‘দেবীদ্বার’ নামকরণ নিয়ে কিছু কথা Shareবিএম আতিকুর রহমান বাশার

দেবীদ্বার নামকরণ নিয়ে কিছু কথা
Shareবিএম আতিকুর রহমান বাশার

দেবীদ্বার’র নামকরণ নিয়ে নানামূখী প্রবাদ, গল্প, কল্পকাহিনী রয়েছে। আজকের প্রোপটে নামকরনের সঠিক অবস্থানে পৌঁছা খুবই কঠিন। তবে লোকমুখে নামকরনের ত্রিমূখী যুক্তি পাওয়া গেছে। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে অভিভক্ত দিনাজপুর জেলার ভাটুরিয়ার দেবীকোটের রাজ পরিবারের মধ্যে ভাতৃকলহে পৈত্রিক রাজপরিবার ত্যাগ করে বানরাজা এ অঞ্চলে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বানরাজা দেবীকোট থেকে আসায় এ অঞ্চলের মানুষের কাছে বানরাজা পরিচয়ের চেয়ে দেবীকোটের রাজা হিসাবে ব্যপক পরিচিতি লাভ করেন। কালক্রমে দেবীকোটের নাম থেকে আজকের দেবীদ্বারের নামকরণ করা হয়েছে। ক্ষেত্রে ভিন্ন কথাও রয়েছে, কারো কারো মতে, অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বৃটিশ ক্যাপ্টেন জন ডেভিড ভারতের চিতনা নামক স্থান থেকে নৌপথে গোমতী নদী দিয়ে ঢাকা যাওয়ার পথে দেবীদ্বারের ভিংলাবাড়ি নামক স্থানে বানরাজার সৈন্যদের সাথে তার নেতৃত্বাধীন সৈন্যদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এক সময় ওই যুদ্ধের নাম জন ডেভিডের নাম জড়িয়ে “ডেভিড ওয়ার” (ডেভিডের যুদ্ধ) নামে পরিচিতি লাভ করে এবং ওই যুদ্ধের নামের প্রচলন থেকে আজকের দেবীদ্বার নামের নামকরণের উৎপত্তি বলেও অনেকে দাবী করছেন। তৃতীয় মতাদর্শীদের মতে, এ অঞ্চল এক সময় হিন্দু অধ্যুষিত ছিল। হিন্দু প্রধান এলাকা হিসাবে তাদের মূর্তী পূঁজার কেন্দ্রস্থল ছিল গোমতী নদীর পাড়। দেবীদ্বার গ্রামের টুনু দত্তের বাড়িতে একটি বড় পূঁজামন্ডপ ছিল। যাকে বলা হত ‘দেবীর ঘর’, এঘরে নির্মান হত দেব-দেবীর মূর্তী। তৈরী মূর্তীগুলো দেশের বাহিরে ত্রিপুরায়ও সরবরাহ করা হত। তখন দেবীদ্বারের জাফরগঞ্জ এবং কোম্পানীগঞ্জ’র ব্রীজ সংলগ্নে দুটি নৌবন্দর ছিল। হিন্দুসম্প্রদায় তাদের মূর্তি-পূঁজাগুলো করতেন গোমতী পাড়ে। কারন, মূর্তি বিসর্জনের নির্ভরযোগ্য স্থান হিসাবে বেছে নেয় গোমতী নদীকে। এক সাথে ৭০-১০০টি পূঁজা মন্ডপ তৈরী হতো। পূঁজা শেষে এসব মূর্তিগুলো বিসর্জন দেয়া হতো গোমতী নদীতে। এ স্থানটিকে একসময় ‘দেবীর দুয়ারে’র খেতাবে ভূষিত করা হলো। সেই থেকে ‘দেবীর দুয়ার ’থেকে পরবর্তীতে ‘দেবীদুয়ার’ - ‘দেবীদ্ধার’- ‘দেবীদ্বার’ সর্বশেষ ১৯৮৪ ইং সনে দেবীদ্বারের ‘ ী’ পরিবর্তন করে ‘ ী‘র স্থলে ‘ি ’ যোগ করে আজকের দেবিদ¦ার বানানের প্রচলন শুরু করা হয়। ১৯৮৪ইং সনে দেবীদ্বার রেয়াজ উদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের অভিভাবক প্রতিনিধি নির্বাচনে তৎকালীন প্রধান শিক্ষক আলহাজ্ব এ.কে.এম.ফজলুল হোসেন সাম্প্রদায়ীক চেতনায় এবং হিন্দু বিদ্বেষী মনোভাবের কারনে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দেবীর সংস্পর্শ থেকে দেবীদ্বারকে মুক্ত করতে দেবীদ্বারের ‘ ী’র স্থলে ‘ি ’ প্রচলন শুরু করেন। ওই নির্বাচনে প্রার্থীদের ডেকে এনে তাদের নির্বাচনী প্রচরনায় পোষ্টার, লিফলেট, ব্যানার, ভোটার স্লিপ সহ বিভিন্ন প্রচার কাজে ‘দেবীদ্বার’র স্থলে ‘দেবিদ্বার’ লিখার পরামর্শ দেন। সেই প্রচার থেকে ১৯৮৫-১৯৮৬ ইং