মফস্বল সাংবাদিকদের সুখ-দুঃখ

মফস্বল সাংবাদিকদের সুখ-দুঃখ


মমিনুল ইসলাম মোল্লা




মফস্বল শব্দের আভিধানিক অর্থ শহরের বাইরের  স্থান বা গ্রাম। এ অর্থে মফস্বলের খবর মানে গ্রামের খবর বাস্তবে রাজধানীর বাইরে উপজেলা- জেলার সংবাদকে বুঝায়। সুতরাং মফস্বল সাংবাদিকতা বলতে ঢাকার অফিস স্টাফের বাইরের সাংবাদিকদের বুঝানো হয়। বর্তমানে ঢাকার পত্রিকাগুলো মফস্বলের খবরের জন্য ভিন্ন ভিন্ন নামে পাতা রাখা হয়েছে। উদাহরণস্বরুপ বাংলার মুখ ( দৈনিক যুগান্তর ), সারা দেশ ( প্রথম আলো) , দেশের খবর ( দৈনিক জনকণ্ঠ ), লোকালয় ( দৈনিক সমকাল )।ধরি, চলতি বছরের বাজেটে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন বাবদ ১০০০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী মহোদয়ের পক্ষে জানা সম্ভব নয় কোন জেলার কোন গ্রামে ব্যায় করলে এ টাকার সদ্ব্যবহার হবে ।  মফস্বল সাংবাদিকগণ প্রতিটি গ্রামে ঘুরে ঘুরে এ তথ্য পত্রিকায় সহজেই ফুটিয়ে তুলতে পারেন । বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে সকল পেশায় নারীদের অংশগ্রহণ থাকলেও সাংবাদিকতায় তেমন একটা দেখা যায় না। দু/চারজন সাহস করে আসলেও তাদেরকে এগুতে দেয়া হয় না। একটি উপজেলার রাজনৈতিক সংঘর্ষের নিউজ এলাকাবাসী বিস্তারিতভাবে পত্রিকায় দেখতে চান ।মফস্বলের সাংবাদিক হয়তো বিস্তারিতভাবেই পাঠালেন কিন্তু মফস্বল সম্পাদক ভাবলেন ঢাকা থেকে এতদূরের ঘটনা  বিস্তারিত কি দরকার? তিনি সেটি ছোট করে ১৯ নম্বর পৃষ্ঠায় ছাপালেন। এটি ঐ এলাকার লোকজনদের প্রতি সুবিচার করা হলো না। সত্যিকারের সাংবাদিক নিউজ করার সময় আগ-পিছ ভেবে করেন না। তিনি সত্যকে ভালবাসেন, নিউজটা সরকারি কর্মকর্তা , পুলিশ, রাজনৈতিক কর্মী, কিংবা হোয়াইট কালার মাদক পাচারকারীর বিরুদ্ধে গেলেও তিনি তাতে পীছ পা হন না ।  দুঃখজনক হলেও সত্য নিউজ করার পর সাংবাদিক কোন সমস্যায় পড়লে তখন হেড অফিসের কাঙ্খিত সাহায্য ও সমর্থন পাওয়া যায় না ।


