মুক্তিযুদ্ধের কথা ঃএলাহাবাদ ট্রানজিট ক্যাম্পের স্মৃতি সংরক্ষণ করুন
মমিনুল ইসলাম মোল্লা
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাসে কুমিল্লার দেবিদ্বারের এলাহাবাদের নাম অবিস্মরনীয়। দেবিদ্বারের মুক্তিযোদ্বাগণ মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের প্রত্যোক্ষ তত্তাবধানে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্যহণ করেন। এ এলাকার মুকিবতযোদ্ধাদের হেডকোয়ার্টার ছিল এলাহাবাদ। এখানে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের বাড়ি অবস্থিত। এলাহাবাদ ট্রানজিট ক্যাম্প থেকে বাছাই করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনেচ্ছুক যুবকদের মনোনয়ন দেয়া হতো। তাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। শারীরিক কসরতের পর তাদেরকে পূর্নাঙ্গ ট্রেনিং এর জন্য ভারতে পাঠানো হতো। এভাবে ট্রেনিং নিয়ে ন্যাপ, সিপিবি, ও ছাত্র ইউনিয়নের নিজস্ব ১৯০০০ মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বেগবান করেছিল। বিশিষ্ট গবেষক মোতাহের হোসেন মাহবুব তার “যুদ্ধদিনের কথা” শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন বাংলাদেশের যে কোন জেলার চেয়ে কুমিল্লায় মুক্তিযোদ্ধা বেশি ছিল। যুদ্ধকালীন সময়ে প্রবাসী সরকারের দুটি প্রধান কেন্দ্রের মধ্যে আগরতলা ছিল অন্যতম। দুনম্বর সেক্টরের যুদ্ধ ও গেরিলা তৎপরতায় কুমিল্লার মুক্তিযোদ্ধাদের ছিল অগ্রণী ভূমিকা।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সারা দেশেই প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ও ট্রনজিট ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। উদাহরন স্বরুপ চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় স্থাপিত বহু প্রশিক্ষণ শিবিরের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। এমনই এশটি প্রশিক্ষণ শিবির ছিল দেবিদ্বাওে নলআরা। ফতেহাবাদ গ্রামের নলআরা এশটি ঐতিহাসিকস্থান। পরবর্তীতে প্রশিক্ষণ শিবিরটি দেবিদ্ধারের এলাহাবাদে স্থানান্তরিত করা হয়।
এলাহাবাদ ট্রানজিট ক্যাম্প থেকে কারা কারা ভারতে চুড়ান্ত ট্রেনিং করতে গেল তাদেও কিছু খবরাখবর পাওয়া যেত “সাপ্তাহিক মুক্তিযুদ্ধ” ও সাপ্তাহিক “নতুন বাংলা ”পত্রিকায়। গেরিলাদের সাফল্যেও খবর এ পত্রিকার মাধ্যমে জনসাধারণ জানতে পারতো। মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে এগুলো এলাহাবাদে আসতো এবং এগুলো এখান থেকে অন্যান্য স্যাটেলাইট ক্যাম্পে পাঠানো হতো। বৃহত্তর কুমিল্লা ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি -ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নিযুক্ত হয়েছিলেন দেবিদ্ধার নিবাসী ইঞ্জিনিয়ার মোস্তাফিজুর রহমান। পরবর্তীতে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন জাকির হোসেন। সোনামুড়ায় ছিল ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ গেরিলা বাহিনীর ক্যাম্প, এ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ন্যাপ নেতা ফয়েজ উল্লাহ।
এলাহাবাদের পার্শ্ববর্তী গ্রাম শুভপুরে মুক্তিযুদ্ধের এশটি স্যাটেলাইট ক্যাম্প ছিল। এলাহাবাদ ক্যাম্পের সাথে এ ক্যাম্পের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। সেখানকার ক্যাম্পের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা বলেন, শবে বরাতের রাতে যখন আামরা মসজিদের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন একদল নামাজী মসজিদ থেকে বেড়িয়ে আমাদের জন্য দু হাত তুলে দোয়া করে। সহানুভুতিশীল এ দৃশ্য আজও আমার মনে দোলা দেয়। বিএলএফ এর হাবিবুর রহমান ছিলেন দেবিদ্ধার থানা কমান্ডার। তিনি একজন পুলিশ অফিসার ছিলেন। স্বাধীনতাত্তোরকালে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ী বাঙ্গালী যুদ্ধে তিনি মারা যান। এলাহাবাদের এ ক্যাম্পটি শুধু মাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও ভারতে স্থায়ী প্রশিক্ষণের জন্য মুক্তিযোদ্ধা মনোনয়নের কাজেই ব্যবহৃত হতো না। এখানে দেশের বিভিন্ন যায়গা থেকে আসা গন্যমান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অববস্থান করেছেন। এব্যাপারে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট গোরাম ফারুক বলেন,গেরিলা বাহিনীর ট্রানজিট ক্যাম্প মার্চ ও এপ্রিল এ দু মাসে ঢাকার কেন্দ্রিয় নেতৃবৃন্দ প্রথমে এলাহাবাদ ক্যাম্পে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এখান থেকে তারা আগড়তলায় চলে যান। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা হুমাযুন কবির মজুমদার বলেন-৭০ এর নির্বাচনের পর পর আমরা ভিক্টোরিয়া কলেজের ডামি রাইফেল দিয়ে প্র্যাকটিস করি। ”গুনাইগর ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ”মোঃ আলমগীর হোসেন বলেন -৭১ সালে পুরো এলাহাবাদ মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় শিবিরে পরিনত হয়েছিল। আমরা তখন সাংবাদিক মমিন মোল্লার দাদা আক্কাস মোল্লার তুলাগাছের নীচের ১টি কুড়েঘড়ে থাকতাম। সেখান থেকে আমরা বিভিন্ন অপারেশনে যেতাম। দেবিদ্বারে গেরিলা বাহিনীর অপারেশন ছিল বারেরায় পাকিস্তানী বাহিনীর উপর এমবুশ, -যাতে বেশ কয়েকজন পাক আর্মি মারা যায়।
সাপ্তাহিক মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত এলাহাবাদ ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্দাদের মধ্যে মজিবুর রহমান, সামছুল হক, রশিদ সরকার, ময়নাল হোসেন ভূইয়া, নূরূল ইসলাম ,আজিজ ভূইয়া, আকামত আলী, আ: মান্নান, আব্দুল হক, ; সোবহান, আ: হান্নান, খায়রুল আলম ভূইয়া, তাজুল ইসলাম ভূইয়া, শামসুল হক, এড: আব্দুর রহমান, সফিকুর রহমান ভূইয়া, আ: জলিল এর বীরত্বের কাহিনী উল্লেখ করা হয়েছে।
এলাহাবাদ ক্যাম্পের ব্যাপারে হুমায়ুন কবির মজুমদার বলেন- রোজার ঈদের দিন আমি শুভপুর থেকে এলাহাবাদ ক্যাম্পে যাই। সন্ধার পর সেখান থেকে ফিরে আসি। হরিমোহন দাশ ও তার পরিবার আমাকে আশ্রয় দেয়। হরিমোহন দাশের স্ত্রী রনজিত পালের মা আমাকে অত্যন্ত ¯েœহ করতো। আমি তাকে মা বলে ডাকতাম। ” এলাহাবাদ ট্রানজিট ক্যাম্পের প্রশিক্ষণ, খাওয়া দাওয়া, ভারতে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সার্বিক সহযোহগীতা করেন এলাহাবাদের কাজী মাজহারুল ইসলাম, জাফর চেয়ারম্যান, ফুর মিয়া চেয়ারম্যান, আব্দুল মতিন মাস্টার, আব্দুল বারেক, প্রমুখ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে গেরিলা যোদ্ধাদের অবদান সর্বজন স্বীকৃত। উইকিপিডিয়াতে এব্যাপারে বলা হয়েছে-আগস্টের পর পরই গেরিলা পদ্ধতিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানী সামরিক ববাহিনী তাদের দোসরদের ওপর হামলা চালাতে থাকে। পাকিস্তানী সামরিক ঘাটি থেকে শুরু কওে সামরিক স্থাপনা , যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে রাস্তা-ঘাট ব্রিজ, কালভার্ট, ইত্যাদি মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত হয়। দেবিদ্ধারের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা দেবিদ্ধার সুজাত আলী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ক্রাপ্টেন সুজাত আলী ও ভরতীয় মিত্র বাহিনীর মেজর পান্ডের নেতৃত্বে ১৯৭১ সারের ৪ ডিসেম্বও দেবিদ্বার-চান্দিনা এরাকা মুক্ত হয। চান্দিনা হাই স্কুল মাঠে মিত্র বাহিনীর কাছে ১৪/১৫শ পাকিস্তানী আর্মি আত্মসমর্পন করে।১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ট্রানজিট ক্রাম্পটি চালু ছিল। ট্রানজিট ক্যাম্পের অস্ত্র গুদামের দায়িত্বে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা জুয়েল। পরে বঙ্গবন্ধুর আহবানে সবাই অস্ত্র জমা দিলে ট্রানজিট ক্যাম্পটির পরিমসমাপ্তি ঘটে। কুমিল্লার দেবিদ্বারের নলআরাও এলাহাবাদ ট্রানজিট ক্যাম্পটির স্মৃতি রক্ষায় সরকারিভাবে উদ্্েযাগ নেয়া উচিত। লেখকঃ মমিনুল ইসলাম মোল্লা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক ও সাংবাদিক, কুমিল্লা।