সনে তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল বাশার ভূইয়ার মাধ্যমে উপজেলা পরিষদের সভায় রেজুলেশন করে ওই নামের পরিবর্তন করা হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন অফিস- আদালত, বিপণী কেন্দ্রের সাইনবোর্ড, দাপ্তরিক কাগজ পত্র থেকে ‘দেবীদ্বার’ নাম মুছে ফেলে ‘দেবিদ্বার’ করা হয়। বর্তমানে সেই আভিধানিক শুদ্ধ বানানটি ‘দেবীদ্বার মাল্টিপার্পাস সমিতি’র সাইবোর্ড-এ স্বাী হয়ে শোভা পেলেও সম্প্রতি ‘দেবীদ্বার মাল্টিপার্পাস সমিতি’র জায়গা ব্যাক্তি মালিকানায় ইজারা দেয়া হলে ওই ভবনটি ভেঙ্গে ফেলার কারনে তাও মুছে ফেলা হয়েছে। বর্তমানে শুধুমাত্র সংবাদ কর্মীদের লেখালেখিতে প্রচলন ‘দেবীদ্বার’ বানানটি ব্যবহার হচ্ছে। সম্প্রতি কুমিল্লা জেলার ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিা-সংস্কৃতি ও সভ্যতা নিয়ে গবেষক মামুন সিদ্দিকীর সাথে দেবীদ্বারের নামকরনের বিষয়ে জানতে চাইলে, তিনি বিশিষ্ট লেখক তিতাস চৌধূরীর উদ্বৃতি দিয়ে বলেন, তার লিখা ১৯৮৩ইং সনে প্রকাশিত “কুল্লিা জেলার লোক সাহিত্য” বইয়ে কুমিল্লার গ্রাম গঞ্জের নাম করনে লোকশ্রুতি দিয়ে দেবীদ্বারের নামকরনে উল্লেখ করেন,- “দেবীদ্বার গ্রামে জনৈকা ‘দেবীমূর্তী’ উদ্ধার প্রাপ্ত হয়েছিল এবং সেই ‘দেবী’ সকলের জন্য ‘দ্বার’ উন্মোক্ত করে দিয়েছিলেন। সেই ‘দেবীর’ উন্মোক্ত ‘দ্বার’ থেকে আজকের ‘দেবিদ্বার’ হয়েছে। দেবীদ্বারের নামকরন সম্পর্কে এরচেয়ে বেশী কিছু জানাযায়নি। দেবীদ্বার থানা প্রতিষ্ঠা ঃ একসময়ের ত্রিপুরা বর্তমানে কুমিল্লা। সেই ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা ‘কমলাঙ্ক’র নমানুসারে ‘কমলাঙ্ক’, কমলাঙ্ক থেকে ‘কর্মুল্যা’, কর্মুল্যা থেকে ‘কুমিল্যা’, কুমিল্যা থেকে আজকের ‘কুমিল্লা’র নামকরন হয়েছে। আর এ কুমিল্লা জেলার সর্ববৃহৎ থানা/ উপজেলা ‘মুরাদনগর’কে বিভক্ত করে ৩২ ইউনিয়নের বড়শালঘর, ইউছুফপুর, রসুলপুর, সুবিল, ফতেহাবাদ, দেবীদ্বার, এলাহাবাদ, জাফরগঞ্জ, গুনাইঘর (উঃ), গুনাইঘর (দঃ), রাজামেহারসহ ১১টি ইউনিয়ন ও চান্দিনা থানার ধামতী (উঃ), ধামতী (দঃ) (সুলতানপুর), ভানী, বড়কামতা, মোহনপুরসহ ৫টি ইউনিয়ন নিয়ে দেবীদ্বার থানা’র সৃষ্টি হয়েছিল। কথিত আছে দেবীদ্বার থানা’র সৃষ্টি হয়েছিল ‘শালঘর’ ও ‘ধামতী’ ইউনিয়নের দাঙ্গাবাজ লোকদের দমনে। মুরাদনগরের ৩২টি ইউনিয়নের মধ্যে ১১টি এবং চান্দিনা থানার ৫টি ইউনিয়ন আলাদা করে ১৬টি ইউনিয়ন নিয়ে ১৯১৭ সালের ১৫ জুলাই দেবীদ্বার থানা প্রতিষ্ঠা হয়। ওই একই সালের ২১ সেপ্টেম্বর ১১২৩ নং স্মারকে গেজেট আর.এ. প্রকাশ হওয়ার পর ১৯১৮ সালের ১ জানুয়ারী থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে দেবীদ্বার থানার কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে ১৯৮৬সালে থানাকে উপজেলায় রুপান্তরিত করার পর ২০০২সাল থেকে ৫নং দেবীদ্বার ইউনিয়নকে পৌরসভায় উন্নিত করার পর উক্ত উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নের মধ্যে বর্তমানে ১৫টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা করা হয়েছে। লেখক ঃ এবিএম আতিকুর রহমান বাশার, সাংবাদিক ও রাজনীতিক, 


শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.