১৯৭৪ সালেরসংবাদপত্র কর্মচারী (চাকুরির শর্তাবলী ) আইন অনুযায়ী প্রত্যেক সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানে কর্মচারী নিয়োগের সময় সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি সংবাদপত্র কর্মচারীকে একটি নিয়োগপত্র দিতে হবে । এ নিয়োগপত্রে কর্মচারীর নাম পিতার নাম, ঠিকানা, নিয়োগের তারিখ , চাকুরির ধরণ ও চাকুরির শর্তাবলী উল্লেখ থাকতে হবে। প্রত্যেক কর্মচারী নিয়মিত বেতন-ভাতা ছাড়াও ভবিষ্যৎ তহবিলের সুযোগ পাবেন । সপ্তাহে ৪৮ ঘন্টার বেশী কাজ করানো যাবে না, পেশাদার সাংবাদিকতায় সাংবাদিকগন নৈমিত্তিক ছুটি বাদেও কর্তব্যে ব্যায়িত সময়ের কমপক্ষে এগার ভাগের একভাগ সময় পূর্ণ মজুরীতে ছুটি পাবেন, চিকিৎসা ছুটি পাবেন, প্রত্যেক সংবাদপত্র কর্মচারী ও তার পোষ্য ব্যক্তিদের চিকিৎসার ব্যায় সংশ্লিষ্ট সংবদপত্র প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসারে বহন করবে। এ আইন অমান্য করলে শাস্তির ব্যাপারে ১৮ ধারায় বলা হয়েছে কোন ব্যক্তি এ আইনের কোন বিধান অথবা এ আইন মোতাবেক প্রণীত কোন বিধি লংঘন করলে এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানয় দন্ডনীয় হবেন। সংবাদপত্রটি সমিতিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হলে এবং প্রত্যেক পরিচালক, ব্যবস্থাপক, সচিব, ও অন্যান্য কর্মকর্তা ( যারা জড়িত ) প্রত্যেকেই একই দন্ডে দন্ডনীয় হবেন । ওয়েজ বোর্ড এর হিসেব অনুযায়ী একজন নিজস্ব প্রতিবেদক গ্রেড-৩ এর অন্তর্ভুক্ত । তার সাথে একই গ্রেডে রয়েছেন সহ-সম্পাদক, আলোকচিত্র সম্পাদক, নিজস্ব সংবাদদাতা, ক্রীড়া প্রতিবেদক, আর্টিস্ট, কার্টুনিস্ট, সিনিয়র সম্পাদনা সহকারী এবং সংবাদ গ্রন্থাগারিক । বিশেষ সংবাদদাতা হিসেবে সাংবাদিকগণ হেড অফিসের বাইরে কাজ করতে পারেন। এ পদটি গ্রেড-১ এর আওতাভূক্ত । বিশেষ সংবাদদাতা হেড অফিসের ইচ্ছে অনুযায়ী ও প্রয়োজন অনুযায়ী যে কোন যায়গায় কাজ করতে পারেন । তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নিউজ সংগ্রহ , রচনা, ব্যাখ্যা, ও বিশ্লেষণ করেন। নিজস্ব প্রতিবেদক হিসাবে যারা কাজ করেন তাদের গ্রেড -৩। তিনি পত্রিকার প্রকাশনা কেন্দ্রে নিযুক্ত থেকে খবর সংগ্রহ, তা লেখা ও উপস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন । বর্তমানে ক শ্রেণীর পত্রিকাগুলো জেলা ও বিভাগে ব্যুরো অফিস দিয়ে তাকে । হিসেব অনুযায়ী ব্যুরো প্রধান দায়িত¦ পালন করে নিয়মিতভাবে বেতন-ভাতা ভোগ করবেন । ব্যুরো প্রধান নিজস্ব প্রতিবেদক , সহ সম্পাদক বা বার্তা সম্পাদক হিসাবে তার স্বাভাবিক দায়িত্ব ছাড়াও যে কোন স্থানে বার্তা সংস্থার ব্যুরো বা শাখা অফিসের সার্বিক দায়িত্ব পালণ করেন ।  পত্রিকার নিজস্ব প্রতিবেদক গ্রেড -৩ অনুযায়ী বেতন-ভাতাদি পাবেন । তিনি সংবাদ সংস্থার সদর দপ্তরে বা কোন ব্যুরো অফিসে নিুযুক্ত থেকে সংবাদ সংগ্রহ ও উপস্থাপনা করেন । এছাড়া নিজস্ব সংবাদদাতা ও গ্রেড -৩ এর অন্তর্ভূক্ত । তিনি সংবাদ সংস্থার নিজস্ব সংবাদদাতা হিসাবে সংবাদ সংগ্রহ করে ডাক বা যেকোনভাবে সংবাদ সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে পাঠানোর কাজ করেন ।এছাড়া গ্রেড-৪ এ রয়েছেন শিক্ষানবীশ সহ সম্পাদক, শিক্ষানবীশ নিজস্ব প্রতিবেদক ও শিক্ষানবীশ নিজস্ব সংবাদদাতা।

