সাংবাদিক হত্যার বিচার হয়না যে কারণে
মমিনুল ইসলাম মোল্লাসাংবাদিকগণ সমাজের অনিয়ম, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, ও মানবাধিকার লঙ্গনের ঘটনা প্রকাশ করে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে সতর্ক করে দেয়ার মাধ্যমে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক সমাজ বিণির্মাণের চেষ্টা করছেন।একাজে সবাই সাধুবাদ জানানোর কথা থাকলে ও বর্তমানে এর উল্টো হচ্ছে। সাংবাদিকতা সম্পর্কিত আনার্জাতিক সংগঠন সিপিজে বলেছে -অপরাধ, মতানৈক্য, ও দমন নিপিড়ন এর খবর চাপা দেয়ার জন্য সরকারও অপরাধীদের পুরনো কৌশলের পাশাপাশি নতুন নতুন সব হুমকির মোকাবেলা করছে সাংবাদিকগণ।এক জরিপে দেখা যায়, বর্তমান সরকারের ৩ বছর ১ মাসে ১৪ সাংবাদিক খুন হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকাতেই খুন হয়েছেন ১০ জন ।সড়ক ও জনপদ খুন করেছে ৫ জনকে।এছাড়া পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আহত হয়েছেন ৩৪০ জন।
ঢাকার বাইরে সাংবাদিক খুনের ঘটনা বেশি।কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট এর গবেষনা অনুযায়ী ১৯৯৬ থেকে বাংলাদেশে পেশাগত কারণে ১২ সাংবাদিক খুন হয়েছেন।এরা সকলেই রাজধানীর বাইরে কর্মরত ছিলেন।ঢাকায় খুন হওয়া সাংবাদিকদের মধ্যে রয়েছেনঃ সাংবাদিক ফরহাদ খাঁ ও তার স্ত্রী রহিমা খানম, (২৮ জানুয়ারি২০১১) এনটিভির ভিাডও এডিটর আতিকুর রহমান(০৯) কেরানীগঞ্জের দি নিউ এজের সাংবাদিক আঃ লতিফ পাপ্পু (২ মার্চ০৪) সাংবাদিক আলতাফ হোসেন সাপ্তাহিক বজ্রকণ্ঠ, (৭ এপ্রিল১১) ও সাগর –রুনি ।(১১ ফেব্রæয়ারি ১২)।সাংবাদিকদের জন্য মৃত্যুভ্যালী খুলনা।খুলনায় নিহত সাংবাদিকদের মধ্যে ডুমুরিয়া, খুলনার দৈনিক অনির্বাণের প্রতিনিধি নহর আলী, একই যায়গার শুকর আলী, দৈনিক পুর্বাঞ্চলের সিনিয়র রিপোর্টার হারুন আল রশিদ, (২ মার্চ ০২) দৈনিক সংগ্রামের খুলনা বিভাগীয় ব্যুরো চফি বেলাল হোসেন, খুলনা প্রেস ক্লাবের সভাপতি হুমায়ুন কবির বালু (২৭ জুন০৪) খুলনা ব্যুরো চীফ মানিক সাহা (১৫ ফেব্রæয়ারি০৪)।এছাড়া সন্ত্রাসীরা অপহরন করে চিরদিনের মত নিখোঁজ করে দিয়েছে খুলনার ডুমুরিয়ার সাংবাদিক সরদার শুকুর হোসেনকে, ।তিনি ৫ জুলাই ০২ নিখোঁজ হন।এভাবে হারিয়ে যান চুয়াডাঙ্গার দিন বদলের কাগজের বজলুর রহমান (১২ জুন ৯৬)।এছাড়া সন্ত্রাসীদের কোপনলে প্রাণ দিয়েছেন বরিশালের মুলাদি প্রেসক্লাবের সভাপতি সফিকুল ইসলাম টুটুল (২৩ ডিসেম্বর০৯),গাজীপুরের সাম্প্রতিক সময়ের সাংবাদিক এস এম আহসান হাবিব বারী, (আগস্ট০৯ ),নারায়নগঞ্জের রুপগঞ্জের ইনকিলাব প্রতিনিধি আবুল হাসান আসিফ(ডিসেম্বর ০৯) , সিলেটের সাপ্তাহিক ২০০০ প্রতিনিধি ফতেহ ওসমানী , (২৮ এপ্রিল১০)বরিশালের মুলাদীর মনির হোসেন বারী ( ২৩ ডিসেম্বর১০)।
