কুমিল্লার হারিয়ে যাওয়া নগরী “গুনিকাগ্রহার”
মমিনুল ইসলাম মোল্লাপ্রতœতাত্তিক নিদর্শন হিসেবে কুমিল্লার ময়নামতির স্থান অন্যতম। কুমিল্লার দেবিদ্বারের গুনাইঘর ও ছিল তেমনি একটি প্রাচীন নগরী। আজ সেখানে কোন স্মৃতি-চিহ্ন দেখা না গেলেও হারিয়ে যাওয়া এ নগরীর গৌরবময় ইতিহাস এখন ও এলাকাবাসীর নিকট অ¤øান হয়ে আছে। গুপ্ত সম্রাটদের মধ্যে সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন রাজাধিরাজ। সমুদ্রগুপ্তের “এলাহাবাদ তাম্রলিপিতে” সমতটের নাম উল্লেখ রয়েছে। আর এই সমতটের রাজধানী ছিল দেবিদ্বারের বরকামতা।
গুনাইঘরে ৩টি বিহার ছিল বলে জানা যায়। এগুলো হচ্ছে রাজ বিহার, বৌদ্ধ বিহার, ও আশ্রম বিহার । এখানে শিব মন্দির ছিল বলেও প্রমাণ পাওয়া যায়। এ মন্দিরটি কামদেবের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়েছিল। শাক্যভিক্ষু আচার্য জিতসেনের একটি বিহারের উল্লেখসহ এ অঞ্চলে আরো বহু কীর্তি মাটি চাঁপা পড়ে আছে বলে মনে করা হয়। এখানকার বিহারগুলোর মধ্যে আশ্রম বিহার ছিল অন্যতম। জানা যায়-১৮৮ গুপ্তাব্দে (৫০৭খ্রি) এবিহার নির্মাণ করা হয়। রাজ বিহারের পাশে এটি নির্মাণ করা হয়। রাজ বিহারটি আরো অনেক দিন আগে তৈরী করা হয়েছিল। এখন হয়তো গুনাইঘরে প্রাচীনকালের কোন মন্দিরের চিহ্ন পাওয়া যাবে না। তবে বিখ্যাত পর্যটক হিউয়েন সাঙ সপ্তম শতকে সমতটে এসে ১০০টি হিন্দু মন্দির দেখতে পেয়েছিলেন। ১০১৫ সালে নেপালে চিহ্নিত এবং বর্তমানে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত (অষ্টসাহরকিা প্রজ্ঞাপারমিতা) গ্রন্থে সমতটের মন্দিরের অনেকগুলো চিত্র স্থান পেয়েছে। বৈন্যগুপ্তের গুনাইঘর লিপিতেও মন্দিরের পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯০৫ সালে গুপ্ত যুগের একটি তাম্রলিপি পাওয়া যায় নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলার থানাইদহ গ্রামে। তা¤প্রলিপিটি গুপ্তসম্রাট প্রথম কুমার গুপ্তের (৪১৫-৪৫৫) আমলের। ১১৩ গুপ্ত সংবৎসরে (অর্থাৎ ৪৩২-৪৩৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তা উৎকীর্ণ। তাম্রলিপিটি মূলত দানপত্র। এখানে প্রাপ্ত দলিলপত্রের মধ্যে বৈন্যগুপ্তের তাম্রশাসন উলেখযোগ্য। এটি বিহারের ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধার করা হয়। বিহারের নিম্নতম স্তরে এটি রাখা ছিল বলে জানা যায়। এর আয়তন ছিল ২৬.৬৭ সে.মি*১৫.৮৭সে.মি। এই লিপিটির পাঠোদ্ধার করা যায়নি। এটি পড়া গেলে আরো বহু অজানা ইতিহাস বেরিয়ে আসতো। তামার পাতের উপরের অংশে প্রায় ৯.২১সে.মি*১১.৭৫সে.মি আয়তনের একটি সিল মোহর রয়েছে। তাতে একটি উপবিষ্ট ষাড়ের মূর্তি উৎকীর্ণ রয়েছে। মূতির নীচে এক পঙক্তির একটি লিপি রয়েছে তাতে লেখ রয়েছে “মহারাজা শ্রী বৈন্যগুপ্তেশ্বর”। গুনাইঘরে যে দুইজন রাজা প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে শাসন করেছিলেন তাদের একজন মহাসামন্ত বিজয় সেন। তাকে কোন কোন জায়গায় দূতক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। দূতক হচ্ছে রাজ প্রতিনিধি। বিজয় সেনের অন্যান্য উপাধিগুলো হচ্ছে-মহাপতিহার,(শান্তিরক্ষক) মহাপিলুপতি, (হস্তিসৈন্যের অধ্যক্ষ) ইত্যাদি।
বাংলায় যেসব বংশ শাসন করেছে তাদের মধ্যে গুপ্ত বংশ অন্যতম। কুমিল্লার (বর্তমান চাঁদপুর) সাচারে একটি স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গেছে। এটি মহারাজ সমুদ্র গুপ্তের শাসনামলের। এ থেকে প্রমাণিত হয় এ অঞ্চলে সমুদ্র গুপ্তের শাসন বিরাজমান ছিল। আরো প্রমাণ পাওয়া যায় ৫০৭-৫০৮ খৃষ্টাব্দের পূর্বেই সমতট গুপ্ত অধিকারের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। গুনাইঘরে যারা শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন তাদের উন্নত শাসন ব্যবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়। বিশেষ করে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে তাদের পারদর্শিতা লক্ষ করা যায়। সুন্দরভাবে রাজস্ব আদায়ের জন্য সমস্ত প্রশাসনিক অঞ্চলকে তারা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করেন। গুপ্ত যুগের প্রশাসনিক ব্যবস্থাও ছিল উন্নতমানের। তখনকার যুগে প্রাদেশিক পর্যায়ের বিভাজন ছিল “ভূক্তি”। ভূক্তির অধীনে কয়েকটি বিষয় , বিষয়ের অধীনে কয়েকটি মন্ডল, মন্ডলের অধীনে কয়েকটি বিথী, বীথীর অধীনে ছিল গ্রাম।এসব অঞ্চলে কুমার, অমাত্ত, অযুক্তক, বিষয়পতি নামে তখন কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদ ছিল। ময়নামতি তাম্রশাসনেও ভূক্তি, মন্ডল, খন্ডল ও গ্রামের পরিচয় পাওয়া যায়। দেবিদ্বারে বিহার মন্ডল নামে একটি ঐতিহাসিক গ্রাম রয়েছে। এছাড়াও দেবিদ্বারের বরকামতায় সমতটের রাজধানী ছিল বলে জানা যায়। গুনাইঘর তাম্রশাসনে ৬ষ্ঠ শতকের বহু তথ্য পাওয়া যায়। ৬ষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম দশকে সামন্ত রাজা রুদ্রদত্তের অনুরোধে বৌদ্ধ বিহারের জন্য ভূমি দান করেছিলেন। মহারাজ রুদ্রদত্ত গুনাইঘরে অনান্দ বিহার নির্মাণের জন্য ৫টি পৃথক ভূখন্ডে সর্বশুদ্ধ ১১ পাটক ভূমি দান করেছেন। প্রথম খন্ডে ৭ পাটক, ( দ্রোনবাপ) দ্বিতীয় দাগে ২৮ দ্রোনবাপ, তৃতীয় খন্ডে ২৩ দ্রোনবাপ, চতুর্থ ভাগে ৩০ দ্রোনবাপ, এবং ৫ম ভূখন্ডে ১.৭৫ দ্রোনবাপসহ মোট ৯০ দ্রোনবাপ। তখন জমি পরিমাপের হিসাবটি ছিল এরকম-৯০ দ্রোনবাপ হচ্ছে ২.২৫ পাটক, ৪০ দ্রোনবাপ ১ পাটক। তখনকার ভূমি ব্যবস্থাপনার সিস্টেমও ছিল সুন্দর। কেউ কেউ বলেন আগে মুখে মুখে জমি বেচা-কেনা হতো। কিন্তু গুনাইঘরের ইতিহাস ভিন্ন। বৈন্যগুপ্তের গুনাইঘর পট্টালিতে দেখা যায়, মহারাজ বৈন্যগুপ্তের কাছে ভুমির জন্য আবেদন করেছেন মহারাজ রুদ্রদত্ত। তিনি ছিলেন বৈন্যগুপ্তের সামন্তরাজা। তবে বৈন্যগুপ্ত তাকে অর্থের বিনিময়ে নাকি বিনা অর্থে জমি দান করেছিলেন তা স্পষ্প নয়। তাম্রলিপিতে এর কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। জমি দানের ব্যাপারে বৈন্য গুপ্ত মনে করেন -তার পিতা-মাতা ও নিজের পূণ্য বৃদ্ধি পাবে। এছাড়াও তাম্রশাসন থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় খরগ রাজবংশের সময় রাজা দেব খরগের স্ত্রী প্রভাবতী ধাতুময়ী সর্বানী (দুর্গ) মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন। তিনি ব্রাহমনী দেবী সর্বানীর উপাসিকা ছিলেন। এছাড়া তৎকালীন সময়ে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রমাণ পাওয়া যায়। মহারাজ দেবখরগ ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, তিনি ভিন্ন ধর্মের হয়েও তার হিন্দু পতœীর জন্য শুধু দুর্গ মন্দিরই নির্মাণ করেননি দেবীর মূর্তিকে সোনার পাত দিয়েও মুড়ে দিয়েছিলেন। গুপ্তদের শাসনামলে আর্যরা কুমিলায় অধিক হারে প্রবেশ করে। গুপ্ত শাসনের আগে এখানে মৌর্যদের শাসন ছিল। ছাপযুক্ত হাজার হাজার মুদ্রা পাওয়া গেছে যেগুলোতে মৌর্যদের শাসনামলের চিহ্ন সপষ্ট ভাবে ফুটে উঠে। সময়ের দিক থেকে হিসেব করলে এগুলো যে খৃষ্ট জন্মের অন্তত ২০০ বছর পূর্বের তা সহজেই অনুমান করা যায়।
চন্দ্রগুপ্ত গুপ্ত রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। দু বছর রাজত্বের পর তার পুত্র সমুদ্র গুপ্ত সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি বহু রাজ্য দখল করেছিলেন। সমতট তার মধ্যে একটি। সমুদ্রগুপ্তের পুত্র ছিল দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত। বিক্রমাদিত্ব ছিল তার উপাধি। এক হিসেবে দেখা যায় বাংলাদেশে গুপ্ত শাসন শুরু হয় ৩২০ খ্রীস্টাব্দ থেকে। আর তাদের শাসন বহাল থাকে ৭৩৭ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত। তাদের শাসনকাল ছিল ৩১৮ বছর। মোট শাসক ছিল ২২ জন। এদের মধ্যে উলেখযোগ্য ছিলেন চন্দ্র গুপ্ত, সমুদ্রগুপ্ত, ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত। গুপ্ত বংশের প্রথম দিকের রাজাগন হচ্ছেন শ্রীগুপ্ত, ঘটোৎকোচ, প্রথম চন্দ্রগুপ্ত, নিসামুস গুপ্ত অন্যতম। শেষের দিকের রাজাদের মধ্যে বিষ্ণুগুপ্ত, বেন্যগুপ্ত ও ভানুগুপ্তের নাম বিশেষভবে উলেখযোগ্য। এছাড়া এসব বংশের রাজাগন হচ্ছেন রামগুপ্ত, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত, প্রথম কুমারগুপ্ত, স্কন্দগুপ্ত, পুরুগুপ্ত, দ্বিতীয় কুমারগুপ্ত, বুদ্ধগুপ্ত। এছাড়া নরসিংহগুপ্ত, বালাদিত্য, ও তৃতীয় কুমারগুপ্তও ছিলেন গুপ্ত বংশের বিখ্যাত শাসক। ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম অনুসারে এক সময় পতন নেমে আসে শক্তিশালী গুপ্ত রাজবংশের। শেষের দিকে গুপ্তবংশের দুর্বল শাসকগন বিরাধীদের মোকাবেলা করতে পারেন নি। তাদের পতনের পর বাংলায় অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সে সময় শক্তিশালী একক শাসন কর্তৃপক্ষ না থাকায় বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাধীন নরপতির উদ্ভব হয়। তারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য নিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে শাসন করতে থাকে। তাই গুপ্ত বংশের রাজাদের জনসাধারন তাদেরকে দীর্ঘদিন স্মরণ করে। গুনাইঘরের ইতিহাস অজানা ছিল বহু বছর। হয়ত এ সমৃদ্ধ সভ্যতার ইতিহাস আরো দীর্ঘদিন আমাদের আজানা থাকতো। সৌভাগ্যবশত: জ্ঞান রাজ্যের দুয়ার খুলে দিল একটি তাম্রশাসন। গুনাইঘরের একটি মজা পুকুর খনন করতে গিয়েই বেরিয়ে এল এক সুপ্রাচীন সভ্যতা। সে সভ্যতা ছিল গৌরবোজ্জ্বল সভ্যতা। সরকারিভাবে সেখানে গবেষনা ও অনুসন্ধান করলে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার খোঁজ পাওয়া যেতে পারে।
লেখক:কলেজ শিক্ষক,সাংবাদিক ও লেখক (বাতায়ন ,ইসলামও জীবন)