       ঢাকার একটি পত্রিকার জেলা প্রতিনিধিকে শহরের আনাচে-কানাচে ঘুরতে হয়। যদি উপজেলা প্রতিনিধি না থাকে তাহলে দূরবর্তী উপজেলাগুলোতেও হন্যে হয়ে ঘুরতে হয় । সাংবাদিক নেতারা সাংবাদিকদের স্বার্থ নিয়ে সবসময়ই সোচ্চার । কিন্তু মফস্বলের সাংবাদিকগণ কেমন আছেন তা তারা জানতে চান না । কুমিল্লার মুরাদনগর চট্টগ্রাম বিভাগের একটি বৃহত্তর উপজেলা । এ উপজেলার সাংবাদিকগণ উত্তর থেকে দক্ষিণে  ৬০ কিলোমিটার পথের খোঁজ-খবর রাখেন । এ খবর রাখতে গিয়ে ছোটাছুটি করতে গিয়ে কত টাকা যে খরচ হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারপরও সেটা তারা করেন শুধুমাত্র সম্মানের আশায় । বর্তমান যুগ স্যাটেলাইটের যুগ । প্রিন্ট মিডিয়ার চেয়ে ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া অনেক এগিয়ে রয়েছে । সকাল দশটায় কোন ঘটনা ঘটলে পত্রিকায় সে ঘটনার ছবি ও সংবাদ ঐ এলাকায় আসবে পরদিন দশটায়।  অন্যদিকে সাথে সাথে এ ঘটনার কথা টিভির নীচে দিয়ে স্ক্রল আকারে সাথে সাথেই দেখানো সম্ভব । টিভির স্ক্রীনে দেখে একটি পত্রিকার ডেস্কম্যান তার পত্রিকার উপজেলা প্রতিনিধিকে এসাইনমেন্ট দিলেন তাড়াতাড়ি রিপোর্ট পাঠানোর জন্য । এসব এসাইনমেন্টের কাজ মফস্বল সাংবাদিকগণ গুরুত্ব সহকারে করেন । এতে তার দক্ষতা ফুটে উঠে । কিন্তু মাঝে মাঝে চলতি ঘটনা বাদেও স¦ার্থপুষ্ট হয়ে এলাকার কুখ্যাত অত্যাচরী রাজনৈতিক নেতার গুনগান গেয়েমফস্বল সাংবাদিককে  লিখতে বলা হয় । এ রিপোর্ট ছাপানোর পর সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক এলাকা ত্যাগ করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। এছাড়া এ সাংবাদিকের নিউজের ব্যাপারে ফেসবুকে পাঠকদের বহু ধরণের মন্তব্য করতে দেখা যায়। অথচ সাংবাদিক হেড অফিসের নির্দেশে সেটি করেছেন। এ সাংবাদিকের যেহেতু কোন স্থায়ী নিয়োগপত্র নেই তিনি এসাইনমেন্ট না নিলে তাকে বাদ দিয়ে অন্য ক্উাকে নিয়োগ দেয়া কোন ব্যাপার নয় । ঢাকার সাংবাদিকদের মত মফস্বলের সাংবাদিকগণও সকালে ঘর থেকে বের হন । বউ বাজারের থলে হাতে দিয়ে বলে এটা আনতে হবে /ওটা আনতে হবে। বৃদ্ধ বাবা বলে “ খোকা ফেরার সময় আমার হার্টের ওষুধটা আনিস বাবা, মেয়ে বলে বাবা আমার ফরম ফিলাপের টাকার কি খবর ? ১০ তারিখের পরে গেলে লেট ফাইন দিতে হবে কিন্তু ।”  সাংবাদিক সাহেব তখন ফেল ফেল করে তাকিয়ে থাকেন। তাকে অফিস থেকে যা দেয়া হয় ( সব পত্রিকা দেয় না) তাতে তার নিউজ কালেকশন খরচও উঠে না। কিন্তু বিকাল ৫ টার মধ্যে ন্্্্্্্্্উজি অফিসে না পৌছলে তাকে বকা-ঝকা শুনতে হয় ।

       যেসব মফস্বল সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হত্যার শিকার হয়েছেন আমরা তাদেরকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। বিশেষ করে নীলসাগর পত্রিকার মোহাম্মদ কামরুজ্জামান, দৈনিক রানারের সাইফুল আলম মুকুল, দৈনিক বীর দর্পণ এর মির ইলিয়াস হোস্ঈান , যশোরের শামসুর রহমান, এর মৃত্যু আমাদেরকে বিশেষভাবে নাড়া দেয় ।  

লেখকঃ মমিনুল ইসলাম মোল্লা,   প্রভাষক , সাংবাদিক ও  ধর্মীয় গবেষক, কুমিল্লা।    সধসরহসড়ষষধয@ুধযড়ড়.পড়স

     


শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.