তাজিম আমার গর্ভের ও গর্বের ধন
আজকের কন্যা শিশু আগামী দিনের মা। মাতৃত্বেই নারী জীবন স্বার্থক। যে কোন নারীর জীবনে মা হওয়াই সবচেয়ে বড় ঘটনা। স্বামী ও বাবার পরিবারের লোকেরা এটাই চায়। ছেলের বউ সন্তার সম্ভবা যে কোন শ্বাশুরীর জন্য এটি আনন্দের সংবাদ। তিনি নিজেই এ সংবাদ সকলের কাছে পৌছে দেন।প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার পর দেখা গেল আমার ভাইকে ছাত্র এবং আমাকে ছাত্রী বলে শিক্ষকগণ গণ্য করতে থাকে। ক্লাশে বসার সময়ও ভাইয়া এক সারিতে আর আমি অন্য সারিতে বসলাম। তখন থেকেই বুঝতে পারলাম ছেলে আর মেয়ে ভিন্ন। হাফ প্যান্ট আর ফ্রক ছেড়ে যখন জামা সেলোয়ার পড়তে শুরু করেছি তখন থেকেই বুঝতে পারি আমি একজন কিশোরী, আমার বিয়ে হবে। আমি চলে যাব, মা-বাবা, ভাই-বোন সবাইকে ছেড়ে আমাকে একদিন চলে যেতে হবে। কার সাথে যাব ? আমাকে কে নেবে আমার ভবিষৎ ঠিকানা কোথায় ? এইসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই শিক্ষা জীবন শেষ হয়ে গেল। বাবা একদিন বল্লেন বিকেল বেলা কয়েকজন লোক আসবেন। একটু সেজেগুজে থকতে, বাবার কথার বাইরে কিছু বলতে পারলাম না। অল্প সময়ের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেল। আমি চলে গেলাম নতুন ঠিকানায়। বিয়ের অল্প কিছু দিনের মধ্যে মাসিক বন্ধ হয়ে গেল। ধীরে ধীরে দেহের মধ্যে কিছু পরিবর্তন পরিবর্তন লক্ষ করলাম। আমার স্বামী একদিন একটি প্রেগণেন্সি চেক করার স্টিক নিয়ে আসলেন। পরদিন সকালে চেক করা হয়। একটি মাত্র দাগ দেখা গেল। আরেকটু পরে দেখা গেল আরেকটি অস্পষ্ট দাগ। অস্পষ্ট দাগটি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো আর আমার স্বামীর চেহারাও ধীরে ধীরে উজ্জল হতে লাগলো। কিছুক্ষনের মধ্যে সংবাদটি সাড়া বড়িতে ছড়ে গেল। অ¤ø মধুর সুখে-স্বপ্নে পুলকিত হলাম।
খাওয়ার রুচি কমে গেল। সারাক্ষণ বমি বমি লাগে। মুরব্বীদের সাথে যোগাযোগ করলে তারা বল্লেন সন্তানের জন্য একটু-আধটু কষ্ট সহ্য করতে হয়। কিছুদিন পর শুরু হল কাশি, গলাব্যাথা, জ্বর। আগে সামান্য জ্বর হলেই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ না করেই প্যারসিটামল খেতাম। কিন্তু বাচ্চার ক্ষতির আশংকায় এখন নিজে নিজে ডাক্তারী করিনা। ডাক্তারও ঔষধ দিতে চান না। তাই সব কিছু সহ্য করে যাচ্ছি-ভবিষ্যতের সুখের আশায়।একদিন সিড়িঁ দিয়ে নিচে নামার সময় পায়ের ভারসাম্য হুিরয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নীচে পড়ে যাই। ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করলে ডাক্তার অভয় দিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর অতিরিক্ত জার্নির কারনে আমি অসুস্থ হয়ে পরলাম। আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল।বাচ্চার সুস্থতা পরীক্ষার জন্য আমাকে দায়িত্ব দেয়া হল বাচ্চা প্রতি ঘন্টায় কতবার নড়াচড়া করে তা গুনে গুনে লিখে রাখা, প্রতিবার নড়া চড়ায় প্রচন্ড ব্যাথা পেতাম। তরপরও ভাল লাগত-বাবুর সুস্থতার প্রমাণে। আমি তখন আরোও কষ্ট করতে রাজি ছিলাম।
একদিন আমার স্বামী এসে জানালেন আগামীদিন সিজার অপারেশন হবে। ভয়ে আমার কলজে হিম হয়ে আসছে। আমার সামনে একটি পত্রিকা ছিল। তাতে চোখ পরতেই দেখলাম “গর্ভজনিত জটিলতায় দেশে প্রতি বছর ২৮ হাজার মায়ের মৃত্যু ঘটছে।” তখন ভাবলাম নারী না হয়ে পুরুষ হলাম না কেন ? তাহলে তো আর বিপদে পড়তে হতো না। আবার পরক্ষণই মনে হল “রাখে আল্লাহ মারে কে।” একসময় সকল চিন্তার অবসান হল। জ্ঞান ফিরতেই দেখি চাঁদের মতো সুন্দর একটি সোণামনি আমার পাশে শুয়ে আছে। বাবুকে দেখে আমার ১০ মাসের কষ্ট উবে গেল। মনে মনে বল্লাম- আমি ধন্য, আমি সফল আমি .........। প্রকৃত পক্ষে নারীর জীবন বৃক্ষের মত। যে বৃক্ষ ফল দেয় না সে বৃক্ষের জীবন স্বার্থক নয়। তেমনি সন্তানহীন নারীর দুঃখের সীমা নেই। আমার একমাত্র সন্তান তাজিম। তার দিকে তাকলে আমি সকল দুঃখ ভুলে যাই। সে আমার গর্ভের ও গর্বের ধন।