এছাড়া ৭ ডিসেম্বর ১১ গাইবান্ধার দৈনিক ভোরের ডাকের জেলা প্রতিনিধি ফরিদুল ইসলাম রঞ্জু নিহত হন, ৭ এপ্রিল ১১, চট্টগ্রামের দৈনিক আজকের প্রত্যাশার প্রতিনিধি মাহবুব টুটুল নিহত হন।সাতক্ষীরার দৈনিক পত্রদূত সম্পাদক মোঃ আলা উদ্দিন নিহত হন ১৯৯৬ সালে, একই সময়ে নিহত হন ঝিনাইদহ জেলার ইলিয়াস হোসেন দিলিপ, ৯৬ সালেই খুন হন নীলফামারীরর কামরুজ্জামান, ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম খুন হন ৬ জুলই ৯৮ । সুত্রে জানা যায়, ২০০০ সালে নিহত হন মীর ইলিয়াস হোসেন (ঝিনাইদহ), ১৬ জুলাই ২০০০ খুন করা হয় দৈনিক জনকণ্ঠ প্রতিনিধি সামছুর রহমানকে (যশোর), ২ অক্টোবর০৪ নিহত হন বগুড়ার দুর্জয় বাংলার নির্বাহী সম্পাদক দিপঙ্কও চক্রবর্তী, ১৭ নভেম্বর০৫ খুন হন দৈনিক সমকালের ফরিদপুর ব্যুরো প্রধান গৌতুম দাস।এছাড়া ২৯ সেপ্টেম্বর নিজ বাসায় খুন হন কুমিল্লা নিবাসী দৈনিক কুমিল্লা মুক্তকণ্ঠের সম্পাদক গোলাম মাহফুজ।এছাড়া আমরা হারিয়েছি দেনিক স্ফুলিঙ্গের আঃ গাফ্ফার চৌধুরি (৯৪) , মোঃ কামাল হোসেন,পাক্ষিক মুক্তমনের সাটাফ রিপোর্টার নুরুল ইসলাম ওরফে রানা ( আগস্ট ০৯) শফিকুল ইসলাম টুটুটল (১০) বীর দর্পণের সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেন দিলিপ(জানু২০০০)।
সাংবাদিক হত্যার বিচার না হওয়ার পেছনে দায়ী কারণগুলো হচ্ছেঃ তদন্তকাজে ধীরগতি , চার্জশীট প্রদানে বিল¤ব , তদন্তের নামে কালক্ষেপন, মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা, মূল আসামীকে পাশ কাটিয়ে চার্জশীট প্রদান, দুর্বল অভিযোগ উত্থাপন, ও চার্জশীটভূক্ত আসামীদের গ্রেফÍার না করা। এছাড়া বাদীকে হুমকি প্রদান ও নি¤œ আদালতের দীর্ঘসূত্রীতার কথা উল্লেখ করা যায়।আরেকটা বড় কারণ হচ্ছে সাক্ষ্য প্রমাণের অভাব, বিবাদী পক্ষ শক্তিশালী হওয়ায় কেউ সহজে সাক্ষ্য দিতে চায় না।ফলে আসামীরা সহজে ছাড়া পেয়ে যায়।সমপ্রতি দুটি হত্যা মামলার আসামীরা বেকসুর খালাস পায়।নিহত সাংবাদিক পরিবারের সদস্যগণ জানান, সাংবাদিক সমাজ ছাড়া অন্য কোথাও আমাদের যাওয়ার যায়গা নেই।কিন্তু তারা যদি সহকর্মীদের খুনিদের বিচার না চেয়ে বিষয়টিকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে তাহলে আমরা কখনোই ন্যায় বিচার পাব না।
সিপিজে (আমেরিকাভিত্তিক সংস্থা ) এর মতে -১৯৯২ সাল থেকে এপর্যন্ত বিভিন্ন দেশে অন্তত ১৫৬ জন সাংবাদিক হত্যার মামলা এখনও অমীমাংশিত রয়েছে।প্যারিসভিত্তিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার এর তথ্য অনুযাযী সাংবাদিকদের জন্য বিপজ্জনক দেশ হিসেবে বিশ্বের ১৭৮ টি দেশের মধ্যে মেক্সিকোর অবস্থান ১৩৬ । বাংলাদেশের অবস্থাও সুবিধের নয়।নিউইয়র্ক ভিত্তিক সংস্থা কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নলিস্টস এর দেয়া তথ্য অনুযায়ী সারা বিশ্বে মুক্ত সাংবাদিকতার ঝুঁকি বাড়ছে।সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের বিচারের দাবিতে সাংবাদিক সমাজ যেভাবে একাত্ম হয়ে আন্দোলন করেছে এর আগে তা কখনও দেখা যায়নি।হত্যাকান্ডের পর জাতীয় প্রেস ক্লাব চত্তরে অনশন, প্রেস ক্লাবের সামনে মহাসমাবেশ, জেলা ও উপজেলায় সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল, ও মানব বন্ধন কর্মসূচী পালন করে।এ উপলক্ষে সাংবাদিকদের চারটি সংগঠন যুগপদ আন্দোলন করেছে।এসংগঠনগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, (বিএফইউজে) , ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, (ডিইউজে) জাতীয় প্রেস ক্লাব ,এবং ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিি ট(ডিআরইউ)।এছাড়া ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স এসোসিয়েশনগুলো বিভিন্ন কর্মসূচী দেয়।২০১১ সালে মুক্ত গনমাধ্যম দিবস উপলক্ষে নিহত সাংবাদিকদের শ্রদ্ধা জানিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বলেন-সাংবাদিক খুনের সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও পেশাগত কারণে গেস্খফÍারকৃত সকল সাংবাদিককে মুক্তি দিতে হবে।”বিশ্বব্যাপী সাংবাদিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে সবাই সোচ্চার হলেও থেমে থাকেনি খুন ও নির্যাতন । বাংলাদেশে ২০০০ সাল থেকে সন্ত্রাসীদের খুনের তালিকায় রয়েছেন-দৈনিক জনবাণীর রিপোর্টার বেলাল হোসেন, যশোরের দৈনিক রানারের গোলাম মাজেদ, রাঙ্গামাটির ”এনটিবি” প্রতিনিধি জামাল উদ্দিন, নারায়নগঞ্জের প্রধান দৈনিকের সাংবাদিক আহসান আলী, ও মৌলবীবাজারের ফারুক আহমদ।খুনিরা অস্ত্র আর পেশি শক্তির বলে বলিয়ান। মানুষ খুন যেন তাদের নেশা হয়ে গেছে।তাই একের পর এক খুন তারা করেই যাচ্ছে। একটি খুনের মামলা শেষ না হতেই আরেকটি ঘটনা ঘটে যাচ্ছে; ফলে পুর্ববর্তী ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে। যখন যারাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বে থাকেন তারা একটিই বক্তব্য দেন, আর সেটি হচ্ছে আইন শৃংখলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক ভাল । এই ভালো (?) সময়েই ৩৯ জন সাংবাদিককে আমরা হারিয়েছি আরো কত ঘাতক বসে আছে তা আমরা জানিনা। সাংবাদিক হত্যা- নির্যাতনের দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়কেই নিতে হবে। নিহত সকল সাংবাদিক হত্যার বিচার করতে হবে এবং কর্মরত সকল সাংবাদিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।লেখকঃ মমিনুল ইসলাম মোল্লা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক ও সাংবাদিক, কুমিল্লা।