসে বেড়ে যাবেকৃষকদের বোরো ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য সরকার প্রতিবছর মৌসুমের শুরুতে ধান ও চালের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। এটি একটি ভাল উদ্যোগ। কিন্তু এ দামে ব্যাবসায়ীরা ধান-চাল কিনেন না। তবে কৃষকগণ যদি সরকারি গুদামে বিক্রি করে তবে তারা এ দাম পাওযার কথা। বাস্তবে দেখা যায় কৃষক তাদের পণ্য সরকারের কাছে বিক্রয় করতে পারেন না। এর পেছনে রয়েছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা , প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অবহেলা, এবং কৃষকদের অসচেতনতা।
২০১৮ সালে বোরা মৌসুমে ৩৮ টাকা কেজি দওে চাল এবং ২৬ টাকা কেজি দওে ধান কেনার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এর অঅগের বছরের তুলনায় সেটি ছিল কেজিতে ২ টাকা বেশি। সরকারি নিয়মে যা-ই থাকুক না কেন কয়েক বছর ধরে যে বিষয়টি লক্ষ করা যাচ্ছে সেটি হচ্ছে-কৃষক যখন ধান কাটেন তখন প্রয়োজন অনুযায়ী ধান-চাল সংগ্রহ করা হয় না । ফলে যে কৃষক ঋণ করে টাকা এনে ধান চাষ করেছেন তিনি তার উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। কারণ দাম বাড়ার জন্য তিনি অপেক্ষা করতে পারেন না। ফসল ঘরে উঠার সাথে সাথেই তাকে ঋনের টাকা পরিশোধ করতে হয়। কৃষি ব্যাংক থেকে কৃষকদেরেকে সহজে ঋণ দেয়ার কথা থাকলেও কৃষক তা পাচ্ছেন না। ফলে তাদেরকে বেসরকারি সাহায্য সংস্থা, আত্মীয়-স্বজন ও দাদন ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়। দাদন ব্যবসায়ীরা কৃষকদের দুর্বলতার সুযোগে তাদের সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। কোন কোন যায়গায় দেখা যায়, বোরা মৌসুমে কোন কৃষক ১০ হাজার টাকা ঋণ নিলে তাকে ফসল উঠার সাথে সাথে ১০ হাজার টাকা এবং ১০ মন শুকনা ধান পরিশোধ করতে হয়। ফলে ধানের ন্যায্য মূল্য না পেলে কৃষকগণ বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এছাড়া পরবর্তী ফসলের পুঁজিও কৃষকদেরকে এখান থেকেই অর্জন করতে হয়। তাই বীজ ও সার কেনার জন্য তাকে বোরো ধান পানির দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। সরকারি মূল্য ৮২০ টাকা হলেও তারা বর্তমানে পাচ্ছেন মাত্র ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা।বাংলাদেশ পরিসংখ্যাণ ব্যুরোর হিসেব মতে-১৯৮৬ সালে দেশে আবাদযোগ্য জমি ছিল ৮১ লক্ষ ৮৮ হাজার হেক্টর ২০০৩ সালে ছিল ৭০ লক্ষ ৮৭ হাজার হেক্টর, ২০০৭ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৭ লক্ষ ৯০ হাজার হেক্টর। এ হিসেবে প্রতি বছর কমছে ৮০ হাজার হেক্টর জমি। এর মধ্যে ৩০ হাজার হেক্টর জমিই যাচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতে। তাই কৃষিতে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে না পারলে দেশ গভীর সঙ্কটে পড়বে। উন্নত প্রযুক্তির সাথে সাথে উন্নত মানের বীজও ব্যবহার করতে হবে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন যায়গায় যেসব জাতের ধান চাষ করা হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে -দেশীয় উচ্চ ফলনশীল (উফসী), ব্রি ধান-২৮,বিআর-২৬,ভারতীয় ,কাজল লতা, চায়না, এসিঅই, সিড কোম্পানীর এসিাাই-১, (সম্পদ, বিএডিসির এসঅর-৮, ব্রাকের শক্তি।
আমাদের দেশের কৃষকগণ সাধারণত ধান, পাট, আলু, তৈলবীজ, ভ‚ট্টা,
ও শীতকালীন শাক-সব্জি চাষ করেন। এগুলো দিয়ে কৃষক তার নিজের খাদ্য চাহিদা মেটায়, প্রযোজনে আত্মীয় স্বজনের বাড়ি পাঠায়, তারপর উদ্বৃত্বটুকু বাজারে বিক্রি করে। বড় বড় কৃষকগণ ট্রাকে করে তাদের পণ্য দেশের বিভিন্ন যায়গায় নিয়ে বিক্রি করেন। এতে তাদের মোটামুটি লাভ হয়। এ ধরণের কৃষক ”বড়ধরণের কৃষক” । তবে তাদের সংখ্যা খুবই কম। বড় কৃষকদের পরই মাঝারি কৃষকদের স্থান। তারা কৃষি বাদেও অন্যান্য উৎস থেকে অর্থ উপার্জণ করে। তাই দ্রব্য সামগ্রীর দাম কমলেও তারা বেশি আফসোস করেন না। অন্য দিক দিয়ে তারা ক্ষতিটুকু পুষিয়ে নিতে পারেন। তৃতীয শ্রেনীর কৃষক হচ্ছে প্রান্তিক কৃষক। কৃষিই তাদের উপার্জণের একমাত্র পথ। তারাই বর্তমানে বেশি মার খাচ্ছে। কৃষির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যায় নির্বাহ করতে না পারলে তখন তাকে বাধ্য হয়েই কৃষি ছেড়ে দিতে হবে। কৃষি আমাদের কর্মসংস্থানের প্রধান অবলম্বন, কৃষকগন যদি পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় চলে যায় তাহলে অন্যান্য পেশার উপর চাপ পড়বে। ফলে বেকারত্ব আরো প্রকটভাবে দেখা দেবে। এবং এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা খুবই কষ্টকর হবে। কুমিল্লার দেবিদ্বারের একজন কৃষক যদি পুরোপুরি কৃষির উপর নির্ভরশীল হতে হয় তাহলে কমপক্ষে ৫ বিঘা (৩০) শতক জমির প্রযোজন হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় অধিকাংশ প্রান্তিক কৃষকের ৫ বিঘা জমি নেই। তাই তাকে অন্যের জমি লীজ নিয়ে অথবা বর্গা ভাগে জমি চাষ করতে হয়। এভাবে জমি চাষ বাবদ তার ব্যায় বাড়লেও উৎপাদিত ফসলের সে ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না।ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রতিটি কৃষক এবছর ধান উৎপাদন করে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। আমাদের দেশে প্রায় সময় লক্ষ্য করা যায় ; যে কোন পণ্য মাঠ থেকে তোলার সময় দাম কম থাকে ,তখন বড় বড় মজুদদাররা কৃষকদের নিকট থেকে পণ্য ক্রয় করে গুদামজাত করে। পরবর্তীতে দাম বাড়লে তারা উচ্চ দামে তারা তা বিক্রি করে। যে কৃষক কম দামে পণ্য বিক্রি করে দিয়েছিলেন তাকেই আবার সে পণ্য বাজার থেকে চড়া মূল্যে ক্রয় করতে হয়। সরকারিভাবে প্রতিটি গ্রামে খাদ্য গুদাম তৈরি করে সেখানে সল্প খরচে বেসরকারিভাবে কৃষকদের ধান গুদামজাত করার ব্যবস্থা করতে পারলে কৃষক লাভবান হবে।
লেখকঃ মমিনুল ইসলাম মোল্লা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক ও সাংবাদিক, কুমিল্লা।