প্রাচীন বাংলার স্বাধীনতা রক্ষায় দূর্গের ভূমিকা।
দেশকে শত্রæর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রাচীনকাল থেকেই দূর্গ তৈরীর প্রথা প্রচলিত রয়েছে। এ অঞ্চলের শাসকদের একটি অতিরিক্ত সুবিধা ছিল ঘন ঘন নদী থাকায়। দুর্গম ও ¯্রােতবাহী নদী পাড় হয়ে শত্রæরা সহজে আক্রমণ করতে পারত না। তারপরও স্থায়ী ও অস্থায়ী দূর্গ তৈরীর মাধ্যমে নিজেদের রাজ্য রক্ষা করত। স্থায়ী দূর্গগুলো দেয়াল দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। এগুলোতে সৈন্যরা বসবাস করত। তাদের প্রয়োজনীয় সকল সামগ্রী ও যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র শস্ত্র মজুদ থাকতো। আর অস্থায়ী দূর্গগুলো যুদ্ধের প্রয়োজনে নির্মাণ করা হত। পরিখা, আত্মরক্ষার্থে খোড়া গর্ত, যুদ্ধাস্ত্র স্থাপনের মঞ্চ অস্থায়ী দূর্গগুলোর সাথে সম্পৃক্ত।নি¤েœ বাংলার কয়েকটি প্রাচীন দূর্গ সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃইদ্রাকপুর দূর্গঃ মগ ও পর্তুগীজদের আক্রমন প্রতিহত করার জন্য মুঘল সুবেদার বীর জুমলা ১৬৬০ সালে দূর্গটি তৈরী করেন। ইদ্রাকপুর দূর্গটি মুন্সিগঞ্জ শহরের পশ্চিম পাড়ে এবং দেওভোগ গ্রামের পূর্বপ্রান্তে গ্রামটি অবস্থিত। ইছামতি নদীর তীরে এটি নির্মান করা হয়। দূর্গটির চারপাশে মাটিতে ভরাট হয়ে গেছে। দূর্গটি চতুর্ভূজাকৃতির। এটির দুটি অংশ আছে। চাররদিকে প্রাচীর বিশিষ্ট দূর্গটির শীর্ষভাগ খিলানাকার। চারকোনে চারটি গোলাকার সন্নিহিত বুরুজ রেয়েছে। বুরুজের গায়ে বন্দুক বসিয়ে গুলি চালাবার ফুকর আছে। অন্যত্র প্রাচীরবেষ্টিত একটি ড্রাম রয়েছে। ড্রামের ঠিক পাশেই রয়েছে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ রাখার একটি ছোট্ট কুঠুরি।
এগার সিন্দুর দূর্গ ঃ ঈসাখানের স্মুতি বিজড়িত বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেরার একটি দূর্গ। এটি পাকুন্দিয়া উপজেলায় অবস্থিত। এগার সিন্দুর বলতে বাবার শীতালক্ষা আড়িয়াল খাঁ গিয়র সুন্দাসহ ১১ টিে নদীকে বুঝানো হত অর্থাৎ এগুলোর সংযোগস্থলে দূর্গটি স্থাপিত হয়েছিল। যতটুকু জানা যায়ষোড়শ শতকে বেরুধ নামে একজন উপজাতি প্রধান এই দূর্গটি স্থাপন করেন। এখনও সেখানে তার নামে একটি দিঘি রয়েছে। ধারনা করা দিঘির পাড়েই ছিল তার বাড়ি। সম্ভবত ঈসা খানের সাথে লড়াইয়ে পরাজিত হওয়ার পর দূর্গটি তার হাতছাড়া হয়ে যায়। ঈসা খান থেকে নেয়ার জন্য মানসিংহ ১৫৮৯ সালে লড়াইয়ে লিপ্ত হলেও সন্ধির কারনে তিনি ফিরে যান। পরবর্তীতে ইসলাম খান এটি দখল করেন। ১৮৯৭ সালের প্রলয়ংকারী ভূমিকম্পে এটি ধ্বংস হয়ে যায়। সপ্তদশ শতাব্দিতে এখানে সাদী মসজিদ ও শাহ মোহাম্মদ মসজিদ নামে দুটি মসজিদ স্থাপিত হয়। দূর্গটির কোন চিহ্ন এখন নেই। এটি মাটির দেয়ালে ঘেরা ছিল। এর চারিদিকে নদী ও একদিকে পরীখা ছিল বলে জানা যায়।
কোটালি পাড়া ঃ প্রাচীন স্বাধীন বাংলার একটি দূর্গ ছিল। এই দূর্গটি গোপালগঞ্জ জেলা সদরের ২৮ কিলোমিটার দক্ষিন পূর্বে ঘাঘট নদীর তীরে অবস্থিত ছিল বলে জানা যায়। কোটালি পাড়াকে এখনও সেখানকার লোকজন দুর্গনগর বলে আখ্যায়িত করে। এটি প্রাচীন কালে চন্দ্রবর্মন কোট নামেও পরিচিত ছিল। সম্ভবত দুর্গটি সমাচার দেবের ঘুঘাহাটি গ্রামে প্রাপ্ত তা¤্রশাসনে উল্লেখিত চন্দ্রবর্মনকোট।
খলিফাতাবাদঃ এখানে অস্থায়ী দূর্গ ছিল বলে কেউ কেউ অভিমত পোষন করেছেন। এটি ভৈরব নদীর তীরে বর্তমান বাগেরহাট শহরের সাথে শনাক্তকৃত একটি নগর। ইলিয়াস শাহী সুলতান নাসির উদ্দীর মাহমুদ শাহ এর আমলে খান জাহান (মৃত্যু ১৪৫৯) নামে জনৈক শাসনকর্তা কর্তৃক শহরটি মুসলিম অধিকারে নিয়ে আসে। এখানে টাকশালও ছিল। সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহ এর রাজত্বকাল পর্যন্ত শহরটির মর্যাদা অব্যহত ছিল বলে জানা যায়।
জঙ্গলবাড়ীঃ জঙ্গলবাড়ী দূর্গটি কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। জনশ্রæতি অনুযায়ী- ্েগার সিন্দুর যুদ্ধে মানসিংহের কাছে পরাজিত হওয়ার পর লক্ষণ সিংহাজরার কাছ থেকে ঈসা খান দূর্গটি দখল করেন। জঙ্গবাড়ীতে ঈসা খানের কিছু স্থাপনা রয়েছে। মুসা খান মুঘল অধিপত্য স্বীকার করে নিলে ঈসা খানের বংশধনগণ সোনারগাঁও থেকে জঙ্গলবাড়ী দূর্গে তাদের তাদের পরিবারবর্গকে স্থানান্তর করেন। কালক্রমে তারা এ অঞ্চলের জমিদারে পরিণত হয়। দূর্গটি ছিল বৃত্তাকার। এর চারিদিকে পরীখা ছিল দূর্গমূলটিকে এখনও একটি দ্বীপ বলে মনে হয়। বছরের অধিকাংশ সময় এটি জলমগ্ন থাকে।
চাটমোহরঃ পাবনা জেলা সদর থেকে ১১ মাইল উত্তরের একটি স্থান চাটমোহর। এখানে একটি দূর্গ ছিল। বর্তমানে এর অস্তিত্ব নেই। এটি ১৬শ শতাব্দীতে সুলতান আবুল ফাতেহ মুহাম্মদ সমসের খানের রাজ্যের রাজধানী ছিল। তিনি মুঘল স¤্রাট আকবরের অধিপত্য অস্বীকার একটি স্বাধীন রাজ্য পরিচালনা করতেন।
হাজীগঞ্জ দূর্গঃ নারায়নগঞ্জ শহরের পাশে শীতলক্ষার তীরে এটি অবস্থিত। মগ ও পর্তুগীজ দস্যূদের আক্রমন প্রতিহত করার জন্য এটি নির্মান করেছিলেন মীর জুমলা। দূর্গের প্রাচীর রেিয়ছে বন্দুক বসিয়ে গুলি চালাবার ফোকর এবং চারকোনে গোলাকার বুরুজ।
সোনাকান্দা দূর্গ ঃ নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার সোনাকান্দা নামক স্থানে রয়েছে আরেকটি দূর্গ। এসলাম খান ঢাকায় রাজধানী স্থাপনের পর দূর্গটি নির্মান করে। এটি বহুকাল জঙ্গলাকীর্ণ থাকলেও বর্তমানে প্রতœতত্ত¡ বিভাগের সহযোগিতায় ভালভাবে টিকে আছে।এছাড়াও বাংলাকে রক্ষা করার জন্য শাসকগণ বহু দূর্গ স্থাপন করেছিলেন যেগুলোর অস্তিত্ব বর্তমানে খুজে পাওয়া যায় না।
লালবাগ কেল্লাঃ ঢাকা নগরীর দক্ষিন পশ্চিম প্রান্তে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। যুবরাজ মুহাম্মদ আজম ১৬৭৮ সালে কেল্লাটি নির্মাণ শুরু করেন। কিন্তু আওরঙ্গজেব তাকে দিল্লী ডেকে পাঠালে শায়েস্তাখান সুবেদার হয়েও কাজ শেষ করেন নি। এখানে তার কন্যা পরি মারা গেলে তিনি একে অপয়া মনে করেন। বাংলাদেশের প্রতœতত্ত¡ বিভাগের তত্ত¡াবধানে বর্তমানে দূর্গটি পরিপূর্ণ রূপ নিয়েছে। দূর্গটিে কেন্দ্রিয় অংশটি জুড়ে রয়েছে তিনটি ভবন। পূর্ব দিকে দীউয়ান-ইতাম ও হাম্মাম, পশ্চিমে মসজিদ এবং এগুলোর মাঝখানে বিবি পরীর সমাধি সৌধ। মসজিদটি ৩ গম্ভুজ বিশিষ্ট। লালবাগ দূর্গে প্রতœতাত্তি¡ক খননের মাধ্যমে সুলতানী যুগ এবং প্রাক মুসলিম যুগের স্তর উন্মোচিত হয়েছে।এছাড়া বাংলাকে শত্রæদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য শাসকগণ বহু দূর্গ নির্মান করেছিল। এগুলোর অধিকাংশই এখন বিলীন হয়ে গেছে।
লেখক ঃ মমিনুল ইসলাম মোল্লা, সাংবাদিক, আশা মঞ্জিল, পল্লী বিদ্যুৎ রোড, কোম্পানীগঞ্জ, কুমিল